অসমের এথনিক ক্লিনজিং বা বাঙালী হত্যা ও আমাদের শিক্ষণীয় by স্বদেশ রায়

জানুয়ারি মাসে অসম গিয়েই বুঝতে পেরেছিলাম সেখানে একটি বাঙালীবিরোধী সেন্টিমেন্ট কাজ করছে। আর এই বাঙালী বলতে তারা ধরে নিচ্ছে, এরা সকলেই বাংলাদেশ থেকে সেখানে অনুপ্রবেশ করেছে। আবার যারা উগ্র তারা বাঙালীও বলে না, তারা বলে বাংলাদেশের মুসলমান।


সেখানে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে, বাংলাদেশ থেকে অসমে অনুপ্রবেশ করার কোন কারণ নেই। কারণ নির্যাতন ও অর্থনৈতিক এই দুই কারণে মানুষ মাইগ্রেশান করে সাধারণত। বাংলাদেশে কোন মতেই বাংলাদেশী মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর কোন নির্যাতন নেই। এমনকি বর্তমান সরকারের আমলে সংখ্যালঘু কোন সম্প্রদায়ের ওপর কোন নির্যাতন নেই। তাই বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ করলে করবে এক মাত্র অর্থনৈতিক কারণে। সেখানে বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের জিডিপি প্রায় সাত শতাংশ অন্যদিকে অসমের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আমার মনে হয়েছে এ এলাকার জিডিপি বড়জোর ৪ শতাংশ হবে। তাহলে মানুষ কেন উচ্চ অর্থনীতি থেকে নিম্ন অর্থনীতিতে মাইগ্রেশান করবে।
যা হোক, তার পরেও যতটুকু দেখতে পাই তাতে বুঝতে পারি কিছু রাজনৈতিক দল, কিছু উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী গ্রুপ ও কিছু এনজিও এ কাজে মদদ দিচ্ছে। এমনকি এটাও মনে হয়েছিল কিছু ভালো এনজিও অবচেতনভাবে এ কাজে সহযোগিতা করছে। অর্থাৎ তারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পক্ষে কাজ করতে গিয়ে তাদেরকে অনেক বেশি গোষ্ঠীকেন্দ্রিক করে তুলছে। তাদেরকে বৃহৎ জাতিসত্তার অংশ ও বিশ্ব নাগরিক হবার থেকে দূরে থাকার পক্ষেই কাজ করছে।
অসমে সম্প্রতি সেই বাঙালী বা কারো কারো মতে মুসলিমবিরোধী মনোভাবের এক ন্যক্কারজনক বহির্প্রকাশ সারা পৃথিবী প্রত্যক্ষ করল। সেখানে বোড়ো ও বাঙালী দাঙ্গায় নিহত হয়েছে নারী শিশুসহ ৭০ জনের মতো। অন্যদিকে প্রায় চার লাখের মতো লোককে সরিয়ে আনতে হয়েছে দাঙ্গাকবলিত এলাকা থেকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং অসম পরিদর্শন করেছেন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ইতোমধ্যে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে ওই চার লাখ মানুষ পুনর্বাসনের জন্য। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টিকে মানবসৃষ্ট বিপর্যয় হিসেবে দেখছে। অসমেও কংগ্রেস সরকার তাই তাদেরও এ নিয়ে কোন ভিন্ন মত নেই। কিন্তু দাঙ্গাকারী বা দাঙ্গার মূল মদদদাতা বোড়ো লিবারেশন টাইগারের বক্তব্য তারা বিতাড়ন করছে বোড়ো অধ্যুষিত এলাকা থেকে বাঙালী মুসলিমকে। অন্যদিকে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রধান নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি বলছেন, সেখানে ভারতীয়রা বিদেশীদেরকে বিতাড়ন করছে। লালকৃষ্ণ আদভানি ও বোড়ো লিবারেশন টাইগারের বক্তব্য একই। অন্যদিকে অসমের কিছু বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে ইতোমধ্যে যে যোগাযোগের সুযোগ হয়েছে পাশাপাশি পত্রপত্রিকায় কিছু বুদ্ধিজীবীর বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, তারা মনে করছে এটা এথনিক ক্লিনজিং। এটা অসম থেকে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার একটা পাঁয়তারা।
