অর্থনীতির সাফল্য ধরে রাখতে মোকাবেলা করতে হবে চার চ্যালেঞ্জ by হামিদ-উজ-জামান মামুন

লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে ২০১৩ সালে অভ্যন্তরীণ চারটি বিষয়কে প্রধান বাধা হিসেবে দেখছে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। এগুলো হচ্ছে বিদ্যুত ও গ্যাস সরবরাহ পর্যাপ্ত না হওয়া, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ হার, কৃষি খাতে নিম্ন প্রবৃদ্ধি এবং রফতানি বৃদ্ধি না পাওয়া।
বাধাগুলো দূর করা না গেলে বর্তমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের চলমান ধারা ধরে রাখার পাশাপাশি আগামীতে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জন সংশয়ের মুখে পড়তে পারে। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে। এ প্রসঙ্গে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, ২০১৩ সালে অর্থনীতি কেমন যাবে? বিভিন্ন অর্থনীতি বিষয়ক সূচকের যে ইতিবাচক ধারা, তা অব্যাহত থাকবে কি না? অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো কী হতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, সামষ্টিক অর্থনীতি জটিল বিষয়। কারণ এখানে লাখ লাখ কুশীলব, যেমন ভোক্তা, উৎপাদক, বাজার, সরকারের নীতিপরিবেশ এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লের চলকসমূহ। চটজলদি ‘ভাল যাবে’ ‘খারাপ যাবে’ প্রক্ষেপণের উপায় নেই। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে খাদ্য-পণ্য জ্বালানি তেলের দামের ওঠানামা, ইউরোজোন, আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দার আকস্মিক কোন গতি, বাংলাদেশের অর্থনীতির কর্মসম্পাদনের সব হিসেব-নিকেশ ওলটপালট করে দিতে পারে। এই সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখেই আমাদের অর্থনীতির সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে অভ্যন্তরীণ এ চারটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।
প্রতিবেদন বলা হয়েছে, গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বিনিয়োগে গতিশীলতা আসছে না। কেননা চাহিদামতো বিদ্যুত সরবরাহ ও সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য বেড়েছে, তবে তা বর্ধিত চাহিদার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না, বিদ্যুত চাহিদা প্রতিবছর বাড়ছে প্রায় দশ শতাংশ হারে এবং তা বাড়তেই থাকবে। ৮ শতাংশ দেশজ আয় বাড়লে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে ১২ শতাংশ। গ্যাস সরবরাহ প্রান্তিকভাবে বেড়েছে, সামগ্রিক বর্ধিত চাহিদার তুলনায় তা নগণ্য। জ্বালানি নিরাপত্তা দেয়ার সক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে আমাদের বিনিয়োগে গতিশীলতা আসবে কিনা। সুখের বিষয় হলো, দেশে বিনিয়োগযোগ্য পুঁজির অভাব নেই, উদ্যোক্তাও রয়েছে। দেশে বিদ্যুত গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর প্রচেষ্টার সংঙ্গে আমাদের বিদ্যুত, গ্যাস আমদানির দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানে অতি উচ্চ সুদের হার কমিয়ে আনার বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে হবে। কেননা বিনিয়োগে গতিশীলতা আনয়নে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে কোন দেশের চেয়ে বিনিয়োগে বাংলাদেশে ব্যাংক সুদের হার অতি উচ্চ। এটি যেন প্রথাগতভাবেই বাংলাদেশে হয়ে আসছে। ১৮-২০ শতাংশ সুদের হারে বিনিয়োগ এবং তৎসহ কমপক্ষে ১০-১২ শতাংশ মুনাফা যোগ করলে পণ্য দাম কত উচ্চে উঠে যায় তা সহজেই অনুমেয়। আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি প্রবণতার এও বড় কারণ। অর্থনীতিকে গতিশীল করতে যে কোনভাবেই সুদের হার কমিয়ে আনার কোন বিকল্প নেই। অর্থনীতিকে গতিশীল ও স্পন্দমান রাখতে সুদের প্রকৃত হার কমিয়ে আনার কোন বিকল্প নেই। যেখানে এখন সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ৭.১৪ শতাংশ, সেখানে ১৮-২০ শতাংশ সুদের হার কোন যুক্তিতেই হতে পারে না।
চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে আমাদের কৃষি খাত। চালে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেলেও কৃষিতে ২০১২ আর্থিক বছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২.৫৩ শতাংশ। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রক্ষেপণ ছিল, প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে ৪.৫ শতাংশ, যা পূর্বের বছর অর্জিত হয়েছিল ৫.১৩ শতাংশ (৫.০ শতাংশ লক্ষ্যের বিপরীতে)। কৃষি খাতের এই নিম্ন প্রবৃদ্ধির কারণেই সমুদয় দেশজ প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬.৩২-৬.৫০ শতাংশে নেমে আসার কারণ ঘটেছে। কেননা গত আর্থিক বছরে শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধির হার লক্ষ্যের প্রায় কাছাকাছি অর্জিত হয়েছে। বর্তমান প্রযুক্তিগত সামর্থ্যরে মধ্যে কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট হচ্ছে। কৃষির সর্বক্ষেত্রে আমাদের প্রযুক্তিগত সামর্থ্য অবশ্যই বাড়াতে হবে। কেননা এখনও কৃষি উৎপাদনে আমরা ভারত, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার অনেক পেছনে। উন্নত জাতের শাক-সবজি, ফল উৎপাদনে আমাদের ব্যাপক প্রয়াস ও গবেষণা এবং সম্প্রসারণে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। জমি স্বল্পতায় আমাদের ফসল নিবিড়তা অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি। জমির অতি ব্যবহারে এর উর্বরতাও যথেষ্ট কমেছে। ফসলী জমির উর্বরতা বাড়ানো এবং যথাযোগ্য প্রযুক্তিতে অভিগম্যতা বৃদ্ধিতে আমাদের প্রচেষ্টা জোরদার করা প্রয়োজন। আমন ও আউশ জমিতে উন্নত ধান চাষের প্রচেষ্টা নেয়া ছাড়া চালে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখাই কঠিন হবে (২০ থেকে ২২ লাখ নতুন মুখ প্রতিবছর জনসংখ্যায় যুক্ত হচ্ছে)। পোল্ট্রি এবং পশু খাতের লালন-পালনকে এসএমই বিবেচনায় স্বল্পসুদে বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা নিতে হবে। এসবের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নয়নে প্রয়োজনে উন্নয়ন বরাদ্দে প্রকল্প গ্রহণকে উৎসাহিত করতে হবে।
অব্যাহত রফতানি বৃদ্ধির প্রবৃদ্ধি ছাড়া ৭ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জন অবশ্যই কঠিন হবে। জাপান, ভারত, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় আমাদের গার্মেন্টস বাজার সম্প্রসারণে অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করতে হবে। কেবল সস্তা শ্রমের সুবিধা নিয়ে ভবিষ্যতে গার্মেন্টস শিল্প টিকে থাকবে এমনটা আশা করা যায় না। কেননা মজুরির হার বাড়তে থাকবে এবং বাড়াতে হবে। প্রযুক্তিভিত্তিক অধিক উৎপাদন ও মান বাড়াতে হবে গার্মেন্টস পণ্যের। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের জিএসপি সুবিধা যাতে বাতিল না হয়, সে ব্যাপারে আগামী দিনগুলোতে অর্থনৈতিক কূটনীতিকে জোরদার করতেই হবে। আর যত দ্রুত সম্ভব টিকফা চুক্তি গ্রহণে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। কেবল বাংলাদেশের জন্যই নয়, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের চুক্তি রয়েছে এবং অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করছে।

No comments

Powered by Blogger.