খোলা চোখে- খারাপ, তবে এতটা খারাপ? by হাসান ফেরদৌস

ছবিটা আপনাদের খুবই চেনা, তবু আলোচনার সুবিধার্থে তা আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক। বলছি দুটি রাজনৈতিক দলের কথা,

দেশের রাজনীতিতে যারা মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো ক্ষমতার কুর্সি দখল করে রেখেছে। একবার এই দল, অন্যবার ওই দল। এদের বাইরে অন্য কেউ যে ক্ষমতায় আসবে, তার কোনো সম্ভাবনা দূর ভবিষ্যতেও নেই, যদিও তৃতীয় পক্ষের কথা মাঝেমধ্যেই শোনা যায়। দল দুটির মধ্যে ক্ষমতা অপব্যবহারের ব্যাপারে কোনো বড় তফাতও নেই। সরু চিরুনি দিয়ে বাছাই করলে তাদের মধ্যে আদর্শগত প্রশ্নে তফাত চোখে পড়ে বটে, কিন্তু ক্ষমতার স্বার্থে যেকোনো আদর্শ জলাঞ্জলি দিতে কারোরই কোনো কার্পণ্য নেই। কোনো ব্যাপারেই এদের মত ও পথ এক হয় না। কী করে কার ঘাড়ে কুড়াল মারা যায়, এই একই ভাবনা দুই দলেরই। ফলে দেশ জাহান্নামে যাক, তাতেও কুছ পরোয়া নেই।
আপনারা ভাবছেন, আমি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কথা বলছি। মোটেই না, আমি বলছি আমেরিকার দুই প্রধান দল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও রিপাবলিকান পার্টির কথা। তাদের মধ্যে যে দা-কুমড়া সম্পর্ক, তার সঙ্গে আমাদের দুই প্রধান দলের মিল অবশ্যই আছে। তবে আমেরিকার ছবিটা বোধ হয় আরও খারাপ। অন্ততপক্ষে দুজন মার্কিন অধ্যাপক দীর্ঘদিনের গবেষণা শেষে এমন সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছেন।
ইট ইজ ওয়ার্স দ্যান ইউ থিঙ্ক, (বেসিক বুক, নিউইয়র্ক, ২০১২) নামে তাঁদের নতুন রাজনৈতিক গবেষণা গ্রন্থে টমাস মান ও নরমান ওরস্টিন জানাচ্ছেন, আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা একদম ভেঙে পড়েছে। দুই প্রধান দলের ক্রমাগত বৈরিতার ফলে দেশের আইনসভা অর্থাত্ কংগ্রেস কার্যত এখন অকেজো। আইন প্রণয়ন ও দেশ শাসনের বদলে এদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে একে অপরের সঙ্গে গুঁতোগুঁতি। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল হওয়ায় তাদের মধ্যে বৈরিতা আছে, থাকবে। দেড়-দুই দশক আগেও এই দুই দলের ভেতর দেশের স্বার্থের ব্যাপারে ন্যূনতম মতৈক্য ঠিকই ছিল। কংগ্রেসম্যান ও সিনেটরদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল। কিন্তু এখন, বিশেষ করে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে, সে সবই গেছে। কীভাবে ওবামা ও তাঁর রাজনৈতিক এজেন্ডা বানচাল করা যায়, এখন তারই চেষ্টা চলছে পদে পদে।
টমাস মান ও নরমান ওরস্টিন খোলামেলাভাবেই অভিযোগের তির ছুড়েছেন রিপাবলিকান পার্টির উদ্দেশে। তাঁদের মোদ্দা বক্তব্য, যেকোনো দেশের মতো আমেরিকায়ও সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু দলের সমস্যা রয়েছে। সংসদীয় ব্যবস্থায় ও প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে ক্ষমতার স্পষ্ট বিভক্তি রয়েছে। প্রশাসন, আইনসভা ও বিচার ব্যবস্থা—সরকারের এই তিন অঙ্গ সমান ক্ষমতার অধিকারী। একজনের ওপর অন্যজনের মত চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এই অধিকার-বিভাজন কার্যকর হওয়ার একটি পূর্বশর্ত হলো, রাষ্ট্রের এই তিন অঙ্গ পরিচালিত হবে সহযোগিতার ভিত্তিতে, পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভিত্তিতে নয়।