অসমের এই বোড়ো ও বাঙালী সমস্যা আজকের নয়। অনেক আগের। ভারত সরকার বোড়ো লিবারেশন টাইগারের সঙ্গে একটি চুক্তি করে তাদের আলাদা কিছু সুবিধা ও ক্ষমতা দিয়ে একটি সমঝোতায় এসেছিল। তারপরেও এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি তারা মেটাতে পারেনি এবং যে পথে তারা এগুচ্ছে তাতে ভবিষ্যতেও যে পারবে সেটাও আশা করা সহজ নয়। কারণ, যেখানে তাদের সকলের ভারতীয় হয়ে ওঠার কথা সেখানে গত ষাট বছরে তারা সেটা পারেনি। বরং আঞ্চলিকতা, গোষ্ঠীগত পরিচয়, এমনি নানান কিছু সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী সেখানে ভারতীয় পরিচয়ের বাইরে নানানভাবে সংবিধানে তাদের আলাদা পরিচয় চাচ্ছে। এবং গত ষাট বছরে ভারত সরকারকে এ রকম বহু গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তি করতে হয়েছে। এখনও অনেকের সঙ্গে তাদের আলোচনা করতে হচ্ছে। তারপরেও সত্যিকার সুফল যেটা সেটা তারা পাচ্ছে না। বরং অসমে এই মানব সৃষ্ট বিপর্যয় ঘটেছে সোজা কথায় যাকে এথনিক ক্লিনজিংও বলা যায় সেটাই ঘটছে। ভারতে অনেক গবেষক আছেন। তাদের নিরপেক্ষ ও নির্মোহ অবস্থানে থেকে গবেষণা করারও সুযোগ আছে। তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে এর মূল কারণ নিয়ে অনেক লিখেছেন। তাদের সে লেখায়ও যেমন বলা হচ্ছে তেমনি সাধারণভাবেও বলা যায় ভারতের নাগরিকরা যতদিন না সকলে মিলে ভারতীয় হয়ে না উঠতে পারবে, যতদিন ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, ভাষাগত চেতনা তাদেরকে বিচ্ছিন্ন রাখবে ততদিন এমন সমস্যা তাদেরকে ভোগ করতে হবে। এবং বর্তমান ভারতের দুর্ভাগ্য, সেখানে ইতোমধ্যে অনেক রাজনৈতিক দল জন্মে গেছে, অনেক গোষ্ঠী জন্মে গেছে যারা এগুলোকে উস্কে দিচ্ছে।
তবে ভারতের অসম রাজ্যের এই এথনিক ক্লিনজিং বা মুসলিম হত্যা দেখার পরে বাংলাদেশের কয়েকটি বিষয় চিন্তা করার আছে। ভারতের বর্তমানের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির নেতৃত্বে সেখানে গুজরাটসহ কয়েক জায়গায় এ ধরনের এথনিক ক্লিনজিং হয়েছে। আবার তারা পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে অসমের এই মুসলিম হত্যাকে। বাংলাদেশেও ঠিক একই বিষয় ঘটেছিল ২০০১। বর্তমানে যারা প্রধান বিরোধী দল তাদের নেতৃত্বে এখানে এথনিক ক্লিনজিং হয়েছিল। চেষ্টা করা হয়েছিল হিন্দুদের বিতাড়ন করার।
