ঐশীর বক্তব্যে বিভ্রান্তি- তিন খুনি নিয়ে রহস্য by নূরুজ্জামান

ঐশীর বক্তব্য নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। পুলিশ দম্পতি হত্যাকাণ্ডে ঐশীসহ তিন খুনির তথ্য মেলাতে পারছেন না তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারা। ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের সাত দিন পেরিয়ে গেছে গতকাল।
এখন পর্যন্ত সন্দেহভাজন ঐশীর দুই বয়ফ্রেন্ডকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তাদের ধরতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তদন্তকারী গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার করতে না পারলেও হত্যা রহস্যের অনেকটাই উদঘাটন করেছেন তারা। গতকাল পর্যন্ত পুলিশ নিশ্চিত হয়েছেন, পিতা-মাতার প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ থেকে ঐশী রহমান একাই নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। যদিও গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী নানারকম অসংলগ্ন তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। প্রথমে সে বলেছিল- বয়ফ্রেন্ড জনির কাছ থেকে ঘুমের ওষুধ পেয়েছিল। পরে বলেছে, সে নিজেই শান্তিনগরের একটি ওষুধের দোকান থেকে ১০টি নাইট্যাচ ট্যাবলেট কিনেছে। তদন্ত সূত্রমতে, পিতা-মাতার হত্যাকাণ্ডে ঐশী নিজের সম্পৃক্ততার পাশাপাশি আরও দুই বয়ফ্রেন্ডের যে তথ্য দিয়েছিল তার সত্যতা খুঁজে পাননি তারা। গত দু’দিনে হত্যাকাণ্ডস্থল চামেলীবাগের ওই ফ্ল্যাটে ঐশীকে নিয়ে দু’দফায় পরিদর্শন করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। ঘটনাস্থলে ঐশীকে আবারও হাজির করে তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানতে চেয়েছেন, কোথায় গাড়ি রেখেছিল তার দুই বয়ফ্রেন্ড। তারা লুকিয়েছিল কোথায়। তখন বাসার কাজের মেয়ে সুমি ও তার ছোট ভাই ঐহী কোথায় ছিল। তারা কি করছিল। গোপনে দু’জনকে বাসায় ঢোকানোর পর তাদের কেউ দেখেছিল কিনা। হত্যাকাণ্ডে তারা তিনজন অংশগ্রহণ করলে হত্যাকাণ্ডে কেন একটি ছুরির ব্যবহার হয়েছে? তিন খুনি উপস্থিত থাকার পরও কেন ঘুমন্ত কাজের মেয়েকে ডেকে তুলেছিল সে? কেনই বা তাকে সঙ্গে নিয়ে তার পিতা-মাতার রক্ত পরিষ্কার করা হয়েছে? দুই বয়ফ্রেন্ড উপস্থিত থাকতে কেন কাজের মেয়েকে নিয়ে লাশ সরিয়েছে? তখন  তার দুই বয়ফ্রেন্ড কোথায় ছিল? গোয়েন্দা পুলিশের এসব প্রশ্নের উত্তরে ঐশী এলোমেলো ও অসংলগ্ন জবাব দিয়েছে। এসময় গোয়েন্দা পুলিশ কাজের মেয়ে সুমি ও ঐশীকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। ঐশীর সামনে সুমি জানায়, আপু ভয় দেখিয়েছিল আমাকে। মাথায় হাত রেখে কসম কেটে বলেছিল, হত্যার কথা কাউকে বললে আমার মা মারা যাবে। তবে হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে বাসায় অপরিচিত কাউকে দেখেনি সে। তার বক্তব্যের সময় ঐশী নীরব থাকে। এর আগে রিমান্ডে গোয়েন্দা পুলিশের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের মুখে ঐশী দাবি করে বুধবার রাতে  হত্যাকাণ্ডে তার আরও দুই বয়ফ্রেন্ড সহযোগিতা করেছিল। তারা হচ্ছে জনি ও সাইদুল। হত্যাকাণ্ডের রাত ৯টার দিকে তারা গাড়ি নিয়ে বাসার গ্যারেজে প্রবেশ করে। গোপনে তাদের ষষ্ঠ তলার ফ্ল্যাটে ঢুকে গেস্টরুমের বাথরুমে লুকিয়ে থাকে। তার আগেই সন্ধ্যা ৭টার দিকে মা স্বপ্না রহমানকে ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত কফি খাইয়ে অচেতন করে রাখে। রাত ১০টার দিকে মায়ের মোবাইল ফোন দিয়ে বাবাকে ২-৩ বার কল করে। কখন বাসায় ফিরবে জানতে চায়। পরে রাত ১০টার পর বাবা বাসায় ফেরেন। মাকে ড্রয়িং রুমে পাটিতে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে জাগানোর চেষ্টা করেন। না উঠলে তাকে ধরাধরি করে বেডরুমের বিছানায় শুইয়ে দেন। তার পাশে ছোট ভাই ঐহী ঘুমিয়ে পড়ে। ঐশী আরও জানায়, সে বরবটি ভাজি করেছিল। তাই দিয়ে তার বাবা ভাত খান। এরপর তাকে কফি খেতে বলেন। বাবা খেতে না চাইলে ঐশী বলে, আমি নিজে কফি তৈরি করেছি। মাকে খাইয়েছি। তোমার জন্যও রেখেছি। গরম করে দিচ্ছি। তখন বাবা ওই কফি খেয়ে তার রুমে তার সঙ্গে গল্প করতে থাকেন। এর ১৫ মিনিটের মধ্যেই ঘুমের ঘোরে তার বিছানায় ঢলে পড়েন। এরপর ঐশী ড্রয়িং রুমে গিয়ে টিভি দেখতে থাকে। তখন তার সঙ্গে কাজের মেয়ে সুমি ছিল। একপর্যায়ে সুমি ঘুমিয়ে পড়লে বাথরুমে লুকিয়ে থাকা দুই বয়ফ্রেন্ড বের হয়ে আসে। রাত ৩টার দিকে ঘুমন্ত মাকে ঐশী নিজেই আঘাত করে। একই সময়ে