আমেরিকায় এখন এই সহযোগিতার মনোভাবটির স্থান নিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, এমনকি তাকে গুঁতোগুঁতি ছাড়া আর অন্য কিছু বলা কঠিন। এই দুই লেখকের আসল লক্ষ্য আমেরিকার আইনসভা। তাঁদের কথায়, কংগ্রেসে অর্থাত্ প্রতিনিধি পরিষদে ও সিনেটে, দুই দল আদর্শগতভাবে একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান নিয়েছে। কংগ্রেসে যে কক্ষে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা সংখ্যালঘুদের কোনো ব্যাপারেই বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়। কোনো নতুন আইন প্রস্তাব আকারে উত্থাপিত হলে সংখ্যালঘু দলের পক্ষ থেকে সংস্কার প্রস্তাব তার গুণাগুণ বিচারের বদলে সংখ্যাগুরু দলের কাছে তা বাতিল করাই ‘অগ্রাধিকার’ হয়ে পড়ে। ফলে আইন প্রণয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে কোনো প্রকৃত আলাপ-আলোচনা বা বিতর্ক অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাজেট বা বিচার বিভাগীয় নিয়োগের প্রশ্নে সিনেটে অন্ততপক্ষে ৬০ জন সদস্যের সমর্থন আদায়ের নিয়ম প্রচলিত আছে। আদর্শগত ভাগাভাগির এই যুগে ৬০ জন সিনেটর—যার মধ্যে আট-দশজন বিরোধী পক্ষের হতে হবে—কোনো প্রস্তাবের পক্ষে সম্মতি দেবে, সে প্রায় আকাশকুসুম কল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে, এমন অনেক প্রশ্ন আছে, যা নিয়ে উভয় দলেই অধিকাংশ সদস্যের কার্যত কোনো দ্বিমত নেই। এমন অনেক ব্যাপার আছে, যার প্রতি বিরোধী রিপাবলিকান দল, যখন তারা ক্ষমতায় ছিল, জোর সমর্থন জানিয়েছে। ওবামা ক্ষমতায় আসার পর তারাই এখন সে প্রশ্নে সম্পূর্ণ উল্টো অবস্থান নিয়েছে। লেখকদ্বয় একটি আগ্রহোদ্দীপক উদাহরণ দিয়েছেন। আমেরিকার অর্থনীতির একটি প্রধান সমস্যা বাজেট ঘাটতি, সে কথা মাথায় রেখে তিন বছরের আগে সিনেটের উভয় দলের সদস্যরা যৌথভাবে একটি ১৮ সদস্যের বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেছিলেন ডেমোক্র্যাট কেন্ট কনরাড ও রিপাবলিকান জাড গ্রেগ। খসড়া আইনটির সমর্থকদের মধ্যে ছিলেন রিপাবলিকান দলের দুই নেতা, সিনেটর জন ম্যাককেইন ও মিচ ম্যাককনেল। সে সময় সিনেটে বক্তব্য দিতে গিয়ে ম্যাককেইন বলেছিলেন, বাজেট ঘাটতি কমাতে হলে এ ছাড়া বিকল্প নেই। সেই একই প্রস্তাব যখন ভোটাভুটির জন্য রাখা হলো, দেখা হলো ম্যাককেইন ও ম্যাককনেলসহ রিপাবলিকান দলের সব সদস্য তাঁর বিরোধিতা করে ‘না’ ভোট দিয়েছেন। ফলে নিয়মমাফিক ৬০ ভোট না পাওয়ায় প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যাত হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে যাঁদের নাম সে প্রস্তাবের উত্থাপক হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছিল, দেখা গেল, তাঁরাই বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। কারণ? আর কিছুই নয়, প্রেসিডেন্ট ওবামা সে প্রস্তাবের পক্ষে তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন। খুব যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাব হলেও শুধু ওবামার বিপক্ষে দাঁড়ানোর জন্য রিপাবলিকান দলীয় সদস্যরা নিজেদের প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিলেন। সে সময় ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা মন্তব্য করেছিল, আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গলদের এর চেয়ে উত্তম উদাহরণ আর হতে পারে না।
আরও ভয়ের কথা, আদর্শগত বিরোধিতার কারণে আমেরিকার রাজনৈতিক দলসমূহ দেশের জন্য ক্ষতিকর ব্যবস্থা নিতেও পিছপা নয়। সরকারি ব্যয়ভার মেটানোর জন্য আমেরিকাকে বিদেশ থেকে টাকা ধার করতে হয়। দুই বছর আগে রিপাবলিকান দল বেঁকে বসল, তারা সরকারকে অতিরিক্ত ঋণ করার আইনগত সম্মতি দেবে না। টাঁকশালে টাকা না থাকলে সরকার চলবে না, ফলে আংশিকভাবে হলেও সরকারের কাজকর্ম বন্ধ হলো। তার চেয়েও বড় কথা, টাকা জোগাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে আমেরিকার ‘ক্রেডিট রেটিং’ কমে যায়, ফলে ধার করা অর্থের ওপর সুদের পরিমাণও বাড়ে। এর ফলে আমেরিকার মুখে যে চুনকালি পড়ল তা-ই নয়, তার মোট ঋণের বোঝাও বাড়ল।
বাজেট থেকে শুরু করে সরকারি ও বিচার বিভাগীয় পদে মনোনয়ন পর্যন্ত সব প্রশ্নে রিপাবলিকান দলের একগুঁয়ে বিরোধিতার ফল দাঁড়িয়েছে এই যে একদম মৌলিক প্রশ্নেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই ছাড়াই ওবামা প্রশাসনের পক্ষে নিজেদের দায়িত্ব পালন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিচার বিভাগের বিভিন্ন পদে ওবামা যেসব মনোনয়ন দিয়েছেন, সিনেটে রিপাবলিকানদের বিরোধিতার কারণে তাঁদের অনেকেই এখনো দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই, শুধু ওবামার বিরোধিতা করতে হবে, সে জন্যই বিরোধিতা করা।
বাংলাদেশের অবস্থা এর চেয়ে খুব ভিন্ন নয়। সেখানেও শুধু বিরোধিতা করার জন্যই বিরোধী পক্ষ আদা-জল খেয়ে ‘না না’ বলে চেঁচায়। শুধু চেঁচালে রক্ষে ছিল, বাংলাদেশে তারা আবার যখন-তখন হরতাল ডেকে বসে, নিজের দাবির যৌক্তিকতা প্রমাণে ভাড়া করা লোক দিয়ে হরতালের আগে গাড়ি-বাস পুড়িয়ে ত্রাসের সৃষ্টি করে। না, আমেরিকায় অবশ্য তেমন নষ্টামির উদাহরণ এখনো দেখিনি। আমাদের সাংসদেরা নিজেদের বিরোধিতা প্রমাণে বছরের পর বছর সংসদ বর্জন করে চলেন, কোনো ধিক্কারেও তাঁদের শির হেলে না। আমেরিকায় আইনসভার সদস্যরা একগুঁয়ে বটে, তাই বলে এমন একগুঁয়ে ও গোঁয়ার নন যে আইনসভার সদস্য হিসেবে নিজেদের বেতনের শেষ কড়িটা পর্যন্ত গুনে নেবেন,
কিন্তু আইনসভায় গিয়ে নিজের আসন গ্রহণ করবেন না। সেদিক দিয়ে আমাদের বিরোধী পক্ষের রেকর্ড আমেরিকার বিরোধী সাংসদদের চেয়েও খারাপ।

তাহলে এই বিষচক্র থেকে বেরোনোর পথ কী?
