সম্পাদক সমীপে- মিডিয়ার ভাষা ও বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থা
আমাদের তরম্নণ প্রজন্মের ভাষা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ নষ্টের জন্য যত হাতিয়ার রয়েছে তার মধ্যে মিডিয়া অন্যতম। এ প্রসঙ্গে টেলিভিশন নাটক, বিজ্ঞাপন, চলচ্চিত্র ও সংবাদপত্র নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে।
তরম্নণ প্রজন্ম আজ রিমোট নিয়ে এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেলে যাচ্ছে। তারা আসলে কোনটিই দেখছে না, তবে অনুকরণ করছে। সম্ভবত বাঙালী নকল আর অনুকরণপ্রিয় জাতি। টিভি ভুল উচ্চারণে ও ভুল বাংলায় কথা বলছেন উপস্থাপক, এমনকি সংবাদ উপস্থাপক। চ্যানেল আধিক্যে স্বাভাবিকভাবেই মান আর উৎকর্ষের পূর্ণতায় ব্যাপক ঘাটতি পড়ে। আজ আর মান নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। বর্তমান টিভি নাটকগুলো দেখলে মনে হয় নির্মাতারা দর্শকদের জোর করে হাসানোর চেষ্টা করছেন। নির্মাতাদের মনে রাখা দরকার পাত্র-পাত্রীদের দিয়ে আঞ্চলিকতার নামে বিকৃত ভাষাভাষী উপস্থাপন ও হাস্যরস প্রদানই শিল্পের একমাত্র শর্ত নয়। তাঁর নির্মাণটি শৈল্পিক মানে উত্তীর্ণ হলে দর্শক নিজের অজানত্মেই হাসবে বা কাঁদবে।একশ্রেণীর নির্মাতা গুটিকয়েক লোকের ভাষাকে জাতীয় মাধ্যমে প্রয়োগ করে চলেছেন, যেন তাই আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি। ৰুদ্র সময়ের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে একই কায়দায় নির্মাণ করছেন একের পর এক ছবি, টেলিছবি কিংবা মেগাসিরিয়াল। মনে রাখতে হবে সাময়িক জনপ্রিয়তা শিল্পমানের মাপকাঠি নয়, নানা কারণে বিভ্রানত্ম তরম্নণ সমাজকে জনপ্রিয়তার স্রোতে ভাসিয়ে নেয়াও নয় শিল্পীর সাধনা। সাধারণের সঙ্গে শিল্পীর পার্থক্য এখানেই।
নাটক বা চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোর ভাষা নির্ধারণের ৰেত্রে অনেক অনুষঙ্গ জড়িত থাকে। যেমন চরিত্রের বসবাস কেমন অঞ্চলে? সমতলে না পাহাড়ে, গ্রামে না শহরে, নাকি নদী এলাকায়। তার পরিধেয়, শিৰা ও সামাজিক অবস্থান, পদমর্যাদা, কর্মজীবী বা বেকার কিংবা শিৰিত বেকার, বিত্তবিভাজন ইত্যাদি বিষয় জড়িত থাকে। আমাদের চাওয়া দিনের আলোতে তাঁরা পূর্ণিমা রাতের সংলাপ বলবেন না। চলচ্চিত্র বা নাটক হবে জীবনঘনিষ্ঠ জীবনের মতোই সত্য, সুন্দর ও স্বাভাবিক। আমাদের সমকালীন বা ভবিষ্যত প্রজন্ম নাটক বা চলচ্চিত্র দেখে জীবনকে চিনবে। জীবনের বৈচিত্র্য, আলোক অধ্যায় কিংবা অন্ধকার গলিঘুঁজি দেখে তাঁদের ভেতর তৈরি হবে এক মায়াময় জগত এবং তারা সৃজনশীল মননের অধিকারী হবে এটিই আমাদের প্রত্যাশা।
বাংলা আজ বিশ্বের ৪র্থ সর্বাধিক লোকের কথিত ভাষা। এই জায়গাটি থেকে আমরা গর্ব করতে পারতাম। কিন্তু আমরা কী দেখছি? আমাদের দূরপালস্নার বাসগুলোতে হিন্দিু গান বাজে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সারাৰণ চলে হিন্দি ছবি। এমনকি একুশে ফেব্রম্নয়ারির দিনও তার ব্যতিক্রম হয় না। এখন আর কেউ চিঠি লেখে না। তার জায়গা দখল করেছে মুঠোফোনের ৰুদে বার্তা। কিন্তু তাতে ইংরেজী হরফে লেখা বাংলা বার্তাগুলো পড়লে বোঝা যায় আমাদের বাংলা দৌর্বল্য কতটা স্পষ্ট। আমাদের ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে শিখতে হয় বানান ও উচ্চারণনীতি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের স্কুলগুলোতে সেসব শিখানো হয় না। এ অবস্থায় বাংলা ভাষাপ্রেমিকেরা আহত হন। তাঁরা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে বাস করেন। ভাষার জন্য বুকে নীরব কান্নার অশ্রম্ন ঝরানো ছাড়া তাঁদের আর কিছুই করার থাকে না।আমাদের মনে রাখতে হবে বিদেশী ভাষায় ব্যবসাবিদ্যার মুনাফা কৌশল কিংবা বিজ্ঞানের অন্ধপাঠ নিয়ে বেশিদূর এগুনো যাবে না। আমরা কি ভুলে গেছি শুধু আমাদের রয়েছে ভাষার জন্য রক্তদানের গৌরবময় ইতিহাস। যার ফসল হিসেবে পেয়েছি 'আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'। আসুন সবাই মিলে ভাষার জন্য আর একটি আন্দোলন করি। আন্দোলনটির নাম দিই 'ভাষা বাঁচাও আন্দোলন।'
মাজেদ মাহতাব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments