কার ছায়া এরা by মুহম্মদ জুলফিকার আলী

পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে ভাষার ওপর আক্রমণটা ছিল জাতি হিসাবে বাঙালীর প্রতি এক পরো হুমকি। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের অবিভক্ত বাংলাকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাতারা কখনও মেনে নিতে পারেনি।
ফলশ্রুতিতে তারা বাংলা ভাগ করে পাকিস্তানভুক্ত করেছিল। সেখানেও তাদের সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ জন এ অঞ্চলের অধিবাসী হওয়াতে। অপরদিকে জনসংখ্যার শতকরা ৪৪ জন পাকিস্তান অংশে বাস করায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাঙালীর প্রাধান্যে ভীত ছিল। এজন্য বাঙালী ও বাংলাকে তারা কখনই সুনজরে দেখেনি। বাঙালী জাতির অনিষ্ট করতে তাই তাদের দুষ্ট বুদ্ধি প্রয়োগে তারা কখনও পিছপা ছিল না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজম জিন্নাহ স্বয়ং তাই পাকিস্তানের তদানীন্তন সময়ের মাত্র শতকরা ৩ জনের মুখের বুলিকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জোরালো ঘোষণা ঢাকার মাটিতে করতে দুঃসাহস দেখিয়েছিল। তার জবাব অবশ্য সাথে সাথে বাঙালী দিয়েছিল।
১৯৫২-এ ১৯৭১-এর মতো বাঙালীর সাথে সম্মুখ সমরে লড়বার পরিস্থিতি বিরাজ করছিল না। তখন বাঙালীর শিতিজনেরাও পাকিস্তানী কালচার বলতে কৃষ্টি ও সংস্কৃতি পরিবর্তে তাহজিব-তমদ্দুন শব্দ স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করত। এমন কি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় ব্যবহৃত শব্দকে পর্যন্ত পরিবর্তন করেছিল তথাকথিত শিতিজনেরা। তারা কবির ব্যবহৃত 'মহাশ্মশান' শব্দকে 'মহাগোরস্তানে' পরিবর্তনে গা ভাসিয়েছিল। তাদের কাছে পাকিস্তানের সংহতি ছিল বড় কিছু। এ সুযোগটাই জিন্নাহরা নিয়েছিল। সাধারণ বাঙালী এ জন্য বুকের রক্ত দিয়েছে। এ অঞ্চলের মুখের ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম ভাষার স্বীকৃতি দিতে ১৯৫৬ সালে ইসলামিক পাকিস্তানের সংবিধানে তা সনি্নবেশ করতে শাসকেরা এক সময়ে বাধ্য হয়েছিল।
হাজার মাইল ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দু'অংশের বিরাট বৈষম্যের ফারাক কমাতে একজন দ্রষ্টা ও স্রষ্টা, গণনেতা হিসাবে আবিভর্ূত হলে তার ছয় দফা বাঙালীকে স্বায়ত্তশাসনের মোড়কে স্বপ্ন দেখায় আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার। বাঙালী সে স্বপ্ন পূরণে ১৯৭০-এ এক অভূতপূর্ব গণরায় দেয় সে গণনেতার প্রতি। সেটা পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থের প্রতিভূ, সামরিক জান্তাদের পছন্দ হয়নি। তারা সেজন্য গণরায়কে উপো করার অপচেষ্টায় ২৫ মার্চ কালরাতে গণহত্যার বীভৎসতায় বাঙালীকে নিমর্ূলের ব্যবস্থা নেয়। এমনকি গণনেতাকে মিলিটারিরা করে আটক। আটক নেতার অনুপস্থিতিতে তার পূর্ব স্থিরীকৃত নির্দেশনায় পাকিস্তানের পূর্বাংশ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের ফসল হিসাবে বাংলাদেশ জন্মলাভ করে। বাঙালীর প্রথম রক্তদানে রা পেয়েছিল মুখের জবান বাংলা এবং সেখান থেকে শেখা দ্রোহের শিখায় অনেক অনেক বেশি রক্ত দিতে হয়েছে বাঙালীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে। স্বাধীনতার জন্য অন্য কোন জাতিকে এত রক্ত দেয়ার কোন নজির কেউ দেখাতে পারবে না। এ রাষ্ট্রের সম্পদ লুট ও ধ্বংসের নারকীয় ঘটনা ঘটিয়ে পাকিস্তান এখন এক অন্ধকার ইতিহাসের অংশ।
পাকিস্তান যে সত্যহীনের দেশ, ১৯৭১-এ ফিরে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায়। ১৯৭১ আমাদের মনে করিয়ে দেয়_ এ সময়ে ইসলামের নামে কিছু মানুষ, পাকিস্তান মিলিটারি হুকুম তামিলে এমন সব কাজে লেগেছিল, যা ইসলামের নামে সংঘটিত হওয়ায়, তা ইসলামকেই অপমান করেছে। যার জন্য তারা তাদের এ সময়ের কৃতকর্ম নিজেরা তো ভুলতে চায়, সাথে সাথে অন্যরাও যেন না মনে করতে পারে সেজন্য বলে, অতীতকে নিয়ে টানাটানি করার কি দরকার?