তার বয়ফ্রেন্ডরা তার পিতাকে হত্যা করে। ঐশীর আরও দাবি- সে পিতার হত্যাকাণ্ড দেখেনি। বন্ধুরাই তাকে মেরেছে। পরে কাজের মেয়েকে ঘুম থেকে উঠিয়ে রক্ত পরিষ্কার করেছে। বিছানার চাদর দিয়ে দু’জনের লাশ মুড়িয়ে টেনে বাথরুমে ফেলে রেখেছে। এসময় তার বন্ধুরা অলঙ্কার, নগদ টাকা, বিদেশী মুদ্রা ও কাপড়-চোপড় দু’টি ব্যাগে ভরতে থাকে। ভোর হওয়ার পর সকাল ৮টার দিকে ছোট ভাই ও কাজের মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। দুই বয়ফ্রেন্ড গাড়ি নিয়ে এলেও সে আলাদা সিএনজি ভাড়া করে চলে যায়। তারা বের হওয়ার প্রায় আধ ঘণ্টা পর বয়ফ্রেন্ডরা বেরিয়ে যায় বলে ঐশীর দাবি। তবে ঐশীর এ বক্তব্য গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেননি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ঐশীর বক্তব্য সত্য বলে ধরে নিলে অসংখ্য প্রশ্ন তৈরি হয়। যার একটিরও সঠিক জবাব পাওয়া যায়নি তার কাছ থেকে। একেক সময় একেক রকম তথ্য দিয়ে সে পুলিশকে বিভ্রান্ত করেছে।
ঘুমের ওষুধ কিনেছিল ঐশী: অব্যাহত জিজ্ঞাসাবাদের মুখে ঐশী একপর্যায়ে স্বীকার করেছে, সে নিজেই শান্তিবাগের একটি ওষুধের ফার্মেসি থেকে ১০টি ঘুমের ট্যাবলেট নাইট্যাচ কিনেছিল। পরে গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম তাকে নিয়ে ওই দোকানে যায়। সেখানে গিয়ে ঐশীর বক্তব্য মিলিয়ে দোকানের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যান। সূত্রমতে, ঐশীর কাছে একসঙ্গে ১০টি ঘুমের ওষুধ সরবরাহের কারণ জানতেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আটককৃতরা জানিয়েছে, ঐশীর কাছে ঘুমের ওষুধের প্রেসক্রিপশন ছিল। তা দেখেই ওষুধ বিক্রি করেছেন তারা। তবে ঐশী ওই প্রেসক্রিপশন  কোথায় পেয়েছিল অথবা প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ পেয়েছিল কিনা তা খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা পুলিশ। যদিও ঐশী প্রথম দিকে গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে দাবি করেছিল, তার বয়ফ্রেন্ড জনির মাধ্যমে ওই ট্যাবলেট সংগ্রহ করেছিল।
কাল আদালতে নেয়া হচ্ছে: ৫ দিনের রিমান্ড শেষে আগামীকাল শনিবার ঐশী, কাজের মেয়ে সুমি ও মিজানুর রহমান রনিকে আদালতে হাজির করা হবে। সূত্রমতে, গ্রেপ্তারকৃতরা আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার কথা রয়েছে। অন্যথায় আদালতে ঐশী ও কাজের মেয়ে সুমিকে ফের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করা হবে।
আতঙ্কিত ঐহী: মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন নিহত পুলিশ দম্পতির ছোট ছেলে  ও তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী ঐহী রহমান (৮)। ঘনিষ্ঠ স্বজন ও পুলিশের যৌথ হেফাজতে রাখা হয়েছে তাকে। সূত্রমতে, হত্যাকাণ্ডের রাতে মাকে খুনের সময় সে জেগে উঠেছিল। এসময় ঐশী রক্তাক্ত ছুরি হাতে তাকে জাপটে ধরে বাথরুমে নিয়ে যায়। তখন তার শরীরে ছুরির ঘা লেগেছিল। এতে তার তার পিঠের উপরের দিক কেটে যায়। সূত্র আরও জানায়, ধস্তাধস্তি ও মায়ের গোঙানিতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর সে খুনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঐশী তাকে সরিয়ে নেয়ায় ঠিকমতো কিছু বলতে পারছে না। ওই রাতের ঘটনা মনে করার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এ জন্য খুবই সতর্কতা অবলম্বন করে তার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তার বাবা-মা আর বেঁচে নেই- এই তথ্য ধীরে ধীরে জানানোর চেষ্টা করছেন তারা।
বয়ফ্রেন্ডের খোঁজে অভিযান: এদিকে পলাতক দুই বয়ফ্রেন্ড জনি ও সাইদুলকে গ্রেপ্তার করার জন্য রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরে পুলিশের একাধিক টিম অভিযান পরিচালনা শুরু করেছে। সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার এড়াতে তারা মোবাইল ফোন ও ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইসের ব্যবহার বন্ধ রেখেছে। ঘন ঘন জায়গা বদল করছে। গোয়েন্দা তথ্যমতে তারা দু’জনেই ঢাকার বাইরে আত্মগোপন করে আছে। সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে বাইরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। দেশের বাইরে যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য সীমান্তবর্তী এলাকাসহ পুলিশের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের নজরদারির নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.