মিসরের জনগণ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র চায় না
কামাল গাবালার জন্ম মিসরের রাজধানী কায়রোর অদূরে, ১৯৫৩ সালে। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৬ সালে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর ১৯৭৭ সালে সরকারের প্রেস ও প্রকাশনা বিভাগের চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮০ সালে সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন দৈনিক আল-আহরাম পত্রিকায়। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি কুয়েতে দৈনিক আল-আমবা পত্রিকায় কাজ করেন। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি জাপানের টোকিওতে আল-আহরাম-এর ব্যুরোপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে আল-আহরাম-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। প্রথম আলোর দেড় দশক পূর্তি উপলক্ষে তিনি সম্প্রতি ঢাকায় এলে তাঁর এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম
প্রথম আলো : মিসরে আপনারা ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক স্বৈরশাসন হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন। প্রথমবারের মতো একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলো। কিন্তু এমন কী ঘটল যে আজ সেই নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট কারারুদ্ধ এবং বিচারের মুুখোমুখি? কামাল গাবালা : এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে অনেক কথা বলতে হয়। কিন্তু সে অবকাশ তো এখানে নেই। সংক্ষেপে কিছু বলতে গেলেও শুরু করতে হয় ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে, যখন মিসরীয় বিপ্লবের সূচনা ঘটে। সেই সময় আমাদের সবার মনে আশা জেগেছিল যে কয়েক দশক অপেক্ষার পর আমরা অবশেষে একটা গণতান্ত্রিক, বেসামরিক ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চলেছি।
প্রথম আলো : সেটার সূচনা তো ঘটেছিল, অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে আপনারা প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন করেছিলেন...
কামাল গাবালা : কিন্তু এসবের মধ্য দিয়ে মিসরে গণতন্ত্রের সূচনা ঘটেনি। মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে মিসরে একটা বেসামরিক, ধর্মভিত্তিক স্বৈরশাসন চালু হয়েছিল এবং ক্রমেই তা আরও বেশি স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠছিল।
প্রথম আলো : মিসরের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডকেই নির্বাচিত করে দেশের শাসনভার তাদের দিয়েছিল...
কামাল গাবালা : মুসলিম ব্রাদারহুড নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, এটা সত্য। কিন্তু বোঝা প্রয়োজন, কেন ও কীভাবে সেটা ঘটেছিল। প্রথমত, মিসরের জনগণ এর আগে কখনো মুসলিম ব্রাদারহুডকে রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখার সুযোগ পায়নি। নির্বাচনের আগে অনেক মিসরীয় মনে করেছিল, ব্রাদারহুডের লোকজন ভালো, তারা গরিব-অসহায় মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করে। যুগ যুগ ধরে তারা শাসকদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে আসছে, তারা কঠোর সংগ্রাম করে আসছে। এবার যখন আমরা নিজেদের সরকার নির্বাচিত করার সুযোগ পেয়েছি, তখন ব্রাদারহুডকেই ভোট দিয়ে দেখা যাক। তাদের একটা সুযোগ দেওয়া হোক। দ্বিতীয়ত, উদারপন্থী ও বাম রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ নয়, সুসংগঠিতও নয়। কিন্তু ব্রাদারহুড ও অন্য ইসলামপন্থী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ এবং খুবই সংগঠিত। তৃতীয়ত, মিসরের অধিকাংশ মানুষ গরিব, তাদের ভোট কেনা যায়। সরাসরি টাকাপয়সা দিয়েও কেনা যায়, আবার নানা রকম সাহায্য-সহযোগিতার বিনিময়েও কেনা যায়। এসব ফ্যাক্টর মিলিতভাবে কাজ করেছে নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিজয়ের পেছনে।
প্রথম আলো : কিন্তু বছর না পেরোতেই সেই ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হলো কেন?
