চলচ্চিত্রে অনুদান- নেই মানসম্মত ছবি বাড়ছে অপচয় by গোলাম রাব্বানী

প্রতিবছরই চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুদান দিচ্ছে সরকার। কিন্তু অনুদানের অর্থে তৈরি হচ্ছে না মানসম্মত চলচ্চিত্র।
বছরে পর বছর যায় অনুদানের ছবির সংখ্যা বাড়ে কিন্তু সিনেমা হলে নতুন ছবির সংখ্যা বাড়ে না। দায়সারা গোছের এক একটা চলচ্চিত্র কোনরকমে তৈরি করে সরকারকে গছিয়ে দিয়ে উধাও হয়ে যায় নির্মাতারা।

শুধু তাই নয় নির্ধারিত সময়ে অনেকেই ছবি জমা দিতে পারেন না। বছরের পর বছর গেলও ছবি বানানো শেষ হয় না অনেক নির্মাতার। তাই ছবি বানানোর জন্য নয়, অনুদানের টাকা নিয়ে পকেট ভারী করার পাঁয়তারা থেকেই অনেকে নানা তদবির করে অনুদানের ছবির অনুমোদন পেয়ে যান।

সরকারি অনুদান প্রথার শুরুর দিকে ‘দহন’, ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’র মতো ছবি তৈরি হয়েছে। এরপর দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল সরকারি অনুদান। ২০০৭ সাল থেকে তিনটি ছবিকে অনুদান দেওয়া চালু করে সরকার। ২০১০ সালে এসে পাঁচটি ছবিকে অনুদান দেওয়া হয় এবং অনুদানের অর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে ২৫ থেকে ৩৫ লাখ টাকা করা হয়।

প্রত্যেকটি ছবির জন্য নির্মাণ বাবদ নগদ ৩৫ লাখ টাকা করে দেয়া হয়। এছাড়া এফডিসি থেকে প্রত্যেক নির্মাতা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের কারিগরি ও প্রয়োজনীয় সহায়তা নিতে পারেন। সব মিলিয়ে ৪৫ লাখ টাকা দিয়েও অনুদানপ্রাপ্ত পরিচালকরা সিনেমা নির্মাণ করতে পারেন না। তারা বলে থাকেন এই টাকায় ভালো সিনেমা হয় না। কিন্তু অনুদানের অধিকাংশ ছবিই দেখার উপযুক্ত হয় না। এর চেয়ে টেলিভিশনের নাটক অনেক ভালো।

এ পর্যন্ত অনুদানপ্রাপ্ত ছবির মধ্যে হাতেগোণা কয়েকটি ছবির কাজ শেষ হয়েছে। আবার অনেকগুলোর আংশিক চিত্রায়ন হয়ে আটকে আছে। আবার কয়েকটি ছবির চিত্রায়নই শুরু হয়নি। অথচ চুক্তি অনুসারে নয় মাসের মধ্যে প্রতিটি ছবির নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা থাকলে নির্ধারিত সময়ে ছবি শেষ করতে পারেন না নির্মাতারা।

অনুদানের নীতিমালায় যা আছে নির্মাতারা তা মেনে ছবি নির্মাণ করলে ভালো ছবি হতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। আর অনুদান দেওয়াই হয় ভালো ছবি নির্মাণের জন্য। কিন্তু দিন শেষে দর্শক ভালো ছবি পায় না। হতাশ হতে হয় অনুদানের  ছবি দেখে।

এর মাঝে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে কথা হয় একটি অনুদানের ছবির মহরত অনুষ্ঠানে। তিনি অনুদানের ছবি বিষয়ে বলেন ‘আমরা এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবো। সরকারি টাকা নিয়ে অপব্যবহার করা যাবে না।’
 
কথা হয় বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পীযূষ বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন ‘এ বিষয়ে আমরা নিয়মিত মনিটরিং করছি। যারা এখনো ছবি সময়মতো জমা দেননি তাদের নোটিশ করা হবে।’

২০০৮ সালের অনুদানের ছবিগুলোর মধ্যে মোরশেদুল ইসলামের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ও শাহাজাহান চৌধুরীর ‘মধুমতি’ মুক্তি পেয়েছে। একই বছর অনুদান পাওয়া জুনায়েদ হালিমের ‘স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের গল্প’ ছবির দৃশ্যধারণই হয়নি।

২০০৯ সালে ৬টি ছবিকে সরকারি অনুদান দেয়া হয়েছিলো। এর মাঝে আছে নাসির উদ্দীন ইউসুফের ‘গেরিলা’, আখতারুজ্জামানের ‘সূচনা রেখার দিকে’, কাজী মোরশেদের ‘একই বৃত্তে’, বেলাল আহমেদের ‘অনিশ্চিত যাত্রা’, শিশুতোষ চলচ্চিত্র সামিয়া জামানের ‘ছেলেটি’ ও সজল খালেদের ‘কাজলের দিনরাত্রি’। এর মধ্যে ‘গেরিলা’ ও  ‘কাজলের দিনরাত্রি’ ছবি দুটি মুক্তি পেয়েছে। বাকি ছবিগুলো আদৌ মুক্তি পাবে কিনা তার সঠিক উত্তর কারো জানা নেই।

