ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভয়াবহ গবেষণা কর্ম by বদরুদ্দীন উমর

Public Satisfaction with Current Policing Practice-এর ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ তাদের Criminology and Criminal Justice Programme-এর অধীনে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ২০ আগস্ট ২০১৩ তারিখে। ২০১২ সালের ২৪ মে থেকে ৪ নভেম্বর ঢাকা শহরে ৬১৭ জনের ওপর এই সমীক্ষা পরিচালিত হয় পুলিশ ডিপার্টমেন্টের অর্থায়নে। এর রিপোর্ট অনুযায়ী শতকরা ৮১ জন পুলিশের আচরণে সন্তোষ প্রকাশ করেন। সমীক্ষাটি পরিচালিত হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অধীনস্থ ৪৬টি থানা এলাকায়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ তাদের এক সমীক্ষা রিপোর্টে বলেছে, পুলিশ ও রাজনৈতিক দলগুলোই হচ্ছে সমাজের সব থেকে দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠান। (Daily Star, 21.08.2013).
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সমীক্ষার প্রধান তদন্তকারী অধ্যাপক মাহবুবউদ্দীন আহমদ সমীক্ষা রিপোর্টটি প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল, ডিএমপি কমিশনার প্রমুখ বক্তব্য প্রদান করেন। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। অর্থাৎ বেশ ঢাকঢোল পিটিয়েই পুলিশের অর্থায়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ পরিচালিত সমীক্ষাটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। দু’জন শিক্ষক ও ১৩ জন ছাত্র এই সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। তাদের রিপোর্টটিতে বলা হয়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) আচরণ ও তাদের প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে বিপুল অধিকাংশ নাগরিক ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। তাদের মতে, পুলিশ কোনো দুর্নীতি করে না এবং কোনো কাজের জন্য তাদের কোনো টাকাকড়িও ( Speed money) দিতে হয় না!
ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমদ, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের একজন অতিথি শিক্ষক, পুলিশের সততা ও দুর্নীতিমুক্ত আচরণের প্রশংসা করে বলেন, পুলিশ যদি দুর্নীতিবাজ হতো তা হলে তারা ঢাকার প্রত্যেকটি ভবনেরই মালিক হতো!! এহেন বক্তব্যের মাথামুণ্ডু বোঝার উপায় নেই। কোনো একটি বিভাগের লোক দুর্নীতিবাজ হলে তারা দেশের সব সম্পত্তির মালিক হবে- এই বক্তব্য যে সম্পূর্ণ অসার ও উন্মাদতুল্য তাতে সন্দেহ নেই। কারণ সমাজে অন্য অনেক ধরনের কর্মকাণ্ড আছে এবং এসব ক্ষেত্রেও দুর্নীতির অভাব নেই। কাজেই দুর্নীতিলব্ধ অর্থ তারা ঘরে রেখে দিয়ে শুধু পুলিশের জন্যই ঘরবাড়ি ও জমির বাজার ছেড়ে দিয়ে বসে থাকবে এমন চিন্তা উন্মাদ ছাড়া আর কে করতে পারে? তাদের এই বক্তব্যের মধ্যে যে ঔদ্ধত্য আছে সেটাও লক্ষ্য করার মতো। দুর্নীতির মাধ্যমে ঢাকা শহরের সব ভবনের মালিক পুলিশের লোকজন না হলেও পুলিশের লোকরা যে ঢাকা শহর এবং দেশের সর্বত্র বিশাল ধন-সম্পত্তি ও বাড়িঘরের মালিক তাতে সন্দেহ নেই। পুলিশের অর্থায়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তথাকথিত সমীক্ষায় যা বলা হয়েছে তার বিপরীতে সাধারণ মানুষ পুলিশকে চরম দুর্নীতিবাজ হিসেবেই জানেন। কারণ পুলিশের সঙ্গে যাদেরই যোগাযোগ হয় এবং পুলিশের খপ্পরে কোনো না কোনোভাবে যারাই পড়েন, তারা অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই জানেন, পুলিশের মধ্যে সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত লোক এতই দুষ্প্রাপ্য যে তার সাক্ষাৎ পাওয়া এক মহা ব্যতিক্রমী ব্যাপার।