কামাল গাবালা : কারণ, মিসরীয় জনগণ ক্ষমতার বাইরে মুসলিম ব্রাদারহুডের যে চেহারা দেখেছিল, ক্ষমতাসীন ব্রাদারহুডের চেহারা তার থেকে ভীষণভাবে অন্য রকম। জনগণ চেয়েছিল একটা আধুনিক, অগ্রমুখী, সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। কিন্তু ব্রাদারহুড মিসরকে একটা ধর্মভিত্তিক, পশ্চাৎমুখী, স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট মুরসি বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ, রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমসহ রাষ্ট্র ও সরকারের সব স্তরে ব্যাপক রদবদল শুরু করেছিলেন। সব স্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো থেকে ভিন্নমতাবলম্বী লোকদের সরিয়ে ইসলামপন্থী লোকজনকে বসাচ্ছিলেন। তারা মৌলবাদী, মধ্যযুগীয় চিন্তার মানুষ। পেশাগত দক্ষতা-যোগ্যতার বালাই ছিল না, ব্রাদারহুডের সমর্থক আর গোঁড়া ধর্মীয় চিন্তাভাবনার মানুষ হলেই হলো। নারীদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার সুযোগও সংকুচিত হয়ে আসছিল; অনেক চাকরিজীবী নারী চাকরি হারিয়েছেন। পর্যটনশিল্পে ধস নেমেছে।
প্রথম আলো : কোনো ক্ষেত্রেই কি মুরসি সরকারের কোনো সাফল্য ছিল না?
কামাল গাবালা : অর্থনৈতিক অবস্থা আগের থেকে আরও খারাপ হয়েছে; নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়েছে। আশা করা হয়েছিল, নতুন নির্বাচিত সরকার এসে অন্তত রাজধানীর যানজট দূর করতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটাবে। কিন্তু সেটা ঘটেনি; বরং কায়রোর যানজট আরও বেড়েছে। ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে শহর। বিদ্যুৎ-ঘাটতি আরও বেড়েছে। ব্রাদারহুড নির্বাচনের আগে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার কোনোটাই পূরণ করতে পারেনি। তাই নির্বাচনের পর মাস ছয়েক না পেরোতেই জনগণের মোহভঙ্গ ঘটে। আরও একটা বড় ভুল করেছিলেন মুরসি। তিনি একটা প্রেসিডেনশিয়াল ডিক্লারেশন জারি করেন, যেখানে বলা হয়, প্রত্যেক মিসরীয়কে অবশ্যই প্রেসিডেন্ট মুরসিকে মেনে চলতে হবে, তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতা, তাঁর কোনো বিরোধিতা করা চলবে না। তিনি নিজেকে অনেকটা সৃষ্টিকর্তার জায়গায় স্থাপন করেন। মিসরের জনগণ এটাকে খারাপভাবে নিয়েছে।
প্রথম আলো : কিন্তু জনগণের মোহভঙ্গ কি এতই ব্যাপক ছিল যে জনগণ আর মুরসি সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চাচ্ছিল না? নাকি সামরিক বাহিনী সুযোগ নিয়েছে?
কামাল গাবালা : বাইরে থেকে মুসলিম ব্রাদারহুডকে যতটা জনপ্রিয় বলে মনে হয়, আসলে তারা ততটা জনপ্রিয় নয়। ব্রাদারহুড ও অন্য ইসলামপন্থী দলগুলোর মোট সমর্থন ২০ শতাংশেরও কম। কিন্তু নির্বাচনে তাদের সাফল্যের কারণ, তারা অন্য সব রাজনৈতিক দল ও গ্রুপের তুলনায় অনেক বেশি সংগঠিত। জামাত ইসলামিয়া, সালাফি গোষ্ঠীসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের পরে আমরা দেখলাম, তারা দেশকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছিল। মিসরীয় বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা এটা ছিল না যে মিসর ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী রাষ্ট্র হবে।
প্রথম আলো : কিন্তু যদি গণতন্ত্রের কথা বলা হয়, তাহলে ব্রাদারহুডের সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করার জন্য পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করা কি উচিত ছিল না?
