অবৈতনিক বনাম বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা by মহিউদ্দিন আহমদ
খোন্দকার লুৎফুল খালেদ, ফারিয়া তিলাত লোবা ও তন্বী নওশীন
সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খরচ বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী অন্যতম আলোচনার বিষয়। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিষয়টি অধিকতর গুরুত্ব বহন করে, কারণ এসব দেশের অধিকাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তাই শিশুর শিক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগের সঙ্গে অভিভাবকের আর্থিক সক্ষমতা সরাসরি জড়িত। দেশে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু থাকলেও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট নানারকম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খরচের কারণে একই মানের প্রাথমিক শিক্ষায় রাষ্ট্রের সব শিশুর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
দরিদ্রতা ও জনসংখ্যার ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে পরিগণিত। তবে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী ভর্তির হার এবং জেন্ডার সমতা অর্জনে উল্লেখযোগ্য সফলতা থাকলেও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর উচ্চহারের কারণে অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও ২০১৫ সালের মধ্যে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা ও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের শিক্ষাবিষয়ক মাইলফলক ছুঁতে পারবে না বলে ধরে নেয়া যায়। বর্তমানে বহু প্রতীক্ষিত শিক্ষা আইন অনুমোদন ও কার্যকর করার প্রক্রিয়া চলছে, কিন্তু বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য এর কার্যকারিতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। তাই বিরাজমান আইন ও নীতিমালাগুলো বিশ্লেষণ করে সেই ভিত্তিতে শিক্ষা আইনের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন, যাতে এ আইন প্রকৃত অর্থেই শিক্ষা অধিকার নিশ্চিত করার অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।
মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা : সরকার প্রাথমিক শিক্ষা (বাধ্যতামূলক) আইন ১৯৯০-এর মাধ্যমে দেশের সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করেছে। এ আইন অনুযায়ী সন্তানের শিক্ষা নিশ্চিত করার দায়ভার মূলত বাবা-মার অর্থাৎ সরকার সচেতনভাবেই প্রধান দায়িত্ব বাহকের ভূমিকা থেকে সরে এসে তার জবাবদিহিতার জায়গাটি অস্বচ্ছ করে রেখেছে। অথচ একটি রাষ্ট্রের নাগরিকের শিক্ষা নিশ্চিত করার প্রধান ও একমাত্র কর্তৃপক্ষ হল সরকার এবং সংবিধানে বিধৃত আছে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, তাই সরকার কোনোভাবেই প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার দায়ভার অন্য কোনো পক্ষের ওপর চাপিয়ে দিতে বা দায়িত্ব ভাগ করে নিতে পারে না।
আবার ১৯৯০-এর আইনের ন্যূনতম অঙ্গীকার হচ্ছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রাথমিক শিক্ষায় কোনো ফি লাগবে না এবং ক্রমান্বয়ে সব স্তরে অবৈতনিক শিক্ষা চালু করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা হল, প্রাথমিক ও মৌলিক শিক্ষায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পেছনে এখনও পরিবারকে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়। যদিও প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি ব্যয় ও বরাদ্দ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে প্রাথমিক শিক্ষার পরিধিও। শিক্ষাব্যয়ের মধ্যে বিদ্যালয়ের বেতন খাতে কোনো ব্যয় না থাকলেও অর্থাৎ শিক্ষা অবৈতনিক হলেও এখনও তা বিনামূল্যের নয় দেখে দরিদ্র পরিবারগুলোতেই এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি।