টমাস মান ও নরমান ওরস্টিন প্রস্তাব রেখেছেন, আমেরিকার ভোট-ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। মোট ভোটসংখ্যার ভিত্তিতে জয়-পরাজয় নির্ধারণের বদলে আনুপাতিক ভোট-ব্যবস্থা চালু করতে হবে। নির্বাচনী এলাকার কারসাজিতে জিতেও ঠকে যাওয়ার অভিজ্ঞতা শুধু আমেরিকায় কেন, বাংলাদেশেও আকছার ঘটছে। আমরা জানি, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে এমন ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে যে মোট সংখ্যার হিসাবে বেশি ভোট পাওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়েছে কোনো কোনো দল। কিন্তু আমেরিকা বা বাংলাদেশে চলতি নিয়ম বদলে আনুপাতিক ভোটের ব্যবস্থা চালু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে, এ কথা অতি-আশাবাদীও বলবেন না। নির্বাচনী এলাকা পুনর্গঠন, ভোটার তালিকা সম্প্রসারণ ও সরকারি তহবিল থেকে নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহের যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাব তাঁরা রেখেছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেসব প্রস্তাব ভাবা যেতে পারে। সবই খুব ভালো প্রস্তাব, কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার লোক মিলবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। রাজনৈতিক দল, তা আমেরিকায় হোক বা বাংলাদেশে, চিরকাল স্থিতাবস্থার পক্ষে। তারা সবচেয়ে বেশি ভয় করে পরিবর্তন, তা ভালো হোক বা মন্দ।
রাজনীতির পাঁকে দেশ যেভাবে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে, তা থেকে বাঁচানোর সবচেয়ে সম্ভবপর যে প্রস্তাবটি এই দুই লেখক রেখেছেন, তা হলো, দুই দলের চিহ্নিত ‘অপরাধী’ রাজনীতিকদের নামধামসহ সর্বসমক্ষে নিন্দা করার একটি প্রক্রিয়া উদ্ভাবন। তাঁদের যুক্তি, সমস্যা এত গভীর ও জটিল যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি না বদলালে এগোনো যাবে না। সংস্কৃতি এক দিনে বদলায় না, কিন্তু পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া যায় এখনই। তাঁদের প্রস্তাব, দেশের সবচেয়ে নামজাদা ও সম্মানিত ব্যক্তি যদি যৌথভাবে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ও ক্ষতিকর রাজনীতিকদের নাম ধরে ধরে তাঁদের সমালোচনা করেন, তাহলে সর্বসমক্ষে ‘নামকরণ ও নিন্দা’ জ্ঞাপনের একটি কার্যকর পথ নির্মাণ সম্ভব। এর ফলে জবাবদিহি বাড়বে, হয়তো সত্ লোক রাজনীতিতে প্রবেশে আগ্রহী হবে। সম্ভব হলে দেশের আইনসভার পাশাপাশি একটি ‘ছায়া আইনসভা’ নির্বাচনের কথাও ভাবা যেতে পারে। যে কাজ দেশের আইনসভা করতে অক্ষম, এই ছায়া আইনসভা সে কাজ করে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।
বাংলাদেশের বেলায়ও এই শেষ পথটির কথা আমরা ভাবতে পারি। এমন একদল লোক—যাঁরা দলীয় আনুগত্যের বাইরে উঠতে সক্ষম—তাঁরা যদি ন্যূনতম সম্মতির ভিত্তিতে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠনে সক্ষম হন, তাহলে আর কিছু না হোক, অহোরাত্রি স্যার বা ম্যাডাম বলা থামিয়ে আমরা চোরকে চোর বলা শিখব।
প্রিয় পাঠক, ক্ষমা করবেন। জানি, এ সবই অরণ্যে রোদন। কিন্তু কখনো কখনো কাঁদলেও বুকের ব্যথা কমে, সে জন্যই এই পাঁচালি।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.