তবে অসমের বর্তমান ঘটনার পরে বাংলাদেশের দায়িত্বশীল বুদ্ধিজীবী ও এনজিওদের একটি ভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা করা উচিত। এ মুহূর্তে ভারতে যে হত্যাকা- ও মানবিক বিপর্যয় হয়েছে সেটা কিন্তু একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে বিশেষ মর্যাদা দেবার ফলে তারা সেখানে অন্য কোন ভারতীয়র অবস্থান মেনে না নেবার ফল। বাংলাদেশে কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে দীর্ঘদিন সশস্ত্র পথে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা হয়েছে। দুই পক্ষের হাতেই তখন অস্ত্র ছিল। রক্তপাতও কম হয়নি। কিন্তু সে পথে সমস্যার সমাধান হয়নি। শেখ হাসিনা শান্তিপূর্ণ পথে তাদেরকে অস্ত্রের পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। কিন্তু তার পরেও সমস্যা কিছুটা থেকে গেছে। তারা এখনও অনেক কিছুর বিশেষ অধিকার চায়। অন্যদিকে এখন তাদের দাবি আবার সংবিধানে তাদেরকে নতুন অভিধায় স্বীকৃতি দেয়া।
এ নিয়ে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা নানান মতামত দিচ্ছেন। রাজনীতিবিদদেরও নানান মতামত আছে। তবে সংবিধানকে সব সময় ছোট ছোট স্বার্থে টেনে না আনাই ভালো। সংবিধান দেশ ও দেশের সকল মানুষের হওয়া উচিত। যেমন আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম করে দেশের একটি ধর্মের মানুষকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। এর ফল এখনও খারাপ এবং ভবিষ্যতে আরো খারাপ হবে। কারণ, সংবিধানকে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, গোষ্ঠী সকলের উর্ধে রাখা উচিত। তাছাড়া মনে রাখা উচিত কেন আমাদের এই সংবিধান। কার জন্যে এই সংবিধান, এই দেশ ও দেশের সকল মানুষের জন্যে। এ ক্ষেত্রে আমরা আমেরিকার সংবিধানকে লক্ষ্য করতে পারি। তাদের সংবিধান কিন্তু খুবই বড় দাগে আমেরিকা ও আমেরিকার নাগরিকের জন্যে। আর সেই সংবিধানের অধীনে থেকে সেখানে তারা কিন্তু আফ্রিকান আমেরিকান, ডাচ আমেরিকান, মেক্সিকান আমেরিকান, এশীয় আমেরিকান সকলে আমেরিকান। কেউ নিজেকে আলাদা করছে না। অতীতের কারো কোন পরিচয়ও তারা কখনও সংবিধানে লেখার দাবি করছে না।
পৃথিবীর পথ পরিক্রমায় মানুষ আধুনিক রাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে। এটা মানব সভ্যতার সফল। এই সভ্যতার পথ বেয়ে মানুষ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। তাই আধুনিক সভ্যতার সৃষ্টি এই রাষ্ট্রীয় সংবিধানে অতীতের পরিচয় টেনে আনার কোন প্রয়োজন থাকতে পারে না এবং তার কোন ভবিষ্যত সুফল থাকতে পারে না। বাংলাদেশের ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠীর বেড়া ভেঙ্গে এখন এই সত্যের দিকে এগিয়ে যাবার সময় হয়েছে যে, আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। সংবিধান যেভাবে নাগরিকত্বের পরিচয় দিচ্ছে এর বাইরে আলাদা পরিচয় আবার সংবিধানে লিপিবদ্ধ করার দাবি কখনও ভাল কিছু নয়। বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মানুষ নিয়ে এ দেশের যে সকল বুদ্ধিজীবী ও এনজিওরা কাজ করছেন তাদেরও এই সত্যটি বোঝা উচিত। কারণ, যাঁরা ধর্মের নামে রাজনীতি করছেন তাঁরা যেমন আমাদের দেশের ও সংবিধানের ক্ষতি করছেন যাঁরা গোষ্ঠীকে উসকে দিচ্ছেন তাঁরাও কিন্তু একই কাজ করছেন। যেমন এই গোষ্ঠীর কথা বলতে গেলে একটি অপ্রিয় কথা বলতে হয়, আমার ছোট ভাই সঞ্জীব দ্রং মাঝে মধ্যে নানান সংবাদপত্রে একটি কলাম লেখেন। তাঁর তিনি শিরোনাম দেন, ‘দেশহীন মানুষের কথা।’ সঞ্জীব অনেক বড় কাজে নিয়োজিত। কারণ, সমাজের ও রাষ্ট্রের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আনার কাজ তিনি করছেন। এ কাজ অনেক মহৎ। কিন্তু পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর কানে যদি তিনি এই শব্দ তুলে দেন, তারা দেশহীন মানুষ তাহলে সেটা কী তিনি ভাল কাজ করছেন! তাকেই বিষয়টি গভীরভাবে ভাবতে হবে। ভাবলে তিনিই দেখতে পাবেন সকলে মিলে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে ভবিষ্যতমুখী, সভ্যতামুখী হলে সেটাই সুফল দেয়। আমেরিকার কোন ভিন্ন গোষ্ঠী এখন আর ভাবে না তারা আমেরিকান নয়। বরং যে যেখান থেকে আসুক না কেন, তারা আমেরিকান। তাই আজ সেখানে ওবামা প্রেসিডেন্ট। আমরাও চারশ’ বছর অপেক্ষা করি। নিশ্চয়ই সঞ্জীবের কোন বংশধর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শুধু নয়, মূল রাজনৈতিক শক্তির মূল নেতা হবে। আমরা যদি অতীতমুখী না হয়ে ভবিষ্যতমুখী হই, আজ দেশের অবস্থা যাই হোক না কেন, ভবিষ্যত আমাদের জন্যে সেই সূর্যের আলো নিয়ে অপেক্ষা করছে। কারণ, মুক্তির যুদ্ধ অনেক দীর্ঘ। এই দীর্ঘ পথে আমি, তুমি বা আপনি হয়ত পৃথিবীতে থাকব না। বুদ্ধ বা কনফুসিয়াস পৃথিবীতে নেই। ওয়াশিংটন বা লেনিন পৃথিবীতে নেই। কিন্তু এটা সত্য পৃথিবী প্রতিদিন এগিয়ে চলেছে। পুরনো জমিদারবাড়ি জাদুঘর হয় কখনই ওই জমিদার বাড়ি আধুনিক সময়ের বাসযোগ্য বাড়ি হয় না।
আমাদের অনেক এনজিও আছে যারা বর্তমানের অর্থ লাভের জন্যে আমাদের পিছিয়ে পড়া কিছু নাগরিককে তারা বিভিন্ন গোষ্ঠীতে পরিণত করে রাখতে চাচ্ছে। তারা বৃহতের পায়ের তালে তাদের পা মেলাতে দিতে রাজি নয়। এমনকি তারা অতীতের পরিচয়কে আরও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সংবিধানে লিপিবদ্ধ করতে চায়। সংবিধানকে এত ক্ষুদ্রতার মধ্যে আনা ঠিক নয়। আমরা এই সংবিধান সৃষ্টির পর থেকে এ নিয়ে বড় বেশি কাটাকুটি করছি। সামরিক সরকাররা করেছে। এমনকি এক ব্যক্তির চাকরিতে ফেরার জন্যে অর্থাৎ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আবার প্রধান বিচারপতি হবেন রাষ্ট্রপতি থেকে সেজন্যও সংবিধান সংশোধন করেছি। আমাদের এই অভ্যাস বন্ধ করা দরকার। সংবিধানকে সংবিধান মনে করা উচিত। মনে করা উচিত এটা আধুনিক সভ্যতার পাথেয়। একে সঙ্গে নিয়েই আমাকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। অতীতের দিকে গিয়ে যত চেষ্টাই করি না কেন, তার ফল ভাল নয়। অসমের গোষ্ঠীর স্বার্থের নরহত্যা, শিশু হত্যা ও চার লাখের মতো মানুষ গৃহহারা হবার মতো একটি ঘটনা থেকে যদি আমরা এটুকু শিক্ষা না নেই তাহলে আমরা অন্ধ হিসেবেই বিবেচিত হব।
swadeshroy@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.