তারা অতীতকে পিছনে ফেলে ভবিষ্যত পানে সবাইকে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। এর মধ্যে একটা উদ্দেশ্য কাজ করে এবং সেটা কুউদ্দেশ্যের পরিচায়ক। কথাটা আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে বলা যায়, যারা এমন নিরীহগোছের কথা নিরীহভাবে বলে, তারা আদতে নিরীহ মানুষ নয়। এরা ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত নিজেরা কি কাজে জড়িত ছিল, কিভাবে তাদের দিন কেটেছে তা তারা প্রকাশ করে না। প্রয়োজনে তাদের জীবন-বৃত্তান্ত জানতে চাইলেই তারা এ সময়টা বাদ দিয়ে, তাদের জীবনের সাফল্যের কথা সবাইকে জানায়। শুধু জানায় না, তাদের অন্ধকার ও ব্যর্থ দিনগুলোতে তারা কিভাবে নিরীহ ও সাধারণ বাঙালীর জীবনকে দুঃসহনীয় করেছিল সে খবরসমূহ।
কথায় কথায় তারা আবার আওড়াতে থাকে ১৯৭১-এর আগে তাদের হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া ছিল। সে যুগকে অতীত হিসাবে চিত্রিত করে না তারা। তা যে বাংলাদেশ জন্ম নেয়ার আরও আগে পেরিয়ে এসেছিল তা বলে না তারা। বাংলার মসনদে বসা বাংলাভাষী নয়_ এমন মানুষের কাহিনী তারা গর্বের সাথে অতীতের বিষয় হলেও বলতে পিছপা হয় না। এমনকি গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু, গরুর দুধে পেট ভরে পূর্ব পুরুষেরা খাবার খেয়েছে, সে খাওয়ার ঢেঁকুর তুলে এখন কয়েক পুরুষ পরে তারা আনন্দ করে। তাদের স্বভাবটা বদলানোর জন্য যদি নিরীহভাবে কথাগুলো মেনে নেয়া যায় তাতে কারও তো আপত্তি থাকে না। বাস্তবটা, কিন্তু তা নয়। নিরীহ গোছের কথাবার্তা বলার লোকেরা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে এমন সব কাজ করে, যা সুস্থ মানুষের প েকরা সম্ভব বলে ভাবা যায় না। তাদের এ কাজকে অবশ্যই হাইওয়ানদের সাথে তুলনা করা যায়। হাইওয়ান স্বভাবের মানুষেরা যখন নিরীহ ভাষায় কথা বলে তখনই ভয় হয়, তারা নিশ্চয়ই কোন অঘটন ঘটাতে যাচ্ছে। হাইওয়ান স্বভাব বদলে তারা হতে চাচ্ছে মিষ্টভাষী।
দোষে-গুণে মানুষের স্বভাব। একজন মানুষ শুধু ভাল হয় না, আবার শুধু খারাপও সে নয়। এমন মানুষ নিয়েই সংসার, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র। যে রাষ্টে সাধারণ মানুষ নিজ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নিজেরা রাষ্ট্রের নিয়ামক হয়, সে রাষ্ট্রকে সাধারণত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণ হয় সকল মতার উৎস।