কালান্তরের কড়চা-সমঝোতা চাই সমঝোতা; কিন্তু কিসের সমঝোতা? by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

বাংলাদেশে এখন একটাই রব, সমঝোতা চাই, সমঝোতা চাই। দেশের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, যাঁরা দেশের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া অনেকটাই দখল করে আছেন, তাঁদের কণ্ঠেও একই রেটোরিক বা আপ্তবাক্য- 'সমঝোতা চাই, দুই নেত্রীর মধ্যে সমঝোতা চাই।
সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। সমঝোতা না হলে দেশ সংঘাতের পথে এগিয়ে যাবে।' এই রেটোরিক আমাদের তথাকথিত সাহায্যদাতা দেশগুলো- বিশেষ করে আমেরিকার মুখেও। যে আমেরিকা ইউনিপোলার বিশ্বে নিজে একক শক্তিধর রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও কোথাও সমঝোতার সামান্যতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে না, কোথাও ড্রোন হামলা, কোথাও ন্যাটো বাহিনীর একতরফা হামলা দ্বারা বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে, সেই আমেরিকার ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত মজিনা সাহেব প্রত্যহ বাংলাদেশের চারদিকে অবাধে ঘুরে বেড়িয়ে দেশটির মানুষকে উপদেশ খয়রাত করছেন এই বলে যে, বাংলাদেশের দুই বড় দলের মধ্যে সমঝোতা চাই। এই সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই।
আমার সদ্যপ্রয়াত স্ত্রীর মৃতদেহ সমাহিত করার জন্য ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকটায় আমি যখন ঢাকায় ছিলাম, তখন ঢাকার একটি টেলিভিশনকেন্দ্র আমাকে তাদের টক শোতে যোগদানের অনুরোধ জানিয়েছিল। বিষয় হাসিনা-খালেদার সমঝোতা চাই। নইলে দেশে সংঘাত দেখা দেবে। তখনকার দারুণ শোকার্ত অবস্থায় টক শোতে যোগ দেওয়ার কোনো মানসিক অবস্থাই আমার ছিল না, তবু তাদের হেসে বলেছি, আপনারা বলছেন, দুই নেত্রীর মধ্যে সমঝোতা না হলে দেশে সংঘাত সৃষ্টি হবে। কিন্তু এই সংঘাতের বাকিটা কী আছে বলুন? বিএনপি (সঙ্গে জামায়াত) রোজই তো দেশে হরতাল, প্রতিবাদ দিবস ডেকে ভাঙচুর, জনজীবনে অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি করছে। এখন সংঘাতময় সারা দেশ। তাহলে সংঘাত সৃষ্টি হবে বলতে আপনারা কী বোঝাচ্ছেন? দেশময় পূর্ণাঙ্গ গৃহযুদ্ধ? সেই গৃহযুদ্ধ বাধানোর ক্ষমতা বিএনপি ও জামায়াতের আছে কি? চোরাগোপ্তা হামলা ও গৃহযুদ্ধ তো এক কথা নয়। ক্ষমতা থাকলে ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর জন্য বিএনপি ও জামায়াত বহু আগে গৃহযুদ্ধ শুরু করত।
টেলিভিশনকেন্দ্রটির প্রতিনিধি আমাকে বললেন, তাহলে আপনি দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা চান না? বলেছি, সমঝোতা চাই না- এ কথা বলি না। কিন্তু কিসের সমঝোতা, সে কথা আমাকে স্পষ্ট করে বলতে হবে! যদি এই সমঝোতা বলতে বোঝায়, বিএনপির কিছু অন্যায় দাবি, বিশেষ করে মৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনরুজ্জীবিত করার দাবির কাছে সরকারের মাথানত করা, তাহলে আমি পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, এ সমঝোতা আমি চাই না। আমি চাই দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন।
নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে আরো স্বাধীন ও শক্তিশালী করা, নির্বাচনের আইন আরো উন্নত করা ও দলীয় সরকারের কর্তৃত্ব আরো খর্ব করার ব্যবস্থা দরকার হলে করা হোক। এই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমেই দেশে রাজনৈতিক সমঝোতা আসতে পারে; বিএনপির সঙ্গে 'পলিসি অব এপিজমেন্টের' নীতি গ্রহণ করে নয়। আপনারা মিডিয়ার একটা বড় অংশ আওয়ামী লীগ সরকারকে সমঝোতার নামে এই পলিসি অব এপিজমেন্ট গ্রহণ করতে বলছেন। এই এপিজমেন্ট পলিসি অন্যায় আবদারের সঙ্গে আপস করা, সমঝোতা নয়।
টেলিভিশন প্রতিনিধি বললেন, তাহলে আপনার এই কথাগুলোই আমাদের টক শোতে এসে বলুন। বলেছি, মনের এই শোকার্ত অবস্থায় টক শোতে এসে সব কথা গুছিয়ে বলার অবস্থা আমার নেই। আমাকে শোক সামলে উঠতে একটু সময় দিন। আমি যে বর্তমান সমঝোতা চাই, সমঝোতা চাই এই 'হুক্কা হুয়া' রবে কণ্ঠ মেলাতে রাজি নই- এ কথা বলার সাহস আমার আছে এবং সময়মতো সে কথা বলব।
