এরদোয়ানবিরোধী আন্দোলন এবং তুর্কি গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ by মুহাম্মদ রুহুল আমীন

ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক গেজি পার্ক ও তাকসিম চত্বরের আংশিক ধ্বংস করে বিপণিকেন্দ্র ও সামরিক ব্যারাক নির্মাণ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে গত ৩১ মে শুক্রবার তুরস্কে যে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়, তা এক সপ্তাহের মধ্যে ইস্তাম্বুলসহ বড় শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।
সাম্প্রতিক এ বিদ্রোহ-বিক্ষোভের বাহ্যিক প্রকাশ নিছক পরিবেশবাদী আন্দোলনের মুখোশে আবৃত থাকলেও এর অভ্যন্তরীণ লুক্কায়িত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো, গুল-এরদোয়ান সরকারসহ নবোদিত তুর্কি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন ঘটানো।
গত ৩১ মে শুরু হওয়া পরিবেশ আন্দোলনটি প্রচণ্ড বিক্ষোভে বিস্ফোরিত হয়ে ৪ ও ৫ জুনের মধ্যেই স্মরণকালের ইতিহাসে সরকারবিরোধী সর্ববৃহৎ গণজমায়েতে পরিণত হয়েছে।
তাকসিম বিক্ষোভের আগে থেকেই তুরস্কের বর্তমান সরকারের কিছু নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল বিশেষত সেক্যুলার, বাম ও পাশ্চাত্যানুসারীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান এবং তাঁর সুবিচার ও উন্নয়ন দল (একেপি) নিয়ন্ত্রিত তুর্কি পার্লামেন্ট সম্প্রতি প্রকাশ্য জনসমাগমস্থলে মদ্যপানের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। যদিও এখনো পর্যন্ত মদ্যপানবিরোধী আইন বাস্তবায়িত হয়নি, তথাপি এ উদ্যোগ এরদোয়ানবিরোধীদের মনোযাতনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা মদবিরোধী উদ্যোগটিকে তুরস্ক সরকারের 'সাংস্কৃতিক যুদ্ধ' (cultural war) হিসেবে আখ্যায়িত করে এর বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেন। তাঁদের অনেকে চরম ঔদ্ধত্যে এমনও মন্তব্য করেন যে 'মদ্যপান যদি পাপই হয়ে থাকে, তাহলে আমিই সেই পাপটি শুরু করতে চাই, এতে সরকার আমাদের পাপ না করতে বাধ্য করতে পারে না। পাপ করা বা না-করার অধিকার আমাদের রয়েছে।'
সেক্যুলার, বাম ও পাশ্চাত্যানুসারীদের আরেকটি বিরোধিতার প্রেক্ষাপট রচিত হয় এরদোয়ান সরকারের 'তিন সন্তান নীতি' প্রণয়নে। প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ান তাঁর সারা জাগানিয়া 'জাতীয় বক্তব্যে' মহান তুর্কি জনগণের সংখ্যা বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রত্যেক তুর্কি রমণীর উচিত কমপক্ষে তিনটি সন্তানের জননী হিসেবে নিজেকে গৌরবান্বিত করা। এ ক্ষেত্রে এরদোয়ান সরকারের জন্মনিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত নীতিতে গর্ভপাত শীর্ষক নীতি সবচেয়ে বেশি আপত্তিকর হিসেবে দ্রোহের জন্ম দিয়েছে। তুরস্কের জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থায় গর্ভপাত সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলে বিরোধীরা নারীর গর্ভধারণের এবং জরায়ুর স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে বলে সমালোচনা করে আসছেন। যদিও এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি, তথাপি সরকারের বিরুদ্ধে সমন্বিত বিষোদগারের উল্লম্ফন চলছে। আগে থেকেই সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা, শিল্পকর্ম ও শিল্পীর স্বাধীনতা এবং বিদ্রোহ, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের স্বাধীনতার প্রতি সরকারি রক্ষানীতির বিরুদ্ধে যে ধূমায়িত আগ্নেয়গিরি বিরোধী মন, মনন ও মানসে প্রোথিত ছিল, সাম্প্রতিক বিক্ষোভ-প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে তার অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছে।
ইতিমধ্যেই এরদোয়ান সরকার প্রস্তাবিত শাসনতান্ত্রিক পুনর্বিন্যাস বাস্তবায়নে বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দিদের আস্থায় নিয়েছেন। কুর্দি আন্দোলনের আইন শাখাকে (legislative wing) সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির অনুজ সদস্য (junior) হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অধিকন্তু শ্রুত আছে যে কুর্দি বিদ্রোহী নেতা আবদুল্লাহ ওকালানের মুক্তিসহ কিছু আঞ্চলিক ও সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানে এরদোয়ান ওকালানকে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
এরদোয়ানবিরোধী আন্দোলন খুব অল্প সময়ে এত বেশি বিস্তৃতি লাভ করেছে যে তা অবজ্ঞা করার পর্যায়ে নেই। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এরদোয়ানের নিজ দলের কিছু প্রভাবশালী রাজনীতিক ও গোষ্ঠী তাঁর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। এমনকি সাম্প্রতিক বিক্ষোভ দমনের কৌশল নিয়ে তাঁর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলের দূরত্ব বেড়েই চলেছে প্রতিনিয়ত। ৫ জুনের বিবিসির বিশ্লেষণে এরদোয়ান-গুল টানাপড়েনের প্রকাশ্য রূপ আলোচিত হয়েছে। আগামী বছর তুরস্কে প্রথমবারের মতো সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যতই নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে, ততই দুই সাবেক জোটের নেতা গুল ও এরদোয়ানের মধ্যে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা নিয়ে মতপার্থক্য স্পষ্ট রূপ নিচ্ছে।
এরদোয়ানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার সেক্যুলার ও বামপন্থী রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা। চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে ৪ জুন দুই দিনের ধর্মঘট আহ্বান করে বামপন্থী ১১টি শ্রমিক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ট্রেড ইউনিয়ন জোট। বিক্ষোভকারী অন্যতম সংগঠন তাকসিম সলিডারিটির সদস্যরা আংকারা, ইস্তাম্বুলসহ অন্যান্য শহরে বিক্ষোভ-বিদ্রোহ এমনভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা এরদোয়ানবিরোধী মহলকে শক্তিশালী করছে।
এরদোয়ানবিরোধী আন্দোলন তুরস্কের রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে যাচ্ছে বলে অনুমিত হচ্ছে। ১৯২৩ সালে অটোম্যান সাম্রাজ্য বা ওসমানীয় খিলাফত বিলুপ্ত করে কামাল পাশার নেতৃত্বে যে সেক্যুলার তুরস্কের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা একেপি এবং এরদোয়ানের নেতৃত্বে বর্তমান প্রশাসনের দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সাম্প্রতিক এরদোয়ানবিরোধী আন্দোলন ইতিহাসের সেই অধ্যায়ের পুনরাবর্তন চায়। অসাধারণ জনপ্রিয় এরদোয়ান সরকার সাম্প্রতিক বিদ্রোহ-বিক্ষোভে কঠোর নীতি অনুসরণে বিরত থেকে যদি গণমানুষের উৎকণ্ঠার জায়গাটি চিহ্নিত করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ (Majority) মানুষের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি প্রাধিকার ও অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে হয়তো তুরস্কের নব-উদিত গণতান্ত্রিক কাঠামো শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম হবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
mramin68@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.