হৃদয়ে রক্তক্ষরণ by জসীম চৌধুরী সবুজ

দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। এভাবে বয়ে চলে সময়। প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত ভরা গভীর শূন্যতায়। হৃদয়ে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ নিয়ে যাপিত এ জীবনের করুণগাথা লিখে কী শেষ করা যায়? নাকি প্রকাশ করা যায়! জীবন স্রোতের কঠিন ভেলায় তবু ভেসে চলেছি। ভেসেই চলেছি। বুকের ভেতর প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ নিয়ে। দেখতে দেখতে দুটি বছর পার হয়ে গেল। এসে গেল ৩১ আগস্ট। আমার ও আমার পরিবারের জন্য চরম দুঃস্বপ্নের একটি দিন। আমার বুকের ধন সোনা মানিককে হারানোর সেই কালো দিন। চৌধুরী তাহমিদ জসীম আপন। আমার সোনামণি, আমার আদরের ধন। আমার সব স্বপ্ন, সব আশা-আকাক্সক্ষাকে ভেঙেচুরে দিয়ে এই দিনে সে চলে গেছে না ফেরার দেশে। তার শারীরিক উপস্থিতি নেই। কিন্তু রাত বা দিন প্রতিটি সেকেন্ড সে আছে আমার হৃদয়জুড়ে, আমার মনের মণিকোঠায়। সময় কাটাই সেই মধুর দিনগুলোর স্মৃতি নিয়ে। আমৃত্যু এই স্মৃতি বয়ে বেড়ানো ছাড়া আমার আর কিই বা করার আছে! সমবেদনা, সহমর্মিতা নিয়ে যারা আমাদের পাশে ছিলেন এবং আছেন তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলতে চাই, সব দুঃখ সব কষ্ট কী ভোলা যায়। এ কষ্ট ও দুঃখ থাকল আমার একান্ত হয়ে।
দুই.
স্ত্রী রুমার জ্বর ক’দিন ধরেই কমে না। টেস্টে ধরা পড়ল টাইফয়েড। হাই ডোজের ওষুধ খেয়েই সারল রোগ। ঠিক সে মাসেই কনসিভ করল সে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা পেয়ে বসল আমাদের। হাই ডোজের ওষুধ নতুন আগন্তুকের কোনো ক্ষতি করবে না তো! গাইনির এক মহিলা ডাক্তারকে দেখালাম। ভদ্রমহিলা সিটি কর্পোরেশনের মেমন হাসপাতালে কর্মরত। তিনি আমাদের ভয় পাইয়ে দিলেন। বললেন, বয়স তো এখনও অনেক। ঝুঁকি নেয়ার দরকারটা কী। এমআর করে ফেলুন। এ কাজ তিনি নিজে করেন। বললেন তার প্রাইভেট ক্লিনিকে যেতে। দেখি বলে বিদায় নিলাম। গেলাম চমেক হাসপাতালে। পরিচিত চিকিৎসক ডাকলেন আরও অনেককে। মত দিলেন টেনশনের কোনো কারণই নেই। অনাগত শিশুর কোনো ক্ষতিই হবে না। মায়ের জঠরে দিনে দিনে বাড়ছে ভ্রƒণ। টেনশনও আমাদের বাড়ছে। অবশেষে এলো সেই দিন। আমি থাকতাম অগ্রজপ্রতিম সাংবাদিক সুখেন্দু ভট্টাচার্যের পাশের বাসায়। ভাবী চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যাপক আলো মল্লিক। ৩ জুলাই, ১৯৯৬ সাল। রাতে ভাবীসহ রুমাকে নিয়ে ভর্তি করালাম রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদনে। ঘড়ির কাঁটা ১২টা পেরিয়ে রাত দেড়টা। তারিখ ৪ জুলাই। রুমাকে লেবার রুমে ঢুকিয়ে বাইরে অপেক্ষায় সুখেন্দু ভাবী। আমি গেটের বাইরে। সিঁড়ি বেয়ে একদম ওপরে উঠে সেজদায় পড়ে আছি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, হে প্রভু আমাকে সুস্থ সবল সন্তান দাও। রাত আড়াইটায় ডাক দিলেন ভাবী। দৌড়ে গেলাম। বললেন পুত্র সন্তান হয়েছে। নার্সরা এনে প্রথমে তার কোলে দিলেন। তিনি দিলেন আমাকে। কী সুন্দর ফুটফুটে ছেলে, চোখ দুটো তার কত আকর্ষণীয় মায়াময়। হাজারও শুকরিয়া জানালাম সৃষ্টিকর্তার কাছে।
তিন.