'কালের কণ্ঠ' থেকেও আমাকে অনুরোধ করা হয়েছিল, দেশে বড় দুটি দলের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন এবং এই সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই- এ মর্মে আমি যেন একটি কলাম লিখি। আমি তাদের অনুরোধ রক্ষা করতে পারলাম না। আমার এই সমঝোতাবিরোধী লেখাটি যদি তারা ছাপে, তাহলে বুঝব, তারা আমার স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকারকে সম্মান দেখিয়েছে। অবশ্য সে সম্মান এ যাবৎকাল 'কালের কণ্ঠ'-এর কাছ থেকে পেয়ে আসছি।
আমি সমালোচিত হতে, এমনকি মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু হতেও ভয় পাই না। তাই সমঝোতা চাই, সমঝোতা চাই- এই উদ্দেশ্যমূলক রেটোরিকের সঙ্গে গলা মেলাতে চাই না। আমি নির্দ্বিধায় বলছি, এই সমঝোতা চাই না। আমি চাই, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। এই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা কিছু করা দরকার, তা করা হোক। দেশের প্রকৃত দেশপ্রেমিক শ্রেণী, সম্প্রদায় ও সংগঠনগুলো সে জন্য ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলুক। কিন্তু পর্দার আড়ালের ও বিদেশিদের সালিসির মাধ্যমে অর্জিত সমঝোতা আমি চাই না। এই সমঝোতা টেকে না। এই সমঝোতা দেশের বা গণতন্ত্রের জন্য কোনো কল্যাণ বহন করে না। ১৯৩৯ সালে (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে) ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন তৎকালীন জার্মানির নাৎসি নেতা হিটলারকে তুষ্ট করার জন্য মিউনিখ চুক্তির নামে তাঁর সঙ্গে যে সমঝোতা করেছিলেন, তা ইউরোপকে একটি মহাযুদ্ধ ও ধ্বংসের তাণ্ডব থেকে বাঁচাতে পারেনি। এই মিউনিখ চুক্তিকে এখন এই বলে নিন্দা করা হয় যে, তোয়াজ ও মাথানত করার নীতির (Policy of appeasement) নিকৃষ্টতম দলিল।
অনেকে বলবেন, বাংলাদেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্যই দুটি বড় দলের মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন। বেশ তো, এই সমঝোতার জন্য ও নির্বাচন যথাসম্ভব সুষ্ঠু ও অবাধ করতে নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন প্রক্রিয়াকে আরো শক্তিশালী করার পন্থা তাঁরা উদ্ভাবন করুন। কিন্তু পরিত্যক্ত ও মৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বিএনপি গোঁ ধরেছে কেন? আর এই একতরফা অন্যায় জেদের কাছে আত্মসমর্পণ করাই কি সমঝোতা?
আমাদের দেশের এক শ্রেণীর কুবুদ্ধিজীবী (আমি তাদের বুদ্ধিজীবী বলি না) কুযুক্তি দেখাচ্ছেন, 'দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না।' পৃথিবীর কোন গণতান্ত্রিক দেশে দলীয় সরকারের বদলে তৃতীয় পক্ষকে (তথাকথিত নিরপেক্ষ) ক্ষমতায় এনে বসিয়ে নির্বাচন করা হয়? ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগেরই দাবির মুখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। তখন দেশে এক বিশেষ অবস্থা বিরাজ করছিল। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে একটার পর একটা নির্বাচনে, বিশেষ করে মাগুরা উপনির্বাচনে দিনেদুপুরে যে ভোটডাকাতি করেছে, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যে নির্লজ্জ প্রহসনের সাধারণ নির্বাচন করেছে, তাতে বিএনপির ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দেশে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে, এই বিশ্বাস শুধু আওয়ামী লীগ নয়, সব রাজনৈতিক দল, এমনকি বিএনপির প্রাণের দোসর জামায়াতও তা হারিয়ে ফেলেছিল। তারাও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির দাবি তুলেছিল। তখন একা বিএনপি ছিল এই দাবির বিরুদ্ধে।
১৯৯৬ সালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে একটি স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে সংবিধানে লিপিবদ্ধ করার দাবি তোলা হয়নি এবং তা করাও হয়নি। এটা ছিল বিশেষ পরিস্থিতিতে একটি সাময়িক ব্যবস্থা। অবস্থা স্বাভাবিক হলেই আবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থায় দেশ ফিরে যাবে- এটাই ছিল কথা। দেশ কি সেই অবস্থায় এখন ফিরে যায়নি?