পুলিশের চরিত্রের এই অভিজ্ঞতা নতুন নয়। পুলিশের দুর্নীতি এমন এক ব্যাপক ও নিষ্ঠুর ব্যাপার যে পুলিশের অন্য কোনো ভাবমূর্তি কল্পনা করাও কঠিন। পুলিশের প্রচলিত ভাবমূর্তি এমনই প্রতিষ্ঠিত যে, এ নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। এ পরিস্থিতিতে পুলিশ বিভাগ কর্তৃক নিজেদের অর্থায়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি সম্মানজনক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে নিজেদের চরিত্রের কালিমা চুনকাম করার চেষ্টা হঠাৎ কেন করা হল এবং তার থেকেও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, এ বিষয়টি প্রচারের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে উপাচার্যের সম্মতি ও উপস্থিতিতে এর প্রচারের ব্যবস্থাই বা কেন করা হল- এটা এক বিস্ময়ের ব্যাপার। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের যে অবস্থা তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। সবই এ দেশে সম্ভব। পুলিশের ওপর এই সমীক্ষা রিপোর্টটি এভাবে প্রকাশিত ও প্রচারিত হওয়া তারই এক উদাহরণ।
পুলিশের সততা ও দুর্নীতি নিরূপণের এই রিপোর্ট যখন প্রকাশিত হচ্ছে, সেই মুহূর্তেই পুলিশের এক বড় ধরনের দুর্নীতির রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক ও ছাত্ররা এই সমীক্ষা চালিয়েছেন তারা গাবতলী-আমিনবাজার এলাকার জনগণের কাছে গিয়েছিলেন কি-না জানা নেই। কারণ পত্রিকায় পুলিশের দুর্নীতি ও নির্যাতনের ওপর যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায়, কাঁচাবাজারের দোকানদার এবং বাস ড্রাইভারদের থেকে পুলিশের নিয়মিতভাবে জিনিসপত্র ও টাকা-পয়সা জোর করে আদায় করার বিরুদ্ধে দোকানদাররা ও বাস কর্মচারীরা সেখানে রাস্তা অবরোধ করে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর সময় আমিনবাজার পুলিশ ক্যাম্প থেকে পুলিশের সব লোককে সরিয়ে নিয়ে অন্য এক দলকে সেখানে এখন দেয়া হয়েছে (Daily Star, 27.08.2013)। পুলিশের বড় কর্তারা উপস্থিত হয়ে অবরোধকারীদের আশ্বাস দেন, কোনো পুলিশের দুর্নীতি প্রমাণিত হলে তাকে শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা তারা করবেন। এর পর তারা অবরোধ উঠিয়ে নেন। আমিনবাজারে পুলিশের দুর্নীতির ওপর বিস্তারিত রিপোর্ট পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হলেও তার দীর্ঘ বিবরণ এখানে উল্লেখের প্রয়োজন নেই। বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা হল এ কারণে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে যখন পুলিশের সততা ও দুর্নীতিবিরোধিতা সম্পর্কে গালভরা রিপোর্টটি প্রকাশিত ও আলোচিত হচ্ছে ঠিক সেই একই সময়ে আমিনবাজারে পুলিশের ব্যাপক দুর্নীতি ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সড়ক অবরোধ হচ্ছে। সিনেট হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সমীক্ষা রিপোর্টটিতে যা বলা হয়েছে তার সমালোচনা করে সেখানে কেউ কোনো বক্তব্য প্রদান করেছেন- এমন কিছুর উল্লেখ পত্রপত্রিকার কোথাও নেই! এর থেকে বাংলাদেশের শিক্ষিত ভদ্রলোকদের অবস্থাও অনুমান করা কঠিন নয়!!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত উপরোক্ত সমীক্ষাটি যে একেবারে ভুয়া ব্যাপার, এতে কোনো সংশয় নেই। এটা যে কোনো সৎ ব্যক্তিই স্বীকার করতে বাধ্য। কিন্তু এটা বললেই শেষ হয় না। এর ভয়াবহ দিকটি হল, পুলিশের আচরণ ও দুর্নীতিমুক্ত চরিত্র বিষয়ে যারা সমীক্ষা চালিয়ে রিপোর্টটি তৈরি করেছেন, তাদের অবস্থা। পুলিশের সুপরিচিত দুর্নীতিকে চুনকাম করে সমাজে উপস্থিত করার এই চেষ্টা যারা করেছেন, তারা নিজেরা দুর্নীতিবাজ পুলিশের দুর্নীতির শিকার হয়েই যে এই কাজ করেছেন, এতে সন্দেহ নেই। এ কাজ যদি কোনো বেসরকারি সংস্থা থেকে করা হতো, তাহলে সেটা তত বিপজ্জনক হতো না। কিন্তু এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের উদ্যোগে হওয়ায় সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা ও গবেষণা আজ কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তার একটা মূল চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি। শুধু তাই নয়। এ ধরনের গবেষণার প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষক সমাজের একাংশেরও যে সমর্থন আছে, সেটা সিনেট হলে উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং অন্যদের আচরণ থেকেও বোঝা যায়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, গবেষণা, সংস্কৃতি ইত্যাদির অবস্থা এখন কী ভয়াবহ চরিত্র পরিগ্রহ করেছে, তার পরিচয়ও এই কেলেংকারির মধ্যেই নিহিত আছে।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.