তন্দুর নাইট

‘এসেছে এসেছে’, এই কথা বলে প্রাণ,
‘এসেছে এসেছে’ উঠিতেছে এই গান-
নয়নে এসেছে, হৃদয়ে এসেছে ধেয়ে। (রবিঠাকুর)

শ্রাবণের শেষ বিকেলে ধুম বৃষ্টি। বৃষ্টি নেমেছে শহর ছেয়ে, যেন ধারাজলে সুর লাগিয়ে। নির্জন পূর্ণদাস রোডের একটা বিষণ্ণ দেবদারু গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ঝর ঝর বাদলের ধারাপাত দেখছি দু’জন। দেখছি অদূরে লেকের ধারে বনের মাথায় কেমন করে গাইছে আকাশ। দেখছি, হাওয়া কেমন করে পাতায় পাতায় মর্মরিয়া বনকে কাঁদায়। একসময় ভিজল, ভিজল বিষণ্ণ দেবদারু-ও। ভিজে একসা! দেবদারুর পাতা টুপিয়ে বৃষ্টি পড়ল রঞ্জার ঠোঁটে!

দুপুর গড়িয়ে, নিশিঠেকের জন্য যখন ঘর থেকে পথে নামবার তোড়জোড় করছি, ঠিক সেই তখনই রঞ্জা মেঘ-বৃষ্টির কথা বলেছিল। আর এখন, যোধপুর পার্ক ডাকঘরের ঠিক উল্টোদিকে, ২৮/৪ গড়িয়াহাট রোডের তন্দুর পার্ক যাব বলে বেরিয়ে সেই বৃষ্টির গহনে। কিন্তু এত পথ থাকতে, পূর্ণদাস কেন? কেন না, এই পূর্ণদাস রোডে-ই ফকির রঞ্জার প্রেমে পড়ে প্রথম। সেই কারণেই বার বার এই নিভৃত পথে ফিরে আসি দু’জন।

- এইখানে এসে প্রেম শেষ হল। শরীর মরেছে।/ তোমার হাত ধরে আমি দাঁড়িয়েছি বৃষ্টির ভিতরে/ গাছ থেকে জল পড়ছে. বৃষ্টিছাট ছুটে আসছে গা-য়… কার লেখা? ফকির জানো পরের লাইনগুলো?

- কার আবার! জয় গোসাঁই। কাব্যের নাম ‘বিষাদ’। ঠিক পরের লাইন… ‘ভিজে যাবে’- তুমি বলছ, ‘সরে এসো ছাতার তলায়’/ আমাদের একটাই ছাতা। তাতে দুজনেরই চলে যায়’।

- এ মা! থামলে কেন? এখানে কিন্তু শেষ নয়। শেষের আরও বাকি। অন্তত দুটো লাইন বাকি। ভুলে গেলে তুমি?

- না, না ভুলিনি… ‘বিষাদ’-এর বৃষ্টি নিয়ে অন্য একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে। বোধহয় তার সঙ্গে গুলোচ্ছি। কী যেন… আরও কালো করে এল… আরও কালো করে…

- আরও কালো করে এল, গাছে ডানা ঝাপটায়।/ দুজনে দাঁড়িয়ে আছি। দুজনে দাঁড়িয়ে থাকব। যতদিন পাশে থাকা যায়।

জয় শেষ করে রঞ্জা দূর মেঘপুঞ্জের দিকে উদাস চেয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। একসময় হাতের রিফারটা সুখটানে ফুরিয়ে ছুঁড়ে দিল বৃষ্টির ভিতর। ওর নেশা চোখ এখন রাস্তার দিকে ফেরানো। জলের ওপর জল পড়া দেখছে মেয়ে। খোলা নয়, ওর চুল আজ বাঁধা উঁচু করে পনি টেলে। একটা টর্ন জিনসের ওপর লাল চেক শার্ট পড়েছে ও। আর জামার হাতা গুলো স্ট্র্যাপ দিয়ে গোটানো। হাতঘড়ির কালো লেদার স্ট্র্যাপ ছুঁয়ে আছে রিস্ট ব্যান্ডের নিলচে মল্লার বন্দিশ। টোনড জিনসে বেশ লাগছে তো ওকে। শরীর সংলিপ্ত এই জিনসের পাশে বেশিক্ষণ থাকা দায়! একটু আগে যখন বৃষ্টি পড়ল ওর ঠোঁটে, তখনই দেখেছিলাম ঠোঁটের চেরি গ্লস কালারটা। ফের দেখলাম, টোনড জিনস আর শার্টের সঙ্গে ঝিঙ্কু মানিয়েছে। ঝিলমিল চুলের হাইলাইটসে বৃষ্টির গুঁড়ো লেগে ওকে মোহময়ী করে তুলেছে দিব্য! শার্টের সেকেন্ড বাটন খোলা!