এক মেয়ে এক ছেলে নিয়ে আমার সুখী সংসার। অর্থবিত্তের বৈভব না থাকলেও পৃথিবীতে আমার চেয়ে সুখী মানুষ যেন আর দ্বিতীয়টি ছিল না। সন্তানদের মানবিক মূল্যবোধে গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে বলতাম, হে আল্লাহ তোমার কাছে আমার অর্থবিত্ত কিছুই চাওয়ার নেই। যা আমায় দিয়েছ তাতেই আমি সন্তুষ্ট। একটা জিনিস শুধু চেয়েছি আমার ছেলেমেয়ে দুটোর সুস্থ সুন্দর জীবন ও তাদের বিদ্যাবুদ্ধিতে একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার তৌফিক যেন দান করেন তিনি।
জানি না আমার সেই ফরিয়াদ সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছেছে কিনা। পৌঁছলেও তা যে কবুল হয়নি তা আমার চেয়ে কে আর বেশি বোঝে। এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে দুঃখী মানুষ এখন আর কেউ নেই। ২০১১ সালের ৩১ আগস্ট ছিল পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন। এই খুশির দিনেই আমার জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। আপন সোনা আমার চিরদিনের মতো আমাদের ছেড়ে চলে গেছে সবকিছুকে পেছনে ফেলে। বাড়ির সামনে মসজিদের মিম্বরের পাশে শুয়ে আছে আমার আদরের ধন। মাঝে মধ্যেই ছুটে গিয়ে দাঁড়াই তার কবরের পাশে। বুক ফেটে আসা অশ্র“ধারা শত চেষ্টায়ও পারি না সংবরণ করতে। আমি কথা বলি আমার সোনাবাবুর সঙ্গে। আমি শুনতে পাই সে যেন আমায় বলছে, ‘এমন করিও না তো আব্বু’। মনে হয় এই বুঝি আমার ছেলে উঠে এসে বলবে, ‘সরি আব্বু, তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি, চলো এবার বাড়ি যাই।’ দুটি বছর পার হয়ে গেছে। ছেলে আমার আর আসে না। বাসায় কারও পায়ের শব্দ শুনলেই মনে হয় এই বুঝি এলো আপন সোনা। পথ চলতে গিয়ে স্কুলব্যাগ কাঁধে ছেলেদের দেখলে মনে হয় আমার আপন সোনা বুঝি চলে গেল সামনে দিয়ে। থমকে দাঁড়াই। খুঁজতে থাকি ছেলেকে। বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাই। সামলে নিই নিজেকে। বাসা থেকে বের হলেই পাড়ার ছেলেদের খেলতে দেখি। আমার আপন ছিল যাদের খেলার সঙ্গী। এখন সে আর তাদের খেলার সঙ্গে নেই। বুকের কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে নীরবে সরে যাই। এই কষ্টের বোঝা আমি বয়ে চলেছি। বয়ে চলব আমৃত্যু। চলতে চলতেই পৌঁছে যাব আমার ছেলের পাশে। এখন শুধু এটুকুই প্রার্থনা। দীর্ঘ জীবন নয়, সৃষ্টিকর্তা আমায় যেন তাড়াতাড়ি নিয়ে যান আমার আপন সোনার কাছে।
জসীম চৌধুরী সবুজ : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.