কামাল গাবালা : কিন্তু মুরসি সরকার নিজেই তো আর গণতন্ত্র মানছিল না। তারা নিজেদের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্য, এমনকি চিরকাল ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার দুরভিসন্ধি নিয়ে যা কিছু করার—সব করছিল। তারা নিজেদের মতো করে সংবিধান প্রণয়ন করেছিল, যাতে মিসরীয় রাষ্ট্রের পরিচয় হয় একটা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে। শুধু তা-ই নয়, মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড স্বপ্ন দেখে, সারা পৃথিবীতে তারা একটা ইসলামি ব্যবস্থা গড়ে তুলবে, বলা যায় একধরনের ইসলামি সাম্রাজ্য, যেটা পরিচালিত হবে মিসর থেকে। সারা পৃথিবীতে তাদের সমর্থক রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী আছে। এমনকি বাংলাদেশেও আছে জামায়াতে ইসলামী। পৃথিবীর যেখানেই উগ্রপন্থী ইসলামি সংগঠন আছে, তাদের সঙ্গে মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের যোগাযোগ আছে। ব্রাদারহুড অতিপ্রাচীন একটা সংগঠন; ১৯২৮ সালে এর জন্ম। পৃথিবীজুড়ে এর অনেক শাখা আছে। একটা হচ্ছে জামাত ইসলামিয়া বা জামায়াতে ইসলামী, আরও আছে আল-কায়েদা ও তালেবান। আল-কায়েদার নেপথ্যের নায়ক জাওয়াহিরি একজন মিসরীয়, ওসামা বিন লাদেন মিসরীয় না হলেও মুসলিম ব্রাদারহুডের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছেন সারা জীবন। সুতরাং, মুসলিম ব্রাডারহুডের স্বপ্ন শুধু মিসরকে নিয়েই নয়, সারা পৃথিবীকে নিয়ে। তারা মিসরের ক্ষমতায় গিয়ে পৃথিবীজুড়ে উগ্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে নতুন করে সংগঠিত করছিল, তাদের অর্থকড়ি জোগান দিচ্ছিল।
প্রথম আলো : কিন্তু তারা তো নির্বাচিত হয়েই ক্ষমতায় গিয়েছিল। আপনারা কেন পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন না?
কামাল গাবালা : আমাদের পরবর্তী নির্বাচনের জন্য আরও চার বছর অপেক্ষা করার উপায় ছিল না। কারণ, প্রতিটি দিন অতিবাহিত হচ্ছিল আর মিসর তার সেক্যুলার আইডেনটিটি একটু একটু করে হারাচ্ছিল। যেসব সাধারণ নাগরিক ব্রাদারহুডকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছিল, তারাও এটা চাচ্ছিল না। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয়, ব্রাদারহুডকে আর এগোতে দেওয়া চলবে না, এক্ষুনি এসব থামাতে হবে। সে জন্যই আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, মুরসি সরকারের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ বিক্ষোভ জানাতে কায়রোর রাস্তায় নেমে এসেছিল।
প্রথম আলো : তার মানে, ব্রাদারহুডের মৌলবাদী সরকারের থেকে সামরিক স্বৈরতন্ত্রই শ্রেয় বলে মিসরের মানুষ মনে করছে?
কামাল গাবালা : না। একদম না। আমরা এই কথা বলছি উচ্চ স্বরে: আমরা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র যেমন চাই না, তেমনি সামরিক রাষ্ট্রও চাই না।
প্রথম আলো : কিন্তু সামরিক বাহিনী তো আবার ক্ষমতা নিয়েছে; মিসরের জনগণ কি সেটা মেনে নিয়েছে?
কামাল গাবালা : মিসর এখন সামরিক রাষ্ট্র নয়। আমরা এই ব্যবস্থা মেনে নিচ্ছি না। আপনি জানেন, গত জুন মাসের ৩০ তারিখে কী ঘটেছিল? দেড় কোটি থেকে তিন কোটি মিসরীয় নাগরিক সারা মিসরের বিভিন্ন অঞ্চলে রাস্তায় নেমে এসেছিল মুরসি সরকারের পদত্যাগের দাবিতে। মুরসিকে বিদায় জানিয়ে জনগণ একটি আগাম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছিল। কিন্তু মুরসি পদত্যাগ করতে রাজি হচ্ছিলেন না; উল্টা বরং প্রতিবাদী জনতাকে হত্যা করতে লাগলেন। প্রচুর মানুষের প্রাণহানি হলো। আর যেহেতু মুসলিম ব্রাদারহুড ও তার শরিক উগ্র ইসলামপন্থী দলগুলো বেশ সংগঠিত, তারাও চড়াও হতে লাগল বিক্ষোভকারীদের ওপর। এভাবে গোটা দেশের পরিস্থিতি ভীষণ সহিংস হয়ে উঠল। তখন সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ ছাড়া রক্তপাত বন্ধ করার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু তার মানে এই না যে সামরিক বাহিনীকে মিসরের জনগণ ডেকে এনে আবার ক্ষমতায় বসিয়েছে। না, সেটা আর কখনোই হবে না...
প্রথম আলো : কিন্তু সামরিক বাহিনী কত দিন থাকবে? মিসরের ভবিষ্যৎ কী?
