বাংলা ও বাঙালীর সঠিক ইতিহাস উপস্থাপনা- নতুনরূপে জাতীয় জাদুঘরের চার গ্যালারি by মোরসালিন মিজান

 দীর্ঘ ইতিহাস বাংলার। বাঙালীর। তবে দুর্ভাগ্যের যে, সব সময় এ ইতিহাস সত্যনির্ভর, তথ্যনির্ভর হয় না। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের ইতিহাসটি বার বার বিকৃত হয়েছে।
এমনকি জাতীয় জাদুঘরের মতো প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর ভুল ইতিহাস খুব যতেœর সঙ্গে লালন করেছে। হ্যাঁ, হতাশ হওয়ার মতো ব্যাপার। তবে রবিবার সেই হতাশা কিছুটা হলেও কাটাতে সক্ষম হয়েছে জাতীয় জাদুঘর। এদিন থেকে জাদুঘরের ৩৭, ৩৮, ৩৯ ও ৪০ নম্বর গ্যালারিতে শুরু হয়েছে বাংলা ও বাঙালীর সঠিক ইতিহাসের উপস্থাপনা। বিকেলে ফিতা কেটে গ্যালারিগুলো উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
জানা গেছে, বিগত সরকারের সময় জাতীয় জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের একটি বিচ্ছিন্ন ইতিহাস উপস্থাপন করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, সে ইতিহাস ছিল বিকৃত। মনগড়া। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনেন দেশের বিশিষ্ট জাদুঘরবিদ ড. ফিরোজ মাহমুদ। পরে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার লক্ষ্যে ৩০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে সরকার। ফিরোজ মাহমুদ নিজেও এ কমিটিতে ছিলেন। কমিটির প্রস্তাবনা অনুযায়ী, দুটি বিষয়ভিত্তিক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। প্রথম অংশের শুরু হয় ১৭৫৭ সাল থেকে। শেষ হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে। দ্বিতীয় অংশে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম চার বছর।
জাদুঘর ঘুরে দেখা যায়, ইতিহাস বর্ণনার শুরু হয়েছে ৩৭ নম্বর গ্যালারি থেকে। এখানে প্রবেশ করলে প্রথমেই দৃশ্যমান হয় ১৭৫৭ সাল। চোখে পড়ে লর্ড ক্লাইভের ছবি। দ্বিতীয় ফ্রেমে মীর জাফর ও মিরন। তৃতীয়টিতে পলাশী যুদ্ধের পরিকল্পনা সংবলিত ম্যাপ। অন্য ছবিগুলোতে যুদ্ধের খ- চিত্র। বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত এসব ছবি সিরাজ উদ্দৌলা ট্র্যাজেডির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। একইসঙ্গে বর্ণনা করে যায়, দেশমাতৃকার বিরুদ্ধে ভয়াবহ চক্রান্ত ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। এই বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই আসে ইংরেজ শাসন। ভারতবর্ষের মানুষের গোলামির কাল শুরু হয়। তবে এমন গোলামি মেনে নিতে পারেনি অনেক বীর। তাই ফুঁসে ওঠেছে। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বিদ্রোহ বিপ্লবের সেসব ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় কিছু আলোকচিত্রে। প্রথমে উপস্থাপন করা হয়েছে ১৭৮৩ সালে রংপুরে সংগঠিত কৃষক বিদ্রোহ। এরপর ১৮২৫ সালে ময়মনসিংহে সংগঠিত পাগলাপন্থী বিদ্রোহ। ১৮৩১ সালের পথ পরিক্রমায় ওঠে আসেন দেশমাতৃকার জন্য নিবেদিতপ্রাণ যোদ্ধা অসীম সাহসী বীর তিতুমীর। ফ্রেমবন্দী তিতুমীরকে দেখে গর্ভ হয়। এ বীর সন্তান শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের উপস্থাপনা অন্য ছবিতে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাসটি বর্ণনা করা হয়েছে একাধিক ছবিতে। বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে নীল বিদ্রোহ। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এসেছে স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, মাস্টার দা সূর্যসেন ও প্রীতিলতা। এ গ্যালারির শেষ দেয়ালটি সাজানো হয়েছে তিন কবির ছবি দিয়ে। প্রথমে কাজী নজরুল ইসলাম। পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তৃতীয়জন রাজনীতির কবি মুজিব। তাই দুই কবির পাশে স্থান পেয়েছে তাঁর ছবি ।
