এই বিচারই শেষ বিচার নয় by সিফাত মাহমুদ

২৮ জানুয়ারি ২০১০ প্রথম প্রহর, রাত ১টা। রাত ১২টা থেকেই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ ও বিশেষ বুলেটিন শুনে অপোর প্রহর গুণছি। অবশেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর হরমানকে সপরিবারে হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় কার্যকরের মাধ্যমে গোটা জাতির দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের অপোর প্রহর এবং ইতিহাসের কলঙ্ক মোচনের একটি ধাপ শেষ হলো।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে আমরা যেমনি বিশ্ব মানচিত্রে বীর জাতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছিলাম, তেমনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে আমরা বেইমান হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত হয়েছিলাম। হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় এই পাপের বোঝা কিছুটা হলেও লাঘব হলো। কিন্তু পাপমোচনের পথ এখনও অনেক বাকি। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ষড়যন্ত্রকারীরা শুধু একজন ব্যক্তি বা একটি পরিবারকে হত্যা করেনি, বরং আঘাত করেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর। এই ত এখনও এদেশের জনগণ বয়ে বেড়াচ্ছে। হত্যাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে শুধু হত্যা করেই ান্ত হয়নি, তারা জাতির পিতাকে একজন সাধারণ নাগরিকের অধিকার থেকেও বঞ্চিত করেছিল। বেইমান মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে খুনীদের দায়মুক্তি দিয়ে বিচারের পথ বন্ধ করেছিল। আর জিয়াউর রহমান এই অধ্যাদেশকে আমাদের পবিত্র সংবিধানের চতুর্থ সিডিউলে অন্তভর্ুক্ত করে সুরা করেছিল। পঁচাত্তরপরবতর্ী প্রতিটি সরকার খুনীদের নানাভাবে পুরস্কৃত করে প্রকারান্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে নিজেদের সংশ্লিষ্টতা নিজেরাই প্রমাণ করেছে। অবশেষে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ মতায় আসলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রচলিত সাধারণ আইনী প্রক্রিয়ায় শুরু হয়। শুরু হয় ইতিহাসের কলঙ্কমোচনের প্রক্রিয়া। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রে লুকিয়ে থাকা ষড়যন্ত্রকারীরা পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়েও অত্যন্ত ধৈর্য ও দৃঢ়তা নিয়ে একজন সাধারণ নাগরিকের মতোই সাধারণ আদালতে স্বচ্ছ আইনী প্রক্রিয়ায় নিজ পিতা, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচার এগিয়ে নিয়েছেন। নিম্ন আদালতের রায়ে ১৯৯৮ সালে খুনীদের ফাঁসির আদেশ হয়।
কিন্তু চূড়ান্ত বিচারের পথ কখনই সুগম ছিল না। বার বার প্রতিবন্ধকতা এসেছে, হয়েছে ষড়যন্ত্র। আসামিদের আপীলের শুনানিতে উচ্চ আদালতের দুইটি বেঞ্চ বিব্রত বোধের মতো নজিরবিহীন ঘটনা এদেশের বিচার বিভাগকে প্রশবিদ্ধ করেছে। ২০০১ সালে হাইকোর্টে তৃতীয় বিচারপতি বারো জনের মৃতু্যদণ্ড বহাল রেখে রায় দিলে আসামিরা আপীল বিভাগে লিভ টু আপীলের আবেদন করে। এরই মধ্যে ২০০১ সালের অক্টোবরে মতার পট পরিবর্তনে বিএনপি-জামায়াত জোট মতায় এসে আপীল বিভাগে পর্যাপ্ত বিচারকের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রাখে। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় পঁচাত্তরের ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতারই একটি অংশ ছিল। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়ে অনেক ভাল কাজে হাত দিলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করার কোন পদপে নেয়নি। অবশেষে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় রাষ্ট্রমতায় অধিষ্ঠিত হলে চূড়ান্ত বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০০৯ সালের ১৯ নবেম্বর আপীল বিভাগ এক ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে এবং হাইকোর্টের দেয়া আদেশ বহাল রাখে। এরপর খুনীদের রিভিউ পিটিশনসহ যাবতীয় আইনী অধিকার দিয়েই ২৮ জানুয়ারি ২০১০ তারিখ প্রথম প্রহরে কারাগারে আটক পাঁচ খুনীর মৃতু্যদণ্ড কার্যকর করা হলো।
কিন্তু এই বিচারই শেষ বিচার নয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রের যে এজেন্ডা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল তা আজও অব্যাহত। আরও ছয় খুনী বিভিন্ন দেশে পলাতক অবস্থায় এখনও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। শুধু তারাই নয়, পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের সুবিধাভোগী এবং যুদ্ধাপরাধীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনষ্টে নানা ষড়যন্ত্র করছে। এই ষড়যন্ত্রের কারণেই এদেশে বার বার গণতন্ত্র হোঁচট খেয়েছে, রাজনীতিতে হয়েছে দুবর্ৃত্তায়ন এবং উত্থান হয়েছে মৌলবাদী জঙ্গীবাদের। জাতি প্রত্য করেছে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো জঘন্য ঘটনা। রাষ্ট্রবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ষড়যন্ত্রে কারা লিপ্ত তা আজ জাতির সামনে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। আপীল বিভাগের রায়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায়ের পর এমনকি রায় কার্যকর হওয়ার পরও প্রধান বিরোধী দল কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তাদের এই নীরবতাই ষড়যন্ত্রের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততা পুনরায় প্রমাণ করেছে। তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নানা চেষ্টা করে খুনীদের রা করতে চেয়েছিল। সুতরাং এই ষড়যন্ত্রকারীদের চিরতরে বাংলার মাটি থেকে উৎখাত না করা পর্যন্ত এদেশকে কখনই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আজকে সময় এসেছে খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার করবার। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে কলঙ্কমোচনের একটি ধাপ শেষ হয়েছে মাত্র। এখন জেল হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনষ্ট ও রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিটি ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত বিচার করা না গেলে পঁচাত্তরের ত পুরোপুরি পূরণ হবে না। বর্তমান সরকারকে দৃঢ়তার সাথে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবেলা করে এসব বিচার সম্পন্ন করতে হবে, যাতে করে বাঙালী জাতির ভাগ্যাকাশে আর কোন কালো অন্ধকার অমানিশা না আসে। সমগ্র জাতি আজ জাতীয় জীবনের প্রতিটি কলঙ্কমোচনের জন্য অপো করছে।
লেখক : ছাত্র, এলএলবি

No comments

Powered by Blogger.