শিবিরের তান্ডবের সময় পুলিশ কমিশনার ঘুমিয়ে ছিলেন- পুলিশের চরম দায়িত্বহীনতা

 রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে শিবিরের ভয়াবহ তান্ডবের সময় পুলিশের দায়িত্বে চরম অবহেলার অভিযোগ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে, ঘটনার রাত ৮টার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কয়েক উর্ধতন কর্মকর্তাসহ কয়েক শ' পুলিশ দায়িত্বে থাকলেও সংঘবদ্ধ শিবির ক্যাডাররা কিভাবে ঠা-া মাথায় তা-ব চালিয়ে ছাত্রলীগকর্মী ফারম্নক হোসেনকে নৃশংসভাবে খুন এবং অপর অর্ধশত ছাত্রলীগকর্মীকে কুপিয়ে-পিটিয়ে আহত করেছে। ওই রাতে ফারম্নকের লাশ গুমের পর শিবির ক্যাডাররা পুলিশের সঙ্গেও বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, রাতের অাঁধার কেটে যাবার আগেই সশস্ত্র শিবির ক্যাডাররা অস্ত্র নিয়ে নিরাপদে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেছে। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সভাতেও পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির বিষয়ে তদনত্মের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। গত সোমবার রাতের গভীরতার সঙ্গে পালস্না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশর্্ববতর্ী বিনোদপুর, কুখ ি, কাটাখালী, কাপাশিয়া, মেহেরচ ি প্রভৃতি এলাকায় শিবির ক্যাডাররা সমবেত হচ্ছে মর্মে শিক-কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পেয়ে তা রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনারকে (আরএমপি) অবহিত করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এম আব্দুস সোবহান। তখন কমিশনার নওশের আলী উপাচার্যকে আশ্বসত্ম করে বলেছিলেন, 'পুলিশ ক্যাম্পাসের প্রতিটি পয়েন্টে-হল গেটে সক্রিয় অবস্থানে রয়েছে। আপনার আশঙ্কার কোন কারণ নেই। শিবির বহিরাগত নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারবে না।' পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে শিবিরের একযোগে সশস্ত্র হামলা ও তা-বের খবর পেয়ে উপাচার্য পুলিশ কমিশনারের বাসায় ফোন করে জানতে পারেন, তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। সোমবার রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিবির ক্যাডারদের তা-বের সময় পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়ে বুধবার দুপুরে বাসভবনস্থ লাউঞ্জে বসে সাংবাদিকদের এভাবেই বর্ণনা করছিলেন উপাচার্যসহ প্রক্টর ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা। তাঁরা জানান, বিষয়টি আগেই পুলিশকে জানানো হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনেকে মনে করেন, ওই রাতে পুলিশ কমিশনারের আদেশ মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা ও অন্য সদস্যরা ঠিকমতো প্রতিপালন করেনি। হয়ত এখানে পুলিশের দায়িত্ব পালনে কোন গলদ ছিল।
জানা গেছে, সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় কতর্ৃপরে নিকট খবর আসে দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার জাফর বাবু, সালেকীন ও হামিমের নেতৃত্বে কয়েক শ' ক্যাডার বিনোদপুরে খোরশেদ নামের এক জামায়াত নেতার বাড়ির সামনে জড়ো হচ্ছে। বিনোদপুর এলাকা থেকে ফোনে বিশ্ববিদ্যালয় কতর্ৃপকে এ তথ্য জানানো হয়। এছাড়া শিবির ক্যাডার শাহীনের নেতৃত্বে শতাধিক বহিরাগত ক্যাডার বিশ্ববিদ্যালয় রেলওয়ে স্টেশনের কাছে এবং মেহেরচ ি ও বুথপাড়ায় শিবির ক্যাডাররা জড়ো হচ্ছে ক্যাম্পাসে ঢোকার জন্য_ এসব খবর পেয়ে তাৎণিক উপাচার্যকেও অবহিত করেন প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা। উপাচার্য বলেন, এসব খবর তিনি তাৎণিক পুলিশ কমিশনারকে অবহিত করেন এবং সংশিস্নষ্ট এলাকায় পুলিশ মোতায়েন, আবাসিক হলসহ ক্যাম্পাসের চারদিকের নিরাপত্তা জোরদারের অনুরোধ করেন। পুলিশ কমিশনার তখন ক্যাম্পাসের বঙ্গবন্ধু হলের সামনে অবস্থান করছিলেন। পুলিশ কমিশনার 'দেখছি' বলেও উপাচার্যকে আশ্বসত্ম করেছিলেন। উপাচার্য আরও বলেন, গত বছরের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিবির নেতা নিহতের ঘটনার পর থেকে ক্যাম্পাসের পুরো নিরাপত্তার দায়িত্ব পুলিশের হাতে দেয়া হয়েছিল। প্রশাসন থেকে যদি কোন নিরাপত্তার প্রয়োজন হয় সেেেত্র আরএমপির শীর্ষ কর্মকর্তাদের জানানো হতো। সেভাবেই পুলিশ ব্যবস্থা নিত।
উপাচার্য ড. এম আব্দুস সোবহান বলেন, রাত সাড়ে ১২টার দিকে ভিসি লাউঞ্জে বসে ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকায় শিবির ক্যাডারদের সমবেত হওয়ার বিষয়টি তিনি পুলিশ কমিশনারকে আবারও অবহিত করেন। তিনি (কমিশনার) তখনও আশ্বসত্ম করে বলেন, ক্যাম্পাস পুলিশের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। পুলিশ সজাগ রয়েছে, কোথাও কিছু ঘটবে না। পুলিশ কমিশনার ক্যাম্পাস থেকে বিদায় নেয়ার সময়ও উপাচার্যকে আশ্বসত্ম করে বলেছিলেন, 'রাতে কোন কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই।'
প্রত্যদর্শীরা জানায়, ওই রাতে পুলিশ কমিশনার ক্যাম্পাস ত্যাগের পর রাত অনুমান ১টার দিকে পুলিশের কয়েকটি গাড়িতে পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা কাজলা গেট দিয়ে বেরিয়ে যান। অতিরিক্ত পুলিশ ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গিয়েছিল বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কোন পুলিশ কর্মকর্তা আগে জানায়নি। উপাচার্য বলেন, পুলিশ ক্যাম্পাস ছেড়ে যাচ্ছে জানলে তিনি নিষেধ করতেন। সূত্র মতে, অতিরিক্ত পুলিশ ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাবার প্রায় আধঘণ্টা পর অনুমান রাত পৌনে ২টার দিকে সৈয়দ আমীর আলী হলের পিছন দিক, জোহা হলসংলগ্ন বধ্যভূমি, বিশ্ববিদ্যালয় রেলওয়ে স্টেশন, মেহেরচ-ির চারম্নকলা গেট দিয়ে কয়েক শ' সশস্ত্র শিবির ক্যাডার ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। সুযোগ বুঝে তারা কোথাও 'জয় বাংলা' সেস্নস্নাগান দেয়। তারা পাঁচটি গ্রম্নপে বিভক্ত হয়ে ক্যাম্পাসে হত্যাকা সহ ঘণ্টাব্যাপী নিরাপদে তা ব চালায়। পরে উপাচার্যের হসত্মেেপ অতিরিক্ত পুলিশ ক্যাম্পাসে আসলে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। এসব উপাচার্য লাউঞ্জে বসেই শুনতে পান।
প্রক্টর চৌধুরী জাকারিয়া বলেন, ঘটনার রাতে গোলাগুলির পর তাঁরা রাত ৪টার দিকে ফের শাহ মখদুম হলে যান। সেখানে পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) জাহাঙ্গীরসহ কয়েক পুলিশকে দেখতে পান এসএম হল গেটের কাছে। তারা কোন কথা বলছিলেন না। হলের দু'জন গার্ড তখন গেটে ছিল না। হলের টিভি রম্নমে গিয়ে তাঁরা দেখেন রক্তে মেঝে ভিজে রয়েছে। তারা আশঙ্কা করছিলেন কয়েক ঘণ্টা আগে যে ছাত্রদের তাঁরা রেখে যান, তাদের মধ্যে কেউ হয়ত নেই। ঘাতকরা তাদের কারও প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। সকালেই তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। রাতেই প্রক্টরসহ অন্যরা রক্তের দাগ অনুসরণ করে লাশ খোঁজার চেষ্টা করেন। ঘণ্টাখানেক কাটে এভাবেই। কোন লাশ না পেয়ে অন্য হলের অবস্থা দেখে ভোর সাড়ে ৫টার সময় তাঁরা ফেরেন উপাচার্যের লাউঞ্জে। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সৈয়দ আমীর আলী হলের দেিণর ম্যানহোল থেকে ফারম্নকের লাশ উদ্ধার করা হয়। এদিকে ঘটনার রাত ১টার দিকে আবাসিক হল এলাকা থেকে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা কেন চলে আসলেন এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রক্টর প্রফেসর চৌধুরী জাকারিয়া বলেন, 'পুলিশ আমাদের নিশ্চিত করেছিল যে পুরো ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।'
রাবি প্রশাসনের কর্মকর্তারা অভিযোগে বলেন, এসএম, সোহরাওয়াদর্ী, লতিফ ও আমীর আলী হলে নিয়োজিত পুলিশদের কেউ কোন দায়িত্ব পালন করেনি। এ চারটি হলেই শিবির তা ব চালিয়েছে ঘণ্টাব্যাপী। শুধুমাত্র জিয়া হলে প্রবেশের চেষ্টা করেও পুলিশের প্রবল বাধার মুখে শিবির ক্যাডাররা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। জিয়া হল গেটেও সমান সংখ্যক পুলিশ ছিল। কর্মকতর্াদের মতে, ফারম্নককে হত্যার পর লাশ গুমের এতটা সময় ঘাতকরা পেল কেমন করে। তাহলে এ সময় পুলিশ কোথায় কি করছিল, সে জবাব এখন পুলিশের কাছে নেই। মঙ্গলবার সরদার নুরম্নল আমিন সাংবাদিকদের বলেন, 'শিবির ক্যাডাররা যখন এসএম, আমীর আলী ও লতিফ হলে তা-ব চালাচ্ছিল তখন পুলিশ জিয়া হলে তলস্নাশি চালাচ্ছিল।'
রাজশাহীর প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকেই জামায়াতের আদর্শের অনুসারী। মহাজোট সরকার মতাসীন হলে তারা আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ে তদ্বির করে পোস্টিং নিয়েছেন। গত সোমবার দিবাগত রাতে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার নওশের আলীও রাত ১২টা পর্যনত্ম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছিলেন। এছাড়া উপ-কমিশনার সরদার নূরম্নল আমিন সারারাত ক্যাম্পাসে উপস্থিত থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের নেতৃত্ব দেন। ওই সময় এসব আবাসিক হল গেটে মোতায়েনকৃত ৬/৭ পুলিশের ভূমিকাও রহস্যজনক। তারা অদৃশ্য কারণে গেট ছেড়ে পালিয়ে যায় অথবা হামলাকারী শিবির ক্যাডারদের সহযোগিতা করে। অভিযোগ উঠেছে, যেসব পুলিশ হল গেটে মোতায়েন থাকে তাদের বেশিরভাগই জামায়াত-শিবির সমর্থক। হল শাখা শিবিরের নেতাকর্মীরা এসব পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন সময়ে চা-নাসত্মা সরবরাহ করে। এ পুলিশ সদস্যরা হল গেটে বসে শিবিরের সরবরাহ করা তাদের মতাদর্শের দৈনিক পত্রিকা পড়ে বলে ছাত্রলীগের একাধিক নেতা অভিযোগ করেন। শাহ মখদুম হলে শিবিরকর্মীরা ফারম্নক হোসেনকে খুন করার পর তার লাশ দায়িত্বরত গার্ডদের সামনেই প্রকাশ্যে টেনে হলের বাইরে সৈয়দ আমির আলী হলের মাঠের মধ্যে নিয়ে যায়। সেখান থেকে ফিরিয়ে এনে ম্যানহোলে ফেলে দেয়। হলের গার্ডদের মধ্যে বিগত জোট সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত ৫৪৪ কর্মচারী ছাড়াও জামায়াত শিবিরের সুবিধাভোগী রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) থাকাকালে বিএনপি নেতা হারম্নন অর রশিদ ও তার স্ত্রী আশিয়া আশরাফি পাপিয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগীতে পরিণত হয়েছিলেন। উপ-কমিশনার সরদার নূরম্নল আমিন একজন জামায়াত সমর্থক বলে তার সহকর্মীরা অভিযোগ করেছেন। তিনি '৯৫ সালের বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেন। জোট সরকারের আমলে তিনি জেএমবির বাংলা ভাইয়ের এলাকা নওগাঁর পুলিশ সুপার ছিলেন। এছাড়া ওয়ান ইলেভেনের পর তিনি নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ছিলেন। এ ছাড়া সহকারী পুলিশ কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম ও হুমায়ুন কবীর ২৫তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেন। এ দু'পুলিশ কর্মকর্তাও জামায়াত সমর্থক বলে ঐ ২৫তম বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া কয়েক পুলিশ কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন। জানা যায়, ঘটনার সময় আহত ছাত্রলীগকর্মীরা শিবিরের তা-ব থেকে বাঁচতে পুলিশের কাছে আকুতি করলেও পুলিশ বিন্দুমাত্র সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়নি। পুলিশের এসব অভিযোগের ব্যাপারে আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, দায়িত্বে পুলিশের অবহেলা থাকলে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারা কারা এ ঘটনায় জড়িত সে ব্যাপারে তদনত্ম করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.