সঙ্গীতে অমলিন আব্বাস উদ্দিন by আহমদ মোমিন মেহেদী

শৈশব থেকেই গানে গানে তানে তানে পথ চলতেন আব্বাস উদ্দিন আহমদ। গানের সুরে সুরে জীবনের স্বপ্ন অাঁকতেন গানের কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদ।
প্রতিটি ভোর আসত সঙ্গীতজ্ঞ মনের আলোয় আলোকিত হয়ে। রেওয়াজের সুরেলা সকালে গানকে তিনি ভালবেসেছিলেন, আলো হেসেছিলেন কেবলমাত্র গানের প্রেমের কারণে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান 'ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ'... প্রথম গেয়েছিলেন আব্বাস উদ্দিন আহমদ। এই গানটি এমন একটি গান যে গান না শুনলে আমাদের সংস্কৃতিতে রোজার ঈদ ঈদই মনে হয় না। সেই ঐতিহ্যবাহী গানের সঙ্গীত শিল্পী আমাদের দেশজ গানের সুশীল মনের মানুষ আব্বাস উদ্দীন আহমদ ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর তৎকালীন ভারতের কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা জাফর আলী আহমেদ ছিলেন জজ আদালতের আইনজীবী। একজন আইনজীবী হিসেবে সন্তানকেও গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন আইনজীবী হিসেবে। কিন্তু আব্বাস উদ্দিন আহমদ গানকে ভালবাসতেন। গানের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক। এসব দেখে দেখে পিতা জাফর আলী আহমদও রাজি হন। সন্তানের গানের সুরে মুগ্ধ হন তিনি। পরবতর্ীতে আব্বাস উদ্দিন আহমদের সঙ্গীত চর্চা, সঙ্গীত সাধনায় পিতা হিসেবে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলেন। আইনজীবী পিতার সঙ্গীত শিল্পী পুত্র আব্বাস উদ্দিন আহমদ প্রথম জনসম্মুখে গান করেন তার শিাঙ্গনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। ব্যাপক প্রশংসিত হন তিনি। প্রধান শিক এসে জড়িয়ে ধরেছিলেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে। অন্য শিকগণও আদরের হাত রাখেন তার মাথায়। এভাবেই গানের পথে যাত্রা শুরু হয় আমাদের সঙ্গীত আকাশের উজ্জ্বল নত্র আব্বাস উদ্দিন আহমদের। তিনি নানা ধরনের গান করতেন। যেমন দেশাত্মবোধক, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া, লোক সঙ্গীত, চাটকা, জারি, সারি, ভাটিয়ালী, মুর্শিদী, বিচ্ছেদি, মর্সিয়া, পালাগান, আধুনিক ইত্যাদি। কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লী কবি জসিম উদ্দিন ও কবি গোলাম মোস্তফার গানও করতেন তিনি।
শিা জীবনে আব্বাস উদ্দিন আহমদ তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে কুচবিহার কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে আইএ পাস করে কলকাতায় আসেন। পরবতর্ীতে বাংলা সরকারের রেকর্ডিং এক্সপার্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ চাকরিতে যোগ দেয়ার পরপরই তিনি দেশেরই নয় শুধু, বিশ্ব বাঙালীর প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সানি্নধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। এরও অনেক পর ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর আব্বাস উদ্দিন আহমদ সপরিবারে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় এসে সঙ্গীতের এই অনন্য পথিকৃৎ তৎকালীন সরকারের তথ্য ও প্রচার বিভাগের অতিরিক্ত সঙ্গীত সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি চলতে থাকে সঙ্গীতের নীরব সাধনা। সে সময়ে তিনি সঙ্গীতের প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক কাজ করেন। ধর্মান্ধতার দেয়াল ভেঙ্গে সঙ্গীতের প্রতি মানুষদের আগ্রহী করে তোলার মহান ল্যে ১৯৫৫ সালে ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত দণি-পূর্ব এশিয়া সঙ্গীত সম্মেলনে, ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক লোক সঙ্গীত সম্মেলন, ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুনে অনুষ্ঠিত বাংলা সাংস্কৃতিক সম্মেলনে অংশ নেন। সমসাময়িক সময়ে কলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানি অব মাস্টার্স ভয়েস তার বেশ কিছু গানের কেরর্ড বের করেছিল, যা পরবতর্ীতে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। সেসব রেকর্ডের উল্লেখযোগ্য গান হলো কাজী নজরুল ইসলামের 'ও মোর রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ' 'তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে' 'ত্রি ভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়' প্রভৃতি গান শুনে তৎকালীন মুসলিম সমাজের অধিকাংশ মানুষ, যারা সঙ্গীতকে অপছন্দ করত তারা সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার কতর্ৃক মরণোত্তর প্রাইড অব পাফরমেন্স এ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। এর মাত্র ১ বছর আগে ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর মহান এই সঙ্গীতজ্ঞ ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের ২০ বছর পর ১৯৭৯ সালে আব্বাস উদ্দিন আহমদকে মরণোত্তর শিল্পকলা একাডেমীর পুরস্কার ও ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সরকার কতর্ৃক মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল আব্বাসউদ্দিনের জেষ্ঠ সন্তান। তার একমাত্র মেয়ে ফেরদৌসী রহমান আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনের জীবন্ত কিংবদন্তী। এঁকেছেন সঙ্গীতের জলছবি। ছোট ছেলে মুস্তফা জামান আব্বাসীও সঙ্গীতাঙ্গনকে মাতিয়ে রেখেছেন গানের সুরে সুরে। আব্বাস উদ্দিন আহমদের নাতনি, বলা যায় সুযোগ্য উত্তরসূরি নাশিদ কামালও একজন আলোচিত কণ্ঠশিল্পী। সঙ্গীতশিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদ শুধু সঙ্গীত নিয়েই চর্চা করেননি, লেখালেখিও করেছেন। তাঁর রচিত 'আমার শিল্পী জীবনের কথা' চমৎকার একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। এই বইয়ের মধ্যে রয়েছে তৎকালীন সময়ের সঙ্গীতাঙ্গনের চালচিত্র।
আমাদের স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তিদের মধ্যে আলোকিত আব্বাস উদ্দিন আহমদের প্রতি সঙ্গীতপ্রিয় কোটি কোটি বাঙালীর হৃদয়ের উষ্ণ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : শিাথর্ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.