বাজেট নিয়ে কিছু কথা by ড. বদিউল আলম মজুমদার

আমাদের অর্থমন্ত্রী পঞ্চমবারের মতো সংসদে বাজেট প্রস্তাব করেছেন। এ জন্য শুরুতেই তাঁকে অভিনন্দন জানাই। কিন্তু তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, প্রতিটি বাজেটই তাঁকে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে উত্থাপন করতে হয়েছে।
এ ব্যাপারে আমাদেরও তো অসন্তোষ প্রকাশ করার যথেষ্ট কারণ আছে। বিরোধী দলের অনুপস্থিতি আর অর্থমন্ত্রীর আক্ষেপের ভেতর দিয়ে এটা সুস্পষ্ট যে আমাদের সংসদ গত পাঁচ বছর কার্যকর ছিল না। বিরোধী দল সংসদে অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু তাদের সংসদে ফেরানোর জন্য সরকারি দলের পক্ষ থেকে খুব একটা কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে আমাদের মনে হয় না।
এবার সংসদে যে বাজেট পেশ করা হয়েছে, সেটা বেশ বড় অঙ্কের বাজেট। দুই লাখ ২৯ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা এই বাজেটের আকার। নানাজন নানাভাবে এটাকে বিশ্লেষণ করছেন। কারো মতে এটা উচ্চাভিলাষী বাজেট, কারো মতে জনতুষ্টির। গরিব মারার বাজেটও হয়তো আখ্যায়িত করবে কেউ। সরকারের শেষ বছরে এসে বলা হচ্ছে, এটা নির্বাচনী বাজেট। বাজেটের সঙ্গে বিভিন্ন বিশেষণ যুক্ত হয়েছে বা হচ্ছে। আমি বাজেটকে দেখি একটা অগ্রাধিকার দলিল হিসেবে। বাজেট নিয়ে অনেক বিতর্ক আমি শুনছি। যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। যে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে, তা অর্জন করা সম্ভব হবে না- এমন অনেক কথা বলা হচ্ছে। আরো আছে। মূল্যস্ফীতি বা মুদ্রাস্ফীতি কতটুকু হবে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি কত শতাংশ হবে- আমার মতে এগুলো হচ্ছে গণকের কাজ। এসব বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে হলে আমাদের গণক হতে হবে। আমি বাজেটকে অন্যভাবে দেখতে চাই। আমি দেখতে চাই, বাজেটে অগ্রাধিকারের প্রতিফলন ঘটেছে কি না। বর্তমান সরকারের কতগুলো সুস্পষ্ট অগ্রাধিকার আছে। আমার যত দূর মনে পড়ে, দিন বদলের সনদের ২৩টি অগ্রাধিকার চিহ্নিত করা হয়েছে। তার মধ্যে পাঁচটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল বা সহনশীল পর্যায়ে রাখা। ছিল দুর্নীতি দূর করা। সুশাসন প্রতিষ্ঠাও এই সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। বিদ্যুৎ ছিল একটি অগ্রাধিকার। আরো ছিল 'দারিদ্র্য ঘোচাও ও বৈষম্য রোখো'। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার হাচ্ছে স্থানীয় সরকার। এসব অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাজেটটা প্রণীত হয়েছে কি না সেটাই হচ্ছে বিবেচ্য বিষয়।
বাজেটে এসব অগ্রাধিকার গুরুত্ব পেয়েছে, তা আমি মনে করতে পারি না। আমার সন্দেহ হয়। কারণ আমাদের বাজেট একটা ছকের মধ্যে আটকে গেছে। বাজেটের কতগুলো নির্দিষ্ট খাত আছে। এই খাতে প্রতিবছর যোগ-বিয়োগ করা হয়। কিছু পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়। কদাচিৎ দু-একটা খাত বাড়ানো হয়। বাদ দেওয়া হয় না বললেই চলে। এভাবেই যোগ-বিয়োগ করে গতানুগতিক, সনাতন বাজেট হয় আমাদের এখানে। আর এভাবে বাজেট হলে কোনোভাবেই তাতে অগ্রাধিকারের প্রতিফলন ঘটে না। বাজেটে অগ্রাধিকারের প্রতিফলন ঘটাতে হলে আমাদের বাজেট বিন্যাসকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। বাজেট বরাদ্দের খাতগুলোকেও নতুন করে বিন্যাস করতে হবে। দুর্ভাগ্য হলো, কোনো সরকারই এই কাজটি করেনি। প্রস্তাবিত নতুন বাজেটকে উচ্চাভিলাষী, নির্বাচনমুখী, জনতুষ্টির বাজেট- যা-ই বলা হোক না কেন, এটা গতানুগতিক ও সনাতন। এতে কোনো নতুনত্ব নেই। আমি মনে করি, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতেই যদি বাজেট করতে হয়, তাহলে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার, সেটা হচ্ছে, 'দারিদ্র্য ঘোচাও ও বৈষম্য রোখো'। বলা হয়ে থাকে, আমাদের দারিদ্র্য কমেছে। হ্যাঁ, এক অর্থে ধরলে কমেছে বলতে হবে। কিন্তু দরিদ্রের সংখ্যা কমেছে কি না আমার সন্দেহ আছে। সরকারের অগ্রাধিকারে দরিদ্রের সংখ্যা কমানোর কথাও বলা আছে। দারিদ্র্যসীমাও একটা কৃত্রিম সীমারেখা। যে হিসাবটা ধরা আছে, সেটা বিতর্কিত। একটি পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে যেকোনো সময় ওঠানামা করতে পারে। দ্রব্যমূল্যের ওঠানামা তো আছেই, পরিবারে কোনো একটা অনাকাঙ্ক্ষিত বিপর্যয় ঘটলেও একটি পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। দারিদ্র্যের যে সীমারেখা টানা আছে, আমার কাছে সেটা কৃত্রিম মনে হয়। কারণ দারিদ্র্য হচ্ছে একটা আপেক্ষিক বিষয়। কিছু লোক আঙুল ফুলে কলাগাছ হবে। হাজার হাজার ডলার তাদের সম্পদ বেড়ে যাবে, আর কিছু লোকের আয় এক ডলার থেকে বেড়ে এক ডলার ২৫ সেন্ট হলেই আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি আপেক্ষিক হওয়া উচিত। ধনীদের যেভাবে আয় বেড়েছে, দরিদ্রদেরও সেভাবে আয় বাড়া উচিত। আমার মনে হয়, বাজেটে দরিদ্রদের বিষয়টি অগ্রাধিকার পায়নি। দরিদ্রদের বিষয় অগ্রাধিকার দিতে হলে কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত ছিল। একটা বিষয় হচ্ছে, দরিদ্রদের সন্তানদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা। শিক্ষা বাজেটে মানসম্মত শিক্ষার ব্যাপারে কোনো প্রচেষ্টা আছে বলে মনে হয় না। দেশের অধিকাংশ দরিদ্র মানুষের বাস গ্রামেগঞ্জে। গ্রামেগঞ্জে যে শিক্ষার মানে ধস নেমেছে, এটাই গ্রামীণ দারিদ্র্যের মূল কারণ। আমিও গ্রামে বড় হয়েছি। তখন শিক্ষার মান এত খারাপ ছিল না বলেই একটা পর্যায়ে আসতে পেরেছি। এবারের বাজেটে শিক্ষার মানোন্নয়ন, বিশেষ করে গ্রামীণ শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা উচিত ছিল। এর মাধ্যমে দারিদ্র্য কমত। বৈষম্য কমত। আরেকটি বিষয় হচ্ছে স্বাস্থ্য। দরিদ্র মানুষের জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে বলে মনে হয় না। বরং কমেছে। যুক্তি দেখানো হয়, এটা কমার কারণ ওই খাতে ব্যাপক দুর্নীতি। দুর্নীতি তো এই সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। এই অগ্রাধিকারের ব্যাপারে তাহলে সরকার ব্যর্থ? দুর্নীতি দূর করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো অর্থকড়ির প্রয়োজন হয় না। এর জন্য প্রয়োজন ছিল সদিচ্ছা। প্রয়োজন ছিল অনমনীয় মনোভাব, দৃঢ় পদক্ষেপ। দরিদ্রের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আরেকটা জিনিস নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সেটা হচ্ছে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সম্পদের ন্যায্য প্রাপ্য একটা অংশ দেওয়া। সেটা তো হচ্ছে না। আমাদের করের যে পদ্ধতি, তাতে অধিকাংশ রাজস্ব আসছে পরোক্ষ কর থেকে। এটা হচ্ছে সাধারণ মানুষের কর। আমি মনে করি, দরিদ্রদের সম্পদের হিস্যা দিতে হবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই বাজেট সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কতটুকু ভূমিকা রাখবে? সুশাসন অর্থ কী? সুশাসন হচ্ছে দুর্নীতি দূর করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। সুশাসন হচ্ছে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে সুশাসন। এই বাজেট দুর্নীতি দূর করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কী ভূমিকা রাখবে, তার কোনো প্রতিফলন আমি দেখি না। জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা কোথায়?
লেখক : সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক


No comments

Powered by Blogger.