বিশ্বব্যাংকের ফেরার ঘোষণা দুই শর্তে

পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে ফিরবে বিশ্বব্যাংক, তবে তাদের দেওয়া দুটি পূর্বশর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে। এর একটি হলো- প্রকল্পের ক্রয়সংক্রান্ত কাজে অর্থায়নকারী সংস্থাগুলোর আরো বেশি তদারক নিশ্চিত করা; অন্যটি হলো- দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি 'স্বতন্ত্র প্যানেল' গঠন।


এ দুটি শর্ত পূরণ হলে সংস্থাটি পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন করবে। তবে দুর্নীতির ব্যাপারে তাদের কঠোর অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবে না বলেও সংস্থাটি জানিয়ে দিয়েছে।
গতকাল শুক্রবার ওয়াশিংটন থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার পদ্মা সেতু নতুনভাবে বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সম্মত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে : সেতুর নির্মাণকাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য প্রকল্পে নতুন ক্রয় ব্যবস্থায় অধিকতর ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেওয়া। এ ছাড়া সুষ্ঠু, অবাধ ও দ্রুত তদন্তকাজ চালিয়ে যাওয়া। একই সঙ্গে তদন্ত পর্যালোচনা করে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের কাছে এ-সংক্রান্ত তথ্য প্রদানের জন্য একটি স্বাধীন এক্সটারনাল প্যানেল গঠন করা।
যেসব বিষয়ে সরকার একমত হয়েছে, সেগুলোর সন্তোষজনক বাস্তবায়ন হলে এবং পরিচালনা পর্ষদের (গভর্নিং বডি) সমর্থন পেলে বিশ্বব্যাংক নতুন করে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হবে বলে বিবৃতিতে বলা হয়।
তবে এ বিষয়ে এখনো সরকারের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই বলা হয়নি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও গতকাল কিছু বলেননি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ঢাকার উদ্দেশে ওয়াশিংটন ছেড়েছেন। তাঁর সঙ্গেই বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ আপসরফা হয়েছে। তাই জানা গেছে, তিনি দেশে ফেরার পর তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেই সর্বশেষ অবস্থা জানাবেন অর্থমন্ত্রী মুহিত।
গত ২৯ জুন ২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে তাদের ১২০ কোটি ডলার ঋণ বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলেছিল, বিশ্বব্যাংকের তদন্ত শাখা পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ বাংলাদেশ সরকারের কাছে পেশ করে চারটি 'সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট' পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তা পূরণ করতে পারেনি। তাই সংস্থাটি ঋণ চুক্তি বাতিল করেছে। তবে বাতিলের পর বাংলাদেশ সরকার ওই পদক্ষেপগুলো পূরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংক বলেছে, দুর্নীতির যে প্রমাণ বিশ্বব্যাংক চিহ্নিত করেছে, সরকার এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছে। এ প্রকল্পে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন সব সরকারি ব্যক্তিকে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সরকারি দায়িত্ব থেকে ছুটি দেওয়া হয়েছে এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু তদন্ত চলছে।
ঋণ চুক্তি বাতিলের পর থেকেই বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সব শেষে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে সরকারি কাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ওয়াশিংটনে গিয়ে সরকারের এসব পদক্ষেপ বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে ব্যাখ্যা করেছেন। এতে বিশ্বব্যাংক আশ্বস্ত হয়েছে বলে বিবৃতিতে ইঙ্গিত রয়েছে।
সেই আলোচনার সূত্র ধরে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ব্যাখ্যা করার সময় বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংককে এ সেতুতে অর্থায়নের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করে। প্রকল্পটি নতুনভাবে বাস্তবায়নের জন্য আরো কিছু পূর্বশর্ত পূরণেও সরকার সম্মত হয়েছে।
সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা না থাকলেও বিশ্বব্যাংকের বহুল প্রতীক্ষিত এ বিবৃতিতে জনমনে ইতিবাচক সাড়া পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসার সিদ্ধান্তকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও স্বাগত জানিয়েছে। অর্থনীতিবিদরাও এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
যাঁকে বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসার সর্বশেষ বাধা হিসেবে বলা হচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রীর সেই অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পরই তিনি প্রতিক্রিয়া জানাবেন।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ফেরার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এর ফলে সেতুর অর্থায়ন নিয়ে সৃষ্ট 'অনিশ্চয়তার কালো মেঘ' কাটতে শুরু করেছে। গতকাল সকালে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় সোনতলা সেতু নির্মাণকাজের অগ্রগতি পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, দুই পক্ষের মধ্যে কিছু পদ্ধতিগত ও প্রক্রিয়াগত কাজ করতে হবে। এ জন্য অল্প কিছুদিন সময়ের প্রয়োজন হবে। বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদল এলে উভয় পক্ষের আলাপ-আলোচনার পর সেটা বোঝা যাবে।
সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ শুরুর যে প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, তা থেকে সরে আসার সুযোগ নেই। সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে বহু প্রত্যাশিত এ সেতুর মূল অবকাঠামোর নির্মাণ শুরু করতে চায়।
ঋণ চুক্তি বাতিলের আগে বিশ্বব্যাংকের তদন্ত শাখা সরকারকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছিল, সেগুলো হচ্ছে : প্রথমত, যেসব সরকারি কর্মকর্তা ও সরকারি ব্যক্তির (আমলা ও রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত) বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সরকারি দায়িত্ব থেকে তাঁদের ছুটিতে পাঠানো। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য বাংলাদেশের দুদকে একটি বিশেষ তদন্তদল নিয়োগ করা। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত বিশ্বব্যাংকের নিয়োগকৃত একটি প্যানেলের কাছে তদন্তসংশ্লিষ্ট সব তথ্যের পূর্ণ ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকারে সরকারের সম্মতি দেওয়া; যাতে করে এই প্যানেল তদন্তের অগ্রগতি, ব্যাপকতা ও সুষ্ঠুতার ব্যাপারে উন্নয়ন সহযোগীদের নির্দেশনা দিতে পারে। সর্বশেষ হচ্ছে, বিকল্প বাস্তবায়ন ব্যবস্থার বিষয়ে একমত হওয়া, যাতে বিশ্বব্যাংক ও অন্য তিন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা প্রকল্পের ক্রয় কর্মকাণ্ড আরো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পায়।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ব্যাপারে কোনো ছাড় দেবে না। এ ছাড়া যেকোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংস্থাটির কঠোর অবস্থানের কখনো পরিবর্তন হবে না। যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জনগণের জন্য অপার সম্ভাবনা ও সুপরিবর্তন আনবে। এ ছাড়া সরকারি অর্থের স্বচ্ছ ব্যবহার, প্রকল্পের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং একটি আধুনিক ও উন্নত মানের সেতু হবে, যা দেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে। এটি বাংলাদেশের জনগণের অধিকার ও প্রাপ্য।

No comments

Powered by Blogger.