আলোচনা অবৈতনিকে সীমাবদ্ধ : জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ রাষ্ট্রের শিক্ষার নীতিগত তাগিদ সম্পর্কে বলা হয়েছে সব নাগরিকের জন্য শিক্ষা গ্রহণের সমান সুযোগ সৃষ্টি করার কথা। যেখানে প্রতি ৯ জনের মধ্যে ৩ জন অতি দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং শতকরা ৭৬ ভাগ মানুষ দৈনিক ১৬০ টাকার নিচে জীবনব্যয় নির্বাহ করে, সে দেশে সব মানুষের জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ সৃষ্টি করা বলতে অবশ্যম্ভাবীভাবে বোঝায় বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগ। শুধু তাই নয়, শিক্ষা বিনামূল্যে করার পাশাপাশি শিশুদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার বাড়তি প্রণোদনা তৈরির দায়িত্বও রাষ্ট্রেরই। অথচ শিক্ষানীতিতেও এ ব্যাপারে আলোচনা শুধু অবৈতনিকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। শিক্ষানীতির প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অংশে বলা হয়েছে ... প্রাথমিক শিক্ষা হবে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক এবং সকলের জন্য একই মানের। কিন্তু এর পরপরই বলা হয়েছে- কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি সব ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বাধ্যতামূলক করা হবে। সব শিশুর জন্য একই মানের শিক্ষা কেবল একই ধারার শিক্ষা চালু করার মধ্য দিয়েই সম্ভব। কিন্তু দ্বিতীয় অংশে দেশে বর্তমানে প্রচলিত যে ভিন্ন ভিন্ন ধারা তাকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে এবং সমাধান হিসেবে কেবল কিছু মৌলিক বিষয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি করার কথা বলা হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন ধারার শিক্ষার প্রচলন হয়েছে অভিভাবকদের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে- এই চাহিদার পার্থক্য প্রধানত অভিভাবকদের অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে হয়ে থাকে, কারণ একেকটি ধারার শিক্ষার খরচে বিপুল পার্থক্য বিদ্যমান। যে কারণে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের প্রধানত মাদ্রাসায় পড়তে দেখা যায় এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুদের ইংরেজি মিডিয়ামে- একটি ধারায় বিশেষভাবে পারলৌকিক ও ধার্মিক বিষয়াদির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় এবং অন্যটিতে ইংরেজি ভাষা এবং ইউরোপীয় ইতিহাস ও কৃষ্টি! বৈষম্য টিকিয়ে রাখার কী প্রয়াস! এমনিভাবে অর্থনৈতিক অবস্থার পার্থক্যের কারণে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থায় ভর্তি হওয়ার প্রক্রিয়া চালু রেখে বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য- রাষ্ট্রের সকল শিশুর জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ সৃষ্টি করা তাকেই অস্বীকার করা হচ্ছে।
আবারও উপেক্ষিত : বরাবরের মতো ২০১৩ সালের প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনেও শিক্ষাকে অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হয়নি, যাতে করে প্রত্যেক শিশুর জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করে সমাজে বৈষম্য কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। যদিও খসড়া আইনের ৪র্থ পৃষ্ঠার ৫(১) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা সব শিশুর জন্য অধিকার হিসেবে বিবেচিত হবে, তবে মৌলিক অধিকার হিসেবে শিক্ষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি বরাবরের মতো উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রের সব শিশুর জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দিক থেকে আইনগত দায়বদ্ধতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়নি। আইনে কোথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই যে, প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা সবার জন্য বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক হবে এবং এ পর্যায়ের শিক্ষায় কোনো পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ খরচ থাকবে না।
একটি কার্যকর, মানসম্পন্ন ও সমতাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বিশদ, সময়োপযোগী শিক্ষানীতির পাশাপাশি এর পরিপূরক আইন, শিক্ষা খাতের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য একটি টেকসই অর্থায়ন কাঠামো তৈরি করতে হবে। একটি সার্বিক কৌশলগত পরিকল্পনার ভিত্তিতে শিক্ষা খাতের চলমান এবং নতুন করে আবশ্যকীয় ব্যয়ের খাতগুলো চিহ্নিত করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ বিবেচনায় একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যয় কাঠামো প্রস্তুত করতে হবে। সব স্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করে একটি ধারাবাহিক সচেতন নাগরিক প্রয়াসের মধ্য দিয়ে সব শিশুর জন্য শুধু অবৈতনিক নয়, বরং বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টি শিক্ষা আইনে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হবে- এটাই সবার প্রত্যাশা।
সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খরচ বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী অন্যতম আলোচনার বিষয়। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিষয়টি অধিকতর গুরুত্ব বহন করে, কারণ এসব দেশের অধিকাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তাই শিশুর শিক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগের সঙ্গে অভিভাবকের আর্থিক সক্ষমতা সরাসরি জড়িত। দেশে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু থাকলেও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট নানারকম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খরচের কারণে একই মানের প্রাথমিক শিক্ষায় রাষ্ট্রের সব শিশুর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
দরিদ্রতা ও জনসংখ্যার ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে পরিগণিত। তবে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী ভর্তির হার এবং জেন্ডার সমতা অর্জনে উল্লেখযোগ্য সফলতা থাকলেও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর উচ্চহারের কারণে অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও ২০১৫ সালের মধ্যে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা ও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের শিক্ষাবিষয়ক মাইলফলক ছুঁতে পারবে না বলে ধরে নেয়া যায়। বর্তমানে বহু প্রতীক্ষিত শিক্ষা আইন অনুমোদন ও কার্যকর করার প্রক্রিয়া চলছে, কিন্তু বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য এর কার্যকারিতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। তাই বিরাজমান আইন ও নীতিমালাগুলো বিশ্লেষণ করে সেই ভিত্তিতে শিক্ষা আইনের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন, যাতে এ আইন প্রকৃত অর্থেই শিক্ষা অধিকার নিশ্চিত করার অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।
মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা : সরকার প্রাথমিক শিক্ষা (বাধ্যতামূলক) আইন ১৯৯০-এর মাধ্যমে দেশের সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করেছে। এ আইন অনুযায়ী সন্তানের শিক্ষা নিশ্চিত করার দায়ভার মূলত বাবা-মার অর্থাৎ সরকার সচেতনভাবেই প্রধান দায়িত্ব বাহকের ভূমিকা থেকে সরে এসে তার জবাবদিহিতার জায়গাটি অস্বচ্ছ করে রেখেছে। অথচ একটি রাষ্ট্রের নাগরিকের শিক্ষা নিশ্চিত করার প্রধান ও একমাত্র কর্তৃপক্ষ হল সরকার এবং সংবিধানে বিধৃত আছে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, তাই সরকার কোনোভাবেই প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার দায়ভার অন্য কোনো পক্ষের ওপর চাপিয়ে দিতে বা দায়িত্ব ভাগ করে নিতে পারে না।
আবার ১৯৯০-এর আইনের ন্যূনতম অঙ্গীকার হচ্ছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রাথমিক শিক্ষায় কোনো ফি লাগবে না এবং ক্রমান্বয়ে সব স্তরে অবৈতনিক শিক্ষা চালু করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা হল, প্রাথমিক ও মৌলিক শিক্ষায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পেছনে এখনও পরিবারকে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়। যদিও প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি ব্যয় ও বরাদ্দ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে প্রাথমিক শিক্ষার পরিধিও। শিক্ষাব্যয়ের মধ্যে বিদ্যালয়ের বেতন খাতে কোনো ব্যয় না থাকলেও অর্থাৎ শিক্ষা অবৈতনিক হলেও এখনও তা বিনামূল্যের নয় দেখে দরিদ্র পরিবারগুলোতেই এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি।
আলোচনা অবৈতনিকে সীমাবদ্ধ : জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ রাষ্ট্রের শিক্ষার নীতিগত তাগিদ সম্পর্কে বলা হয়েছে সব নাগরিকের জন্য শিক্ষা গ্রহণের সমান সুযোগ সৃষ্টি করার কথা। যেখানে প্রতি ৯ জনের মধ্যে ৩ জন অতি দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং শতকরা ৭৬ ভাগ মানুষ দৈনিক ১৬০ টাকার নিচে জীবনব্যয় নির্বাহ করে, সে দেশে সব মানুষের জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ সৃষ্টি করা বলতে অবশ্যম্ভাবীভাবে বোঝায় বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগ। শুধু তাই নয়, শিক্ষা বিনামূল্যে করার পাশাপাশি শিশুদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার বাড়তি প্রণোদনা তৈরির দায়িত্বও রাষ্ট্রেরই। অথচ শিক্ষানীতিতেও এ ব্যাপারে আলোচনা শুধু অবৈতনিকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। শিক্ষানীতির প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অংশে বলা হয়েছে ... প্রাথমিক শিক্ষা হবে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক এবং সকলের জন্য একই মানের। কিন্তু এর পরপরই বলা হয়েছে- কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি সব ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বাধ্যতামূলক করা হবে। সব শিশুর জন্য একই মানের শিক্ষা কেবল একই ধারার শিক্ষা চালু করার মধ্য দিয়েই সম্ভব। কিন্তু দ্বিতীয় অংশে দেশে বর্তমানে প্রচলিত যে ভিন্ন ভিন্ন ধারা তাকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে এবং সমাধান হিসেবে কেবল কিছু মৌলিক বিষয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি করার কথা বলা হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন ধারার শিক্ষার প্রচলন হয়েছে অভিভাবকদের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে- এই চাহিদার পার্থক্য প্রধানত অভিভাবকদের অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে হয়ে থাকে, কারণ একেকটি ধারার শিক্ষার খরচে বিপুল পার্থক্য বিদ্যমান। যে কারণে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের প্রধানত মাদ্রাসায় পড়তে দেখা যায় এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুদের ইংরেজি মিডিয়ামে- একটি ধারায় বিশেষভাবে পারলৌকিক ও ধার্মিক বিষয়াদির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় এবং অন্যটিতে ইংরেজি ভাষা এবং ইউরোপীয় ইতিহাস ও কৃষ্টি! বৈষম্য টিকিয়ে রাখার কী প্রয়াস! এমনিভাবে অর্থনৈতিক অবস্থার পার্থক্যের কারণে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থায় ভর্তি হওয়ার প্রক্রিয়া চালু রেখে বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য- রাষ্ট্রের সকল শিশুর জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ সৃষ্টি করা তাকেই অস্বীকার করা হচ্ছে।
আবারও উপেক্ষিত : বরাবরের মতো ২০১৩ সালের প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনেও শিক্ষাকে অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হয়নি, যাতে করে প্রত্যেক শিশুর জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করে সমাজে বৈষম্য কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। যদিও খসড়া আইনের ৪র্থ পৃষ্ঠার ৫(১) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা সব শিশুর জন্য অধিকার হিসেবে বিবেচিত হবে, তবে মৌলিক অধিকার হিসেবে শিক্ষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি বরাবরের মতো উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রের সব শিশুর জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দিক থেকে আইনগত দায়বদ্ধতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়নি। আইনে কোথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই যে, প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা সবার জন্য বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক হবে এবং এ পর্যায়ের শিক্ষায় কোনো পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ খরচ থাকবে না।
একটি কার্যকর, মানসম্পন্ন ও সমতাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বিশদ, সময়োপযোগী শিক্ষানীতির পাশাপাশি এর পরিপূরক আইন, শিক্ষা খাতের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য একটি টেকসই অর্থায়ন কাঠামো তৈরি করতে হবে। একটি সার্বিক কৌশলগত পরিকল্পনার ভিত্তিতে শিক্ষা খাতের চলমান এবং নতুন করে আবশ্যকীয় ব্যয়ের খাতগুলো চিহ্নিত করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ বিবেচনায় একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যয় কাঠামো প্রস্তুত করতে হবে। সব স্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করে একটি ধারাবাহিক সচেতন নাগরিক প্রয়াসের মধ্য দিয়ে সব শিশুর জন্য শুধু অবৈতনিক নয়, বরং বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টি শিক্ষা আইনে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হবে- এটাই সবার প্রত্যাশা।
No comments