পদ্মায় 'না' বলে দিল জাইকা

পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসার আর কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। ভারতে সফররত জাইকা প্রেসিডেন্ট আকিহিকো তানাকা গত মঙ্গলবার জানিয়েছেন, জাইকা পদ্মা সেতুতে ফেরার কথা ভাবছে না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্রে জানা যায়, জাইকা প্রেসিডেন্ট বলেছেন, 'বাংলাদেশের এই প্রকল্পে (পদ্মা সেতু) স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার যে পরিকল্পনা ছিল, তা এরই মধ্যে বাতিল হয়ে গেছে। আমরা আর এই প্রকল্পের সঙ্গে নেই। তা ছাড়া বাংলাদেশ সরকার বাইরের কারো আর্থিক সহযোগিতা না নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নেই এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে।' পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী হিসেবে জাইকার ৪১ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার কথা ছিল। দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলারের ঋণপ্রস্তাব আগেই বাতিল হয়ে যায়।
সূত্রে জানা যায়, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংককে 'না' বলার পর সরকার আশা করেছিল, এই প্রকল্পের অন্য তিন সহযোগী সংস্থা- এডিবি, জাইকা ও আইডিবি এগিয়ে আসবে। পদ্মা সেতুতে এই তিন সংস্থাকে সম্পৃক্ত রাখতে সরকার সব ধরনের চেষ্টা চালিয়েছিল। গত ২ থেকে ৫ মে নয়াদিল্লিতে এডিবির বার্ষিক বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৫ মে এডিবি ও জাইকার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, পদ্মা সেতুতে এডিবি ও জাইকা ফিরে আসতে পারে। ওই বৈঠকে জাইকার দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক মাসাকাত নাকাহার আভাস দেন, বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দিলে জাইকা পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। কিন্তু জাইকা প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের পর সেই সুযোগ আর থাকছে না।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের যুগ্ম সচিব সাইফ উদ্দিন আহমেদ (এডিবি শাখার প্রধান)
গতকাল এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, অর্থমন্ত্রী এডিবির কাছে পদ্মা সেতুর জন্য কারিগরি সহায়তা চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সংস্থাটির দিক থেকে কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি।
পদ্মা সেতুতে পুনরায় সম্পৃক্ত হতে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকও (আইডিবি) রাজি হয়নি। গত ২২ ফেব্রুয়ারি অর্থমন্ত্রী সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট ড. আহমেদ মোহাম্মদ আলী আল মাদানিকে পদ্মা সেতুতে সম্পৃক্ত হতে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন। এরপর গত ১৯ মার্চ জেদ্দা সফরে যান প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। ওই সফরে তিনি মাদানির সঙ্গে একান্ত বৈঠকে পদ্মা সেতুতে পুনরায় সম্পৃক্ত হওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু গতকাল ঢাকায় নিযুক্ত আইডিবির প্রতিনিধি ইকবাল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, এ মুহূর্তে পদ্মা সেতুতে নতুন করে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো খবর নেই।
এদিকে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা তদন্তের ওপর পর্যবেক্ষণ শেষে লুই মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। গত মঙ্গলবার রাতে সংস্থাটির সততা বিভাগের ওয়েবসাইটে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করা হয়নি। এমনকি প্রতিবেদনের কোথাও তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়নি। যদিও গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংক মসিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ তুলেছিল। ওই সময় বিশ্বব্যাংক থেকে বলা হয়েছিল, মসিউর রহমান পদ্মা সেতু প্রকল্পের সততা উপদেষ্টা ছিলেন। দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের বিষয়ে তিনি সব জেনেও কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। এ অভিযোগে তাঁকে এক মাসের ছুটিতেও পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রতিবেদনে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
প্রতিবেদনটি গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাংকের সততা বিভাগে জমা দেওয়া হয়েছিল। জানা গেছে, গত তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে তা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করেছে বিশ্বব্যাংকের সততা বিভাগ। প্রতিবেদনের বিষয়ে সরকারের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়েছে। সব কিছু শেষে মঙ্গলবার তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। তবে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের ওপর নিজের মতামত ব্যক্ত করে একটি জবাব তৈরি করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তাতে তিনি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা বিভিন্ন প্রসঙ্গের ওপর যুক্তিসহ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে দুদকের বিদায়ী চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, 'আরো কিছু সময় নিয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা বিশ্বব্যাংকের উচিত ছিল। কিন্তু সংস্থাটি তা করেনি। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন স্বতঃসিদ্ধ নয়। তারা প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমানের বিরুদ্ধেও অনেক কথা বলেছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তাঁর কোনো নাম নেই।'
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হলেও পদ্মা সেতু নির্মাণে এর কোনো প্রভাব পড়বে না।
এদিকে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করেন, 'বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন দাদাগিরির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মধ্যে কোনো নতুনত্ব, যুক্তি, প্রমাণ, সততা এবং জুরিসপ্রুডেন্স নেই। প্যানেলের এই প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক আইন, ব্যক্তির মৌলিক অধিকার ও একটি সার্বভৌম স্বাধীন দেশের প্রচলিত আইন ও বিধিবিধানের প্রতি অবজ্ঞার সামিল।'
বিশ্বব্যাংকে জবাব পাঠালেন অর্থমন্ত্রী : এদিকে অর্থমন্ত্রীর মতামত যোগ না করেই বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। গত ১৩ জুন অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, বিশ্বব্যাংক প্যানেলের প্রধান ওকাম্পোর কাছে তিনি লিখিত মতামত দেবেন। বিশ্বব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে তাঁর ওই মতামতও যাতে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়, সে অনুরোধও করবেন তিনি। কিন্তু এর আগেই তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, অর্থমন্ত্রী হয়তো আরো কিছু সময় অপেক্ষা করার জন্য সততা বিভাগকে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করেননি। তাই তাঁর মতামত দেওয়ার আগেই তা প্রকাশিত হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের ওপর তাঁর মতামত-সংবলিত একটি জবাব তৈরি করেছেন। তাতে তিনি আবুল হোসেনকে নির্দোষ বলে উল্লেখ করেছেন। জবাবটি গতকালই বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.