বৃষ্টি ভিজে দেবদারু গাছের গা থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ উঠছে। ভিজে সেই গন্ধে দারুণ এক শিরশিরানি অনুভব। মাথার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে গন্ধটা। স্মৃতি থেকে উঠে আসছে দেখা-না-দেখায় ওর অতল।

- কেন হঠাৎ তন্দুর পার্কে নিশি-যাবে বলো তো?

রঞ্জার কথায় ওর রূপনগর থেকে ফিরলাম। অপলক দেখছিলাম। যেমন ফকির দেখে; আলো বা নিকষ কালো অন্ধকারে। কিন্তু কতক্ষণ দেখছিলাম, কে জানে! অনেকক্ষণ? মুগ্ধতা সরিয়ে, উত্তরে মৌন না থেকে বললাম,

- তোমাদের যাদবপুরিয়ানদের তো একসময়ের অত্যন্ত পছন্দের হ্যাং-আউটের জায়গা ছিল তন্দুর পার্ক!

- সে ছিল। ও তো রঞ্জার নিজস্ব ঠেক। কিন্তু এখন ভাল লাগে না ফকির, বিশ্বাস কর। নিচেতে তো বসতেই পারি না। সিঁড়ি দিয়ে উঠে সেলার সংলগ্ন চাতালেও নয়। চাতালের বাঁ-দিকের কোটরে নিভৃতি খুঁজি এখন।

বৃষ্টি ঝেঁপে এল আবার। হাওয়ার মাতনে বৃষ্টিধারা ভিজিয়ে দিচ্ছে দু’জনকেই। এই ধুম বৃষ্টিতে চারপাশ কেমন ওয়াশে আঁকা ল্যান্ডস্কেপের মতো সুন্দর। বৃষ্টি স্নাত যেন জাদুনগর। বুকের গহনে রঞ্জা সরে এল। ওর চিবুকের তিলে, চোখে, ঠোঁটে চুমো খেতেই ছটফটিয়ে উঠল মেয়ে! আমার পাঞ্জাবির বুকে চন্দনের বোতামে নাক ডুবিয়ে ফিসফিসিয়ে শঙ্খ ঘোষ বলল,

- ঘুম থেকে উঠে দেখি/ সমস্ত শরীর জুড়ে ধারালো দাঁতের দাগ/ সেপটিক হয়ে যেতে পারে।/ আমি শুধু ভেবে যাচ্ছি জুঁই।

- এমনি করে জড়াচ্ছিস! কেন এলি, পালাবি যখন?

জানি এই কথার পর রঞ্জা ঠিক কথা এড়াবে। ঠিক এড়ালও। চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল মেয়ে। একটুক্ষণ নৈঃশব্দ। নেমে এল উটের গ্রীবার মতো সেই খ্যাত নিস্তব্ধতা দু’জনের মাঝে। কেবল স্বগতোক্তির ঢঙে বলল,

- যতদিন পাশে থাকা যায়।

তারপর বুক থেকে মাথা তুলে বলল,

- ওদের সেলারটা খুব সু্ন্দর জানো? তুলনামূলক ভাবে খাবারের দাম কম। ড্রিংকসের গড়পড়তা একই দাম। না হলে কলেজ-কেটে লোকজন কেন যাবে বলো। এখন অবশ্য হ্যাং-আউটের নানা ঠেক, নানা ফিকির।

- শুনেছি চাইনিজ আর নর্থ ইন্ডিয়ান- দুটোতেই সুনাম রয়েছে। মশালা কুলচা, চিকেন হরিয়ালি, মটন শিক কাবাব, ভুনা গোস্ত- সবই নাকি জবরদস্ত!

- ফকির, তুমি তো রঞ্জার পছন্দের ডিশটাই বললে না.. সেটা ওখানেই মেলে। এবং সেটা এই বৃষ্টি ভেজার মরশুমে তোমাকে খাওয়াব আজ।

- কোনটা বলো, কাবাব? কাবাবের কথা বললাম যে?

No comments

Powered by Blogger.