পরের তিনটি গ্যালারি ৩৮, ৩৯ ও ৪০। এগুলো ঘুরে দেখা যায়, প্রাক ১৯৪৭, ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস। শুরুতেই পাকিস্তানের গবর্নর জিন্নাহর শপথ গ্রহণের ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এরপর ঘটনাবহুল পথচলা। তবে বিশেষ গুরুত্ব পায় বাঙালীর ভাষা আন্দোলন। একটি ছবিতে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে আঙুল উঁচিয়ে বক্তৃতা করছেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। এখানেই তিনি ঘোষণ দিয়েছিলেন, উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যে এমন আক্রমণ মেনে নেয়ার কোন কারণ ছিল না। তাই ক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা পূর্ব পাকিস্তান। আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে বাঙালী। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রথম সোপান ছিল ভাষা আন্দোলন। তাই বহু আলোকচিত্রে প্রকাশিত হয়েছে ইতিহাসটি। পরে ধারাবাহিকভাবে এসেছে ’৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ও ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন। ’৬৬-র ছয় দফায় স্বাধীনতার বীজ বুনেছিলেন শেখ মুজিব। সে ইতিহাসও যতেœর সঙ্গে ফ্রেমবন্দী করা হয়েছে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস বর্ণনায় অবশ্য বহু আলোকচিত্র পাওয়া যায়। সেসবের অধিকাংশই রাখা হয়েছে গ্যালারিতে। অত্যন্ত দুর্লভ একটি ছবিতে কবি সুফিয়া কামালের পাশে দেখা যায় আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। সেই ’৬৯ সালে রাজপথে শেখ হাসিনা! ইতিহাসটি অনেকেরই অজানা। সঙ্গত কারণে জাদুঘরের দর্শনার্থীদের কাছে ছবিটি বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করবে। ’৭০-এর নির্বাচনেরও আছে কিছু আলোকচিত্র।
তবে আর সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় ১৯৭১। অসংখ্য আলোকচিত্র আর দেশী-বিদেশী পত্র পত্রিকার প্রচ্ছদে উপস্থাপন করা হয় বাঙালীর মুক্তির সংগ্রামের দিনগুলো। এসব ছবি দেখতে দেখতে দর্শনার্থীরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠবেন। এ অংশে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর, গেরিলা প্রশিক্ষণ, রাজাকার আলবদরদের ভূমিকা বর্ণনা করা হয়েছে। সবই আলোকচিত্রে। এর বাইরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রের প্রদর্শনী। ওপরের গ্যালারি থেকে নিচে নামার সময় দেয়ালের দিকে চোখ পড়বে। আর তখন দেখা যাবে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য। ঐতিহাসিক সময়টিকে উপস্থাপন করা হয়েছে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে। গ্যালারির বিশাল দেয়াল জুড়ে ব্যবহার করা হয়েছে একাধিক আলোকচিত্র। এসবে দেখা যায়, লেজ গুটিয়ে নিয়েছে পাকিস্তানী পশুরা। রেসকোর্স ময়দানে প্রকাশ্যে নাকে খত দিচ্ছে তারা। পরের কক্ষটিতে নতুন সংযোজন করা হয়েছে ৭ বীরশ্রেষ্ঠ আবক্ষ মূর্তি। একই কক্ষে গণহত্যা ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। পরের কক্ষে স্বাধীনতা পরবর্তী চার বছরের উপস্থাপনা। এখানে আলোকচিত্র ছাড়াও রয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবক্ষ ব্রোঞ্জ মূর্তি ও তাঁর ব্যবহৃত আসবাবপত্রের উপস্থাপনা।
তবে বিশেষভাবে বলতে হয়, সাউন্ড এ্যান্ড লাইট শোর মাধ্যমে বাঙালীর ইতিহাস তুলে ধরার প্রশংসনীয় উদ্যোগটির কথা। কাজটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে করা হয়েছে। টাচ স্ক্রিনের মাধ্যমেও জানা যাবে ইতিহাস। এ জন্য গ্যালারিতে বসানো হয়েছে কয়েকটি মনিটর। মনিটরগুলোতে ছবি ছাড়াও রয়েছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের তথ্য। পাশাপাশি কয়েকটি মনিটরে নিয়মিতভাবে দেখানো হবে একাধিক ডকুমেন্টারি।
সব মিলিয়ে চমৎকার একটি কাজ। তো কী অনুভূতি হচ্ছে এখন? জানতে চাইলে ড. ফিরোজ মাহমুদ বলেন, এটি সত্যি আনন্দের। ইতিহাসকে ইতিহাসের পথেই চলতে দিতে হয়। এবার সে চেষ্টাটিই করা হয়েছে। তবে শুধু চারটি গ্যালারি নয়, পুরো জাদুঘর ইতিহাসের আলোকে সাজানোর পরামর্শ দেন তিনি।
কাজটির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত জাদুঘরের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, সঠিক তথ্য ও ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য যা যা করা দরকার সব কিছু করার চেষ্টা করেছি আমরা। এ জন্য অনেক শ্রম ঘাম দিতে হয়েছে। এর ফলে ইতিহাস নিয়ে মিথ্যাচার বন্ধ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.