২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনেই কি সব উপনির্বাচন, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ ইত্যাদির নির্বাচন হয়নি? কোথাও অনিয়ম বা ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছে কি? বিএনপি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার পরও অনেক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরেছে। সাবেক বিএনপি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত মাগুরা উপনির্বাচন বা ফেব্রুয়ারির (১৯৯৬) সাধারণ নির্বাচনের নির্লজ্জ প্রহসন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একবারও হতে দেখা যায়নি। তাহলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থায় ফিরে আসতে আপত্তিটা কী? সাংবিধানিক বিধানমতেই যেখানে সারা বিশ্বে বিরাজিত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রথায় ফিরে আসার কথা, সেই প্রথায় এখনই ফিরে আসায় আপত্তিটা কিসের?
বিএনপির বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে- এ কথা তাঁরা বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাস ও বাস্তবতা দুটি আলাদা কথা। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন হতে পারে না, এটা বিএনপির বিশ্বাস নয়, প্রচার। আর বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমান হাসিনা সরকারের আমলে ছোট-বড় কোনো নির্বাচনেই কারচুপির কোনো প্রমাণ নেই। তার পরও যদি সন্দেহ থাকে যে ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগ তার সুযোগ নিতে পারে, তাহলে সেই সুযোগ নেওয়ার ছিদ্রমুখগুলো বন্ধ করার ব্যবস্থা হওয়া দরকার।
সেই ব্যবস্থা অতীতের ব্যর্থ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন নয়, বরং ভারতের মতো নির্বাচন কমিশনকে আরো শক্তিশালী করা। নির্বাচন কমিশন যাতে ক্ষমতাসীন সরকারের সব ধরনের প্রভাব ও কর্তৃত্বমুক্ত হয়ে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারে তার নিশ্চিত ব্যবস্থা করা। এ জন্য প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি চাপ সৃষ্টি করতে পারে, বুদ্ধিজীবীদের সব মহল, সুশীল সমাজ প্রস্তাব ও সুপারিশ নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে, চাই কি দরকার হলে দেশময় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। তাতে আওয়ামী লীগ সরকার সাড়া না দিলে তখন তাদের উদ্দেশ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের আন্তরিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।
কিন্তু এই লক্ষ্যে কোনো মহলকেই কাজ করতে দেখা যাচ্ছে না বরং তারা সমঝোতা-সমঝোতা বলে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। এই সমঝোতা কিসের জন্য? সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য তো? কিন্তু সমঝোতাপন্থীদের চিৎকার শুনে তো মনে হচ্ছে, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা তাদের আর মাথায় নেই। তারা দুই নেত্রীর সমঝোতার স্লোগানের আড়ালে আওয়ামী লীগ যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন প্রশ্নে বিএনপির অন্যায় আবদার মেনে নেয়, তার মতলবে আছে। সেই সমঝোতা দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করুক আর নাই করুক, তাতে তাদের কিছু আসে-যায় না। তারা আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের আগেই বিএনপির কাছে নতজানু দেখতে চায়, যাতে নির্বাচনে বিএনপির বিজয় নিশ্চিত হয়।
নইলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা দ্বারা দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত হতে পারে- এ গ্যারান্টি তাদের কে দিল? তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কি দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান ও রাজনৈতিক সংঘাত বন্ধ করার একটি সফল ব্যবস্থা? অতীত কি বলে? এই পদ্ধতির ব্যর্থতার ফলেই কি এর আদি সমর্থক আওয়ামী লীগ এই ব্যবস্থা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়নি? সংবিধানে এই ব্যবস্থা বাতিল করা হয়নি?
অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি যে সফল হতে পারেনি, তার জন্যও মূলত দায়ী বিএনপি। ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সরকারের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে টেনেটুনে পাস করায় এবং ক্ষমতায় যাওয়ায় বিএনপি খুব একটা গণ্ডগোল করেনি। কিন্তু বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দলীয় রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে হাত করে সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ও সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে এই ব্যবস্থাটি বানচাল করার চেষ্টা চালায়। পরবর্তী সময়ে সাহাবুদ্দীন ও লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপরই বিএনপি কৌশলে ও তথাকথিত সুশীল সমাজের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সহায়তায় প্রভাব বিস্তার করে এবং তাঁদের আনুগত্য আদায় করে।
অধ্যাপক ইয়াজউদ্দীন আহাম্মেদ তো ছিলেন বিএনপির 'ক্রীতদাস-রাষ্ট্রপতি'র মতো। বেগম জিয়া ও হাওয়া ভবন কার্যত তাঁর সরকার চালাত। তাদের নির্দেশে ইয়াজউদ্দীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব ক্রেডিবিলিটি ধ্বংস করেন। তাঁর চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগে বাধ্য হন। এক সেনা কর্মকর্তা সমাবেশে ইয়াজউদ্দীন ঘোষণা করেন, তাঁর সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়; প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার। তিনি রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থেকে নিজেকে নিজে অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কফিনে তিনি শেষ পেরেকটি ঠুকে দেন। এক-এগারোর সেনা তাঁবেদার সরকারের ক্ষমতা দখলের পথ সুগম করে দেন। সেই সেনা তাঁবেদার সরকারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামটি গ্রহণ করে এবং দুই বছর এই নামের আড়ালে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকে। এর পর এই ব্যবস্থাটির সতীত্ব ও বৈধতা আর থাকেনি?
এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রেতাত্মাকেই আবার পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে বিএনপি। আসল লক্ষ্য দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করা। আর বিএনপির এই প্রচেষ্টাকেই কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো পরোক্ষভাবে সফল করার কাজে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, তথাকথিত সুশীল সমাজের মাথা ও এক শ্রেণীর সংঘবদ্ধ মিডিয়া। তারা মিলিতভাবে চিৎকার জুড়েছে, 'সমঝোতা চাই, সমঝোতা চাই।' আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, দেশে স্থিতিশীল গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই চিৎকার তারা জুড়েছে। একটু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যাবে, এই চিৎকারের উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগকে বিএনপির অন্যায় দাবির কাছে মাথা নত করানো। তাদের সমঝোতায় চিৎকার যদি দেশে গণতন্ত্র রক্ষা ও সংঘাত বন্ধ করার ইচ্ছা থেকে হতো, তাহলে সমঝোতার চিৎকারের বদলে তারা একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আরো নিশ্চিত ব্যবস্থা ও পন্থার কথা আলোচনা করত এবং তা মেনে নেওয়ার জন্য সরকারি ও বিরোধী উভয় দলের ওপরই চাপ সৃষ্টি করত।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে বিএনপি আশা করে তারা আবার সাহাবুদ্দীন, লতিফুর রহমান, ইয়াজউদ্দীনের মতো প্রধান উপদেষ্টার ক্ষমতা গ্রহণ সহজ করতে পারবে এবং তাদের আনুগত্য দখল অথবা ক্রয় করে সহজেই আবার নির্বাচনের নামে ২০০১ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারবে। শেখ হাসিনা এবার দৃঢ়তার সঙ্গে বিএনপির এই ষড়যন্ত্র রুখছেন এবং সমঝোতা চাই, সমঝোতা চাই বলে চিৎকাররত এক শ্রেণীর মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীর 'ওয়াসওয়াসা' সৃষ্টির ফাঁদে পা দিচ্ছেন না।
এই তথাকথিত সমঝোতাপন্থীদের এক দল যুক্তি দেখাচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না এবং দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হবে। আমি তাদের বলি, তিষ্ঠ ক্ষণকাল। এবারের নির্বাচনে অংশ নিলেই মাত্র বিএনপির অস্তিত্ব রক্ষা পেতে পারে। অংশ না নিলে এত গলাবাজি সত্ত্বেও বিএনপির অস্তিত্ব রক্ষা পাবে কি না, নাকি মুসলিম লীগের মতো বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে তাকে চিরবিদায় গ্রহণ করতে হয়, তা আমাদের দেখার রইল।
লন্ডন, ১৪ জানুয়ারি, সোমবার, ২০১৩

No comments

Powered by Blogger.