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধটা ছিল বাঙালীর জন্য এমন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের সংগ্রাম। গণতন্ত্রে সাধারণ ভোটার নিজ ভোটাধিকার কায়েম করতে পারে। সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগে ১৯৭০-এর নির্বাচনী ফলাফল ১৯৭১-এ পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা অস্ত্রের জোরে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। এজন্য তারা অন্যায়ভাবে নিরীহ ও অসহায় মানুষদের অস্ত্র বলে খুন করতে শুরু করলে বাঙালী মুক্তিযুদ্ধ করে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা দেয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাঙালী গণপরিষদ গঠন করে স্বল্পতম সময়ে নবেম্বর ১৯৭২-এ একটা চমৎকার সংবিধান উপহার দিয়েছিল। তার চারটা স্তম্ভ হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়_ (১) গণতন্ত্র (২) জাতীয়তাবাদ (৩) সমাজতন্ত্র ও (৪) ধর্মনিরপেতা।
এ চার স্তম্ভকে একদিন দুমড়ে-মুচড়ে ফেলা হয় একটা বিশেষ জায়গা থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা হয়ে গেল ১৯৭১-এর মার্চ পূর্ববতর্ী আরেক পাকিস্তান। তখন ১৯৭১-এর মার্চ থেকে ১৯৭৫-এর আগস্ট পর্যন্ত হাইওয়ান চরিত্রের যারা মানুষের পরিচয় দেবার মতো কোন কাজ সে সময়ে করতে পারেনি, তারা অন্ধকার গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। তাদের অন্ধকার জীবনকে যেন কেউ না দেখতে পায় সেজন্য অতীতকে ভুলবার পরামর্শদাতা হয়ে ওঠে।
তারা ১৯৭৫-এর পট পরিবর্তনে শয়তানের সঙ্গে তুলনীয় সাপের খোলস বদল করে বাংলাদেশকে মারতে চায়। এদের শক্তির উৎস ১৯৭৫-এর প্রতিবিপ্লবী শক্তিরা। এরা নাকি এখন তাদের বংশধরদের গল্প শোনায়_ "আমরা আইনের মধ্যে থাকতে চাই। আমরা আইন অমান্যকারীকে বরদাস্ত করি না। আমরা শিখেছি, দেশের এ দশের কোন কাজে নেমে যদি মরণ হয় সে মরণ তো শহীদী মর্যাদা পায়। আমরা সে কাজে কামিয়াব হলে গাজী হতে পারি। এ শিা আমরা শিখেছি ১৯৭১-এ। আবার ১৯৭৫-এর বিশেষ জায়গা থেকে তা রিনিউ করেছি। এ রিনিউবলে ২০০৬ সালের অক্টোবরে দেশের বড় মসজিদের উত্তর পারে ১৯৭১-এর কায়দায় হাইওয়ানি মেজাজে আবার কারবার শুরু করি। এ কারবারে আমাদের ডাক ছিল সেই একই_ 'মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী। আমরা সব সময় যুদ্ধে ছিলাম, থেকেছি এবং থাকব। তোমরা আমাদের সন্তান, আমাদের অতীত নিয়ে তোমরা গর্ব করতে শেখ।"
তার নমুনা শুরু হয়েছে ২৮ জানুয়ারির (২০১০) মধ্যরাতে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুসারে জাতির জনকের খুনীদের ফাঁসি কার্যকর হলে ১৯৭৫-এর পরে সৃষ্ট দলের কেউ কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকাতে। এদের সাথে ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়িক সহযোগী দলগুলোর নীরব থাকাটায় বুঝতে অসুবিধা হয় না_ ওরা কার ছায়া।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কমর্ী ও গ্রন্থকার

No comments

Powered by Blogger.