সদরে অন্দরে-কোচিং বন্ধে নীতিমালা কোনো কাজে আসছে কি? by মোস্তফা হোসেইন

কচকচে নোট গুনছে কোচিং সেন্টারগুলো। এই নোট গোনা চলে সারা বছর। গমগম করে শিক্ষার্থীদের ভিড়ে সেন্টারগুলো। কত তাদের সংখ্যা? অবিশ্বাস্য ঠেকতে পারে, খোঁজ নিতে গেলে। ঢাকার ফার্মগেটে একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২ হাজার। এ তথ্য পাওয়া গেল সেখানকার এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে।

শান্তিনগরে একটি কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থীর সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও বেশি। বললেন ঢাকার নামকরা এক স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। দুটি প্রতিষ্ঠানেরই শাখা আছে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায়। বিভাগীয় শহরগুলোতে তো আছেই। প্রতিটি বড় জেলা শহরেও আছে একাধিক করে। সুতরাং এসব কোচিং সেন্টারে মোট শিক্ষার্থীর প্রকৃত সংখ্যা কত, সেই তথ্য বোধ করি সরকারের কাছেও নেই। এসব কোচিং সেন্টার সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বলা হয়, তারা ব্যবসা করছে। সংগত কারণেই প্রশ্ন আসে, আর দশটা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মতো তারাও কি সরকারি আইন-কানুন মেনে চলে? স্পষ্টত বলা দরকার, না, তারা কোনো আইনেরই অন্তর্ভুক্ত নয়। তারা তাদের চলার পথ নিজেরাই তৈরি করে নেয়। যে কোচিং সেন্টার যত দক্ষ চালক দ্বারা পরিচালিত, সেই কোচিং সেন্টারই তত সুনাম অর্জন করে, আর তাদের আয়-রোজগারও তেমনি আকাশছোঁয়া। এটা কি বিশ্বাস করা যায়, কোনো কোনো কোচিং সেন্টার ছাত্রপ্রতি এক লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করে থাকে? অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে, শিক্ষার্থীকে তারা আশ্বস্ত করে- কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ কিংবা বড় কোনো প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেবে। কিভাবে? নিশ্চয়ই মনে আসতে পারে, গত বছর কিংবা এর আগের দু-একবারের কথা। কয়েকটি কোচিং সেন্টার ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দিতে চেষ্টা করেছে? ধরাও পড়েছে একাধিকবার। এমন যারা করে, তাদেরই বড় অঙ্কের টাকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। অন্যরা ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণে যোগ্যতা অর্জনের আশ্বাস দিয়ে আদায় করে মাথাপিছু পাঁচ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির জন্য পরীক্ষা গ্রহণে সরকারি সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, এর পেছনে এসব কোচিং সেন্টারের ইন্ধন আছে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন। তাঁর এই অভিযোগ আমলে আনার প্রশ্নটি সংগত কারণেই জোরালো হয়ে পড়ে। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্তের ভালো দিকগুলো নিয়ে সরকারের প্রচারণা কম। নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তির যে চিন্তা করা হচ্ছে, সেই তথ্যটি সাধারণ্যে ব্যাপকভাবে প্রচারের প্রয়োজন আছে। মেধার ভিত্তিতে ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ তৈরি হবে- এটাই তো স্বাভাবিক।
কোচিং সেন্টারগুলোও সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেই পারে। কারণ নতুন নিয়মের কারণে তাদের ব্যবসায় ধস নামতে পারে। এর পরও কথা হচ্ছে, কোচিং ব্যবসা চলছে। তা বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের বাইরে রেখে যেমন চলছে, আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে কিংবা সহযোগিতায়ও চলছে। সরকার কোচিং-বাণিজ্যবিরোধী যে নীতিমালা তৈরি করেছে তার খবর কী? সরকারের এ নীতিমালার খবর দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দ্রুতগতিতে পৌঁছে গেছে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করার পর জানা সম্ভব হয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শিক্ষকদের নোটিশের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে সরকারের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। কিন্তু সেই নির্দেশনা কি শিক্ষকরা মেনে নিয়েছেন? জবাব হচ্ছে, কোনো শিক্ষকই সরকারের নীতিমালা মানছেন না। কোচিং বন্ধ করার জন্য যাঁরা সোচ্চার হয়েছেন, কেউ কেউ আদালতেও গিয়েছেন; তেমনি অভিভাবকদের ছেলেমেয়ে কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে লেখাপড়া চালানোর অভিযোগও আছে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠা কোচিং সেন্টারগুলো কোনো নীতিমালার আওতায় নেই বলে তারা কোচিং চালিয়ে যেতে পারছে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা কোচিং বন্ধ করছেন না কেন?
শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান সেলিম ভুঞার উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ হয়েছে, তাঁরা সরকারের এই নীতিমালা মানবেন না। অথচ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমপিওভুক্ত হোন কিংবা না হোন- কোনো শিক্ষকই কোচিংয়ে অংশ নিতে পারবেন না। সরকারি কিংবা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক কোচিং চালানোর কