তরুণদেরই আধিপত্য কাব্যগ্রন্থ বেশি, মোড়ক উন্মোচন শূন্যতার- বই মেলা প্রতিদিন

 ভাষার মাস ফেব্রম্নয়ারি। এ মাস এলেই বাঙালী অন্যরকম হয়ে যায়। স্বজনহারানোর বেদনায় আবেগাপস্নুত বাঙালী স্মৃতি রোমন্থনে ছুটে যায় শহীদ মিনারে ও একুশের বইমেলায়।
বীর শহীদদের রক্ত স্রোতে অর্জিত এর ভিতরে খোঁজে সানত্ম্বত্মনা। সেই শহীদদের শ্রদ্ধায় নিবেদিত অমর একুশের বইমেলা দশদিন পার করল বুধবার। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির প্রতিফলন এই মেলায় ইতোমধ্যে ১১১৫টি বই এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে কবিতার বই, ২৩৮টি। তার পরেই রয়েছে উপন্যাস ২১৭ টি ও গল্প ১৭৭টির স্থান। এবার তরম্নণ লেখকদের বই আসছে বেশি, আর তার মধ্যে কবিতার বই বেশি। তাই এদিন বেলাল চৌধুরী বললেন, কবিতা বাংলা ভাষার জননী। সব সময়ই মেলায় কবিতার বই বেশি আসে। নজরম্নল মঞ্চে তরম্নণ কবি জাহিদা উর্মির প্রথম কাব্যগ্রন্থ শূন্যতা'র মোড়ক উন্মোচন করে বেলাল চৌধুরী আরও বলেন, এখন তরম্নণরা বেশ ভাল লিখছে। জাহিদা উর্মির কথাই যদি বলি- এটি যে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বোঝার উপায় নেই। ৫৪ পৃষ্ঠার বইটিতে ৪৫টি উন্মাতাল হ্রস্ব নাতি হ্রস্ব কবিতা রয়েছে। আকার আকৃতিতে বিপুলায়তন না হলেও কবিতাগুলোর ছন্দে ছন্দে রয়েছে এক গভীর গোপন জ্বালা, আর্তি আর অভিমান। লেখার কোয়ালিটি দেখে মনে হয় তিনি বহুদিন যাবত লিখছেন। তিনি আরও বলেন, কবিতামাতৃক বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষের মুখের ভাষাতে পয়ারের টান রয়েছে। তবে আমাদের এই নবাগত কবির ৰেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বরং আরও একটু সুরেলাই মনে হয়েছে। কথোপকথনের ঢঙে রচিত তাঁর কবিতাগুলোতে ৰোভ, বিস্ময়, ক্রোধ পাশাপাশি উঠে এসেছে বয়নোচিত তারম্নণ্যের ঝলসানো দীপ্তিতে। 'আমাকে পোড়াতে দাও?' , 'সহজ উপায় বলি', 'তোমাকে ঘৃণা করি', 'বলো আমাকে ছাই হয়ে যাব নিমিষেই'_ এ ধরনের ক্যাজুয়াল উক্তি যে কবির কলমে, তাঁর মানসিকতা যে কতটা পরিণত তা বোধ করি বিশদ না বললেও চলে। আশা করি এ কবি সাহিত্যের অন্যান্য জগতেও বিচরণ করবেন। আমার বিশ্বাস তাঁর লেখনী আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবে।
এদিন ছুটির দিন না হলেও মেলায় পাঠক-দর্শনার্থীর ঢল নেমেছিল। যেন বসনত্মের আগমনী রং ছুঁয়ে গেছে সবাইকে। কাল বাদে পরশুই ঋতুরাজ বসনত্ম। যেন তারই আগমনী বার্তায় জেগে উঠেছে সবাই, তাই ছুটে আসছে মেলায়। এদিনও মেলায় বই এসেছে শতাধিক, ১১৫টি। যথারীতি কবিতাই বেশি, ৩০টি। এর পরে আছে উপন্যাস ও গল্প ২০টি করে, আর প্রবন্ধ ৬টি।
মোড়ক উন্মোচন ॥ এদিন মেলায় দু'ডজনেরও বেশি বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য ছিল কবি জাহিদা উর্মির কাব্যগ্রন্থ 'শূন্যতা'। এই বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন কবি বেলাল চৌধুরী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বেলাল মোহাম্মদ। আরও ছিলেন কবির স্বামী মইনুল ইসলাম চৌধুরী, গেস্নাব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের পরিচালক মিশাল আতিকউলস্নাহ খান, পরিচালক জিশাল আতিকউলস্নাহ খান, মিশাল আতিকউলস্নাহ খানের স্ত্রী নওশীন রহমান খান, মাহারোশ চৌধুরী, মেহ্বীশ চৌধুরী, নাসিম খান চৌধুরী, কিউ এস জামান, মনিরা জামান, জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়, গেস্নাব জনকন্ঠ শিল্প পরিবারের নির্বাহী পরিচালক মাহবুবুর রহমান, জিএম তোফায়েল আহমেদ, নজরম্নল ইসলাম, এম এ জাকির প্রমুখ। কবি জাহিদা উর্মি বলেন, এটি আমার প্রথম প্রকাশিত বই। এই কাব্যগ্রন্থটি আশা করছি পাঠক গ্রহণ করবেন। তবে আমি শুধু কবিতা নয়, সাহিত্যের অন্যান্য ৰেত্রেও বিচরণ করতে চাই। বর্তমানে নারী ও যুব সমাজের অবৰয় নিয়ে লিখছি। দেশের নানা সঙ্কট নিয়েও লেখালেখির আগ্রহ আছে। তবে সব কিছুর প্রকাশই ঘটবে সাহিত্যের মাধ্যমে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আমার বাবা, মা, স্বামী, সনত্মান ও ভাইবোনেরা সব সময়ই লেখালেখির জন্য আমাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের উৎসাহেই আমি এতদূর এসেছি। জাহিদা উর্মির বইটি এনেছে ঐতিহ্য প্রকাশনী।
দুই ভাষাসৈনিককে সংবর্ধনা দিল বাংলা একাডেমী ॥ মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলার দশম দিনে মেলার মূলমঞ্চে ঐতিহাসিক ভাষা-আন্দোলনে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন এবং ভাষাসৈনিক ড. সৈয়দ ইউসুফ হাসানকে সংবর্ধনা প্রদান করে বাংলা একাডেমী । সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। শুভেচ্ছা ভাষণ দেন কবি আসাদ চৌধুরী। সংবর্ধিত দুই বরেণ্য ব্যক্তির হাতে স্মারক উপহার তুলে দেন অনুষ্ঠানের সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী।
ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন বলেন, ভাষা একটি জাতির অসীম শক্তি। নিজের ভাষা না শিখলে আত্মনির্ভরশীল হওয়া যায় না। কোন ভাষাই ছোট নয়। সব ভাষার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। দেশকে দুনর্ীতিমুক্ত করে সমাজের সর্বসত্মরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
ভাষাসৈনিক ড. সৈয়দ ইউসুফ হাসান বলেন, ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা-আন্দোলনে যোগ দেয়াটা আমার কাছে এখনও স্বপ্নের মতো মনে হয়। আমি সবসময় গণতন্ত্রের প েকথা বলেছি এবং আমি মনে করি সকলেরই তা করা উচিত।
সভাপতির ভাষণে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বলেন, সব মহৎ সাহিত্যের পেছনে একটি ফিচার থাকে যা সে সমাজের নিষ্পেষিত ও নির্যাতিত মানুষের প।ে বাংলা সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। তিনি বলেন, মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেই মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ হওয়ার প্রথম সোপান হচ্ছে ভাষা। ভাষাই একমাত্র মাধ্যম যার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ হওয়া যায়।
স্বাগত ভাষণে শামসুজ্জামান খান বলেন, কোন ভাষাই ছোট কিংবা বড় নয়, সকল মাতৃভাষাই সমান। আর এটাই ছিল ভাষা-আন্দোলনের মূলকথা। কিন্তু পাকিসত্মানী শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। তিনি বলেন, আবদুল মতিন এবং ড. সৈয়দ ইউসুফ হাসান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মহান ভাষা-আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁরা শুধু মাতৃভাষাই প্রতিষ্ঠা করেননি, তাঁরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের ভিত্তিও স্থাপন করেছিলেন। ভাষা-সংগ্রামীরাই আমাদের হাজার বছরের গৌরবদীপ্ত পুরম্নষ। মহান এই দুই ভাষাসৈনিককে সংবর্ধিত করতে পেরে বাংলা একাডেমী একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। তিনি ভাষা-শহীদদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে খাঁটি দেশপ্রেমিক হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে ততদিন এই দুই মহান ব্যক্তি আমাদের কাছে চির অমস্নান হয়ে থাকবেন। তাঁরা শুধু ভাষার মুক্তি চাননি, তাঁরা সাধারণ গণমানুষের মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছেন। আমাদের জাতীয় বিভিন্ন সঙ্কটেও আমরা তাঁদের বিশেষ ভূমিকা রাখতে দেখেছি। সংবর্ধিত ভাষাসৈনিকদের বিভিন্ন কীর্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, আজকের এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে একাডেমী যেন এত যুগ পরে নিজের পায়ে দাঁড়াল। তিনি বলেন, আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যে উর্দু ভাষার বিপ েছিল তা নয়, বরং সকল ভাষার সমান অধিকারের ল্যে এই আন্দোলন গড়ে ওঠে। তিনি আরও বলেন, আমাদের সর্বসত্মরে বাংলা ভাষার প্রচলন এখনও পুরোপুরি চালু হয়নি। এই দায়িত্ব আমাদের নতুন প্রজন্মকেই নিতে হবে।
নতুন বই ॥ এদিন মেলায় নতুন বই এসেছে ১১৫টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কবিতার বই, ৩০টি। এর পরে আছে উপন্যাস ও গল্প ২০টি করে। এদিনের উলেস্নখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের রচনাবলী-১ এনেছে নালন্দা। সাহিত্য প্রকাশ এনেছে প্রীতি কুমার মিত্রর বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস ভাববিদ্রোহ। ঐতিহ্য এনেছে ইভান তুর্গেনিভের অনুবাদ গ্রন্থ আসিয়া ও নেসার আহমেদের নকশাল দ্রোহে নারী বই দু'টি।

No comments

Powered by Blogger.