২০১০-১১ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত ছবিগুলো হলো মানিক মানবিকের ‘শোভনের স্বাধীনতা’, মুরাদ পারভেজের ‘বৃহন্নলা’, পিএ কাজলের ‘মুক্তি’, সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে ফারুক হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’, নির্মলেন্দু গুণের গল্প অবলম্বনে মাসুদ পথিকের ‘নেকাব্বরে মহাপ্রয়াণ’ ও মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেনের ‘হরিজন’। এর মধ্যে একটি ছবিও এখনো মুক্তি পায়নি। প্রতিটা ছবিই ঝুলে আছে।

২০১১-১২ অর্থবছরে ছয়টি ছবিকে অনুদান দেওয়া হয়েছিলো। এর মধ্যে চারটি পূর্ণদৈর্ঘ্য, দুটি শিশুতোষ ছবি। পূর্ণদৈর্ঘ্য চারটি ছবি হল তানভীর মোকাম্মেলের ‘জীবন ঢুলী’, গাজী রাকায়েতের ‘মৃত্তিকা মায়া’, মারুফ হাসান আরমানের ‘নেকড়ে অরণ্যে’, দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘হেড মাস্টার’। শিশুতোষ দুটি ছবি হলো প্রশান্ত অধিকারীর ‘হাডসন এর বন্ধুক’, সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকীর ‘একা একা’।

সর্বশেষ ২০১২-১৩ অর্থবছরে সরকারি অনুদানের জন্য মনোনীত ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রয়াত তারেক মাসুদের গল্প ও চিত্রনাট্যে ও ক্যাথরিন মাসুদের পরিচালনায় ‘কাগজের ফুল’, প্রয়াত সেলিম আল দীনের ‘যৈবতী কন্যার মন’ অবলম্বনে নারগিস আক্তারের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায়-যৈবতী কন্যার মন, জাহিদুর রহমান অঞ্জনের গল্প, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ‘রেইন কোট’। হাসান আজিজুল হকের গল্প ও খান সরফুদ্দিন মোহাম্মদ আকরামের চিত্রনাট্য এবং পরিচালনায় ‘খাঁচা’, শহীদুল জহিরের গল্প ও টোকন ঠাকুরের চিত্রনাট্য এবং পরিচালনায় ‘কাঁটা’,আনিসুল হকের গল্প ও শাহ আলম কিরণের চিত্রনাট্য এবং পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের গল্প অবলম্বনে ‘একাত্তরের মা জননী’ এবং মান্নান হীরার গল্প, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় শিশুতোষ ছবি ‘একাত্তরের ক্ষুদিরাম’।

এ ছবিগুলোও কি নির্ধারিত সময়ে শুটিং শেষ করে সরকারকে জমা দিতে পারবে কি না। সে সংশয় থেকেই যায়।

কথা হয় নির্মাতা মানিক মানবিকের সঙ্গে। তিনি বলেন ‘আমার ছবিটা নানা কারণেই দেরি হয়েছে। তার মধ্যে বড় একটা ঝামেলা করেছে একজন শিল্পী। তার সিডিউল ঝামেলার কারণে দেরি হয়েছে কাজটা শেষ করতে। আমার কাজ শেষ এখন সেন্সরে জমা দিবো।’

কথা হয় নির্মাতা প্রশান্ত অধিকারীর সঙ্গে। তিনি বলেন ‘দেশের বাইরের একজন শিল্পী নিয়ে কাজ করার কথা ছিলো আমার। তার জন্যই দেরিটা হয়েছে। তবে ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে আমি শুটিং শুরু করতে যাচ্ছি’।

মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেন বলেন ‘আমার হরিজন ছবিটির কাজ শেষ। সেন্সরও পেয়েছে। কিন্তু আমি ছবিটি মুক্তি দেওয়ার জন্য হল পাচ্ছি না।’

অন্যদিকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী শিশুতোষ চলচ্চিত্রকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ২০১০ সালে ৪ জন নির্মাতাকে অনুদান দিয়েছিলো। প্রত্যেক নির্মাতা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুদান পান। প্রতিটি চলচ্চিত্র সময়কাল হবে ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটি। অনুদান পেয়েছিলেন প্রয়াত বাদল রহমান (বঙ্গবন্ধুর ছোট বেলা), ছটকু আহমেদ (জন্মজয়ন্তী), মান্নান হীরা (গরম ভাতের গল্প) ও সরোয়ার তমিজউদ্দিন (লাবু এলো শহরে)। এ ছবিগুলোরও হাল এখন বেহাল অবস্থা।

সরকার যদি অনুদানের ছবি বিষয়ে সঠিক মনিটরিং ও তদারকি না করে তাহলে প্রতি বছরই অনুদান  দেওয়া হবে নির্মাতাদের। আর প্রতিবছরই নতুন পাঁচ ছয়জন করে নির্মাতার পকেট ভারী হবে কিন্তু ভালো সিনেমাপ্রাপ্তি ঘটবে না দর্শকদের। সরকারের টাকার অপচয়ই শুধু বেড়ে চলবে দিন দিন।

No comments

Powered by Blogger.