কামাল গাবালা : ৫০ সদস্যের একটা কমিটি গঠন করা হয়েছে; তারা শিগগিরই সংবিধান প্রণয়ন করবে। তারপর পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে। নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে মিসরে গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু হবে, সামরিক বাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাবে।
প্রথম আলো : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
কামাল গাবালা : ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম
প্রথম আলো : মিসরে আপনারা ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক স্বৈরশাসন হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন। প্রথমবারের মতো একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলো। কিন্তু এমন কী ঘটল যে আজ সেই নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট কারারুদ্ধ এবং বিচারের মুুখোমুখি? কামাল গাবালা : এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে অনেক কথা বলতে হয়। কিন্তু সে অবকাশ তো এখানে নেই। সংক্ষেপে কিছু বলতে গেলেও শুরু করতে হয় ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে, যখন মিসরীয় বিপ্লবের সূচনা ঘটে। সেই সময় আমাদের সবার মনে আশা জেগেছিল যে কয়েক দশক অপেক্ষার পর আমরা অবশেষে একটা গণতান্ত্রিক, বেসামরিক ও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চলেছি।
প্রথম আলো : সেটার সূচনা তো ঘটেছিল, অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে আপনারা প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন করেছিলেন...
কামাল গাবালা : কিন্তু এসবের মধ্য দিয়ে মিসরে গণতন্ত্রের সূচনা ঘটেনি। মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে মিসরে একটা বেসামরিক, ধর্মভিত্তিক স্বৈরশাসন চালু হয়েছিল এবং ক্রমেই তা আরও বেশি স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠছিল।
প্রথম আলো : মিসরের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডকেই নির্বাচিত করে দেশের শাসনভার তাদের দিয়েছিল...
কামাল গাবালা : মুসলিম ব্রাদারহুড নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, এটা সত্য। কিন্তু বোঝা প্রয়োজন, কেন ও কীভাবে সেটা ঘটেছিল। প্রথমত, মিসরের জনগণ এর আগে কখনো মুসলিম ব্রাদারহুডকে রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখার সুযোগ পায়নি। নির্বাচনের আগে অনেক মিসরীয় মনে করেছিল, ব্রাদারহুডের লোকজন ভালো, তারা গরিব-অসহায় মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করে। যুগ যুগ ধরে তারা শাসকদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে আসছে, তারা কঠোর সংগ্রাম করে আসছে। এবার যখন আমরা নিজেদের সরকার নির্বাচিত করার সুযোগ পেয়েছি, তখন ব্রাদারহুডকেই ভোট দিয়ে দেখা যাক। তাদের একটা সুযোগ দেওয়া হোক। দ্বিতীয়ত, উদারপন্থী ও বাম রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ নয়, সুসংগঠিতও নয়। কিন্তু ব্রাদারহুড ও অন্য ইসলামপন্থী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ এবং খুবই সংগঠিত। তৃতীয়ত, মিসরের অধিকাংশ মানুষ গরিব, তাদের ভোট কেনা যায়। সরাসরি টাকাপয়সা দিয়েও কেনা যায়, আবার নানা রকম সাহায্য-সহযোগিতার বিনিময়েও কেনা যায়। এসব ফ্যাক্টর মিলিতভাবে কাজ করেছে নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিজয়ের পেছনে।
প্রথম আলো : কিন্তু বছর না পেরোতেই সেই ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হলো কেন?
কামাল গাবালা : কারণ, মিসরীয় জনগণ ক্ষমতার বাইরে মুসলিম ব্রাদারহুডের যে চেহারা দেখেছিল, ক্ষমতাসীন ব্রাদারহুডের চেহারা তার থেকে ভীষণভাবে অন্য রকম। জনগণ চেয়েছিল একটা আধুনিক, অগ্রমুখী, সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। কিন্তু ব্রাদারহুড মিসরকে একটা ধর্মভিত্তিক, পশ্চাৎমুখী, স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট মুরসি বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ, রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমসহ রাষ্ট্র ও সরকারের সব স্তরে ব্যাপক রদবদল শুরু করেছিলেন। সব স্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো থেকে ভিন্নমতাবলম্বী লোকদের সরিয়ে ইসলামপন্থী লোকজনকে বসাচ্ছিলেন। তারা মৌলবাদী, মধ্যযুগীয় চিন্তার মানুষ। পেশাগত দক্ষতা-যোগ্যতার বালাই ছিল না, ব্রাদারহুডের সমর্থক আর গোঁড়া ধর্মীয় চিন্তাভাবনার মানুষ হলেই হলো। নারীদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার সুযোগও সংকুচিত হয়ে আসছিল; অনেক চাকরিজীবী নারী চাকরি হারিয়েছেন। পর্যটনশিল্পে ধস নেমেছে।
প্রথম আলো : কোনো ক্ষেত্রেই কি মুরসি সরকারের কোনো সাফল্য ছিল না?
কামাল গাবালা : অর্থনৈতিক অবস্থা আগের থেকে আরও খারাপ হয়েছে; নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়েছে। আশা করা হয়েছিল, নতুন নির্বাচিত সরকার এসে অন্তত রাজধানীর যানজট দূর করতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটাবে। কিন্তু সেটা ঘটেনি; বরং কায়রোর যানজট আরও বেড়েছে। ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে শহর। বিদ্যুৎ-ঘাটতি আরও বেড়েছে। ব্রাদারহুড নির্বাচনের আগে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার কোনোটাই পূরণ করতে পারেনি। তাই নির্বাচনের পর মাস ছয়েক না পেরোতেই জনগণের মোহভঙ্গ ঘটে। আরও একটা বড় ভুল করেছিলেন মুরসি। তিনি একটা প্রেসিডেনশিয়াল ডিক্লারেশন জারি করেন, যেখানে বলা হয়, প্রত্যেক মিসরীয়কে অবশ্যই প্রেসিডেন্ট মুরসিকে মেনে চলতে হবে, তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতা, তাঁর কোনো বিরোধিতা করা চলবে না। তিনি নিজেকে অনেকটা সৃষ্টিকর্তার জায়গায় স্থাপন করেন। মিসরের জনগণ এটাকে খারাপভাবে নিয়েছে।
প্রথম আলো : কিন্তু জনগণের মোহভঙ্গ কি এতই ব্যাপক ছিল যে জনগণ আর মুরসি সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চাচ্ছিল না? নাকি সামরিক বাহিনী সুযোগ নিয়েছে?
কামাল গাবালা : বাইরে থেকে মুসলিম ব্রাদারহুডকে যতটা জনপ্রিয় বলে মনে হয়, আসলে তারা ততটা জনপ্রিয় নয়। ব্রাদারহুড ও অন্য ইসলামপন্থী দলগুলোর মোট সমর্থন ২০ শতাংশেরও কম। কিন্তু নির্বাচনে তাদের সাফল্যের কারণ, তারা অন্য সব রাজনৈতিক দল ও গ্রুপের তুলনায় অনেক বেশি সংগঠিত। জামাত ইসলামিয়া, সালাফি গোষ্ঠীসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের পরে আমরা দেখলাম, তারা দেশকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছিল। মিসরীয় বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা এটা ছিল না যে মিসর ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী রাষ্ট্র হবে।
প্রথম আলো : কিন্তু যদি গণতন্ত্রের কথা বলা হয়, তাহলে ব্রাদারহুডের সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করার জন্য পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করা কি উচিত ছিল না?
কামাল গাবালা : কিন্তু মুরসি সরকার নিজেই তো আর গণতন্ত্র মানছিল না। তারা নিজেদের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্য, এমনকি চিরকাল ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার দুরভিসন্ধি নিয়ে যা কিছু করার—সব করছিল। তারা নিজেদের মতো করে সংবিধান প্রণয়ন করেছিল, যাতে মিসরীয় রাষ্ট্রের পরিচয় হয় একটা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে। শুধু তা-ই নয়, মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড স্বপ্ন দেখে, সারা পৃথিবীতে তারা একটা ইসলামি ব্যবস্থা গড়ে তুলবে, বলা যায় একধরনের ইসলামি সাম্রাজ্য, যেটা পরিচালিত হবে মিসর থেকে। সারা পৃথিবীতে তাদের সমর্থক রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী আছে। এমনকি বাংলাদেশেও আছে জামায়াতে ইসলামী। পৃথিবীর যেখানেই উগ্রপন্থী ইসলামি সংগঠন আছে, তাদের সঙ্গে মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের যোগাযোগ আছে। ব্রাদারহুড অতিপ্রাচীন একটা সংগঠন; ১৯২৮ সালে এর জন্ম। পৃথিবীজুড়ে এর অনেক শাখা আছে। একটা হচ্ছে জামাত ইসলামিয়া বা জামায়াতে ইসলামী, আরও আছে আল-কায়েদা ও তালেবান। আল-কায়েদার নেপথ্যের নায়ক জাওয়াহিরি একজন মিসরীয়, ওসামা বিন লাদেন মিসরীয় না হলেও মুসলিম ব্রাদারহুডের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছেন সারা জীবন। সুতরাং, মুসলিম ব্রাডারহুডের স্বপ্ন শুধু মিসরকে নিয়েই নয়, সারা পৃথিবীকে নিয়ে। তারা মিসরের ক্ষমতায় গিয়ে পৃথিবীজুড়ে উগ্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে নতুন করে সংগঠিত করছিল, তাদের অর্থকড়ি জোগান দিচ্ছিল।
প্রথম আলো : কিন্তু তারা তো নির্বাচিত হয়েই ক্ষমতায় গিয়েছিল। আপনারা কেন পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন না?
কামাল গাবালা : আমাদের পরবর্তী নির্বাচনের জন্য আরও চার বছর অপেক্ষা করার উপায় ছিল না। কারণ, প্রতিটি দিন অতিবাহিত হচ্ছিল আর মিসর তার সেক্যুলার আইডেনটিটি একটু একটু করে হারাচ্ছিল। যেসব সাধারণ নাগরিক ব্রাদারহুডকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছিল, তারাও এটা চাচ্ছিল না। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয়, ব্রাদারহুডকে আর এগোতে দেওয়া চলবে না, এক্ষুনি এসব থামাতে হবে। সে জন্যই আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, মুরসি সরকারের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ বিক্ষোভ জানাতে কায়রোর রাস্তায় নেমে এসেছিল।
প্রথম আলো : তার মানে, ব্রাদারহুডের মৌলবাদী সরকারের থেকে সামরিক স্বৈরতন্ত্রই শ্রেয় বলে মিসরের মানুষ মনে করছে?
কামাল গাবালা : না। একদম না। আমরা এই কথা বলছি উচ্চ স্বরে: আমরা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র যেমন চাই না, তেমনি সামরিক রাষ্ট্রও চাই না।
প্রথম আলো : কিন্তু সামরিক বাহিনী তো আবার ক্ষমতা নিয়েছে; মিসরের জনগণ কি সেটা মেনে নিয়েছে?
কামাল গাবালা : মিসর এখন সামরিক রাষ্ট্র নয়। আমরা এই ব্যবস্থা মেনে নিচ্ছি না। আপনি জানেন, গত জুন মাসের ৩০ তারিখে কী ঘটেছিল? দেড় কোটি থেকে তিন কোটি মিসরীয় নাগরিক সারা মিসরের বিভিন্ন অঞ্চলে রাস্তায় নেমে এসেছিল মুরসি সরকারের পদত্যাগের দাবিতে। মুরসিকে বিদায় জানিয়ে জনগণ একটি আগাম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছিল। কিন্তু মুরসি পদত্যাগ করতে রাজি হচ্ছিলেন না; উল্টা বরং প্রতিবাদী জনতাকে হত্যা করতে লাগলেন। প্রচুর মানুষের প্রাণহানি হলো। আর যেহেতু মুসলিম ব্রাদারহুড ও তার শরিক উগ্র ইসলামপন্থী দলগুলো বেশ সংগঠিত, তারাও চড়াও হতে লাগল বিক্ষোভকারীদের ওপর। এভাবে গোটা দেশের পরিস্থিতি ভীষণ সহিংস হয়ে উঠল। তখন সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ ছাড়া রক্তপাত বন্ধ করার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু তার মানে এই না যে সামরিক বাহিনীকে মিসরের জনগণ ডেকে এনে আবার ক্ষমতায় বসিয়েছে। না, সেটা আর কখনোই হবে না...
প্রথম আলো : কিন্তু সামরিক বাহিনী কত দিন থাকবে? মিসরের ভবিষ্যৎ কী?
কামাল গাবালা : ৫০ সদস্যের একটা কমিটি গঠন করা হয়েছে; তারা শিগগিরই সংবিধান প্রণয়ন করবে। তারপর পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে। নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে মিসরে গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু হবে, সামরিক বাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাবে।
প্রথম আলো : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
কামাল গাবালা : ধন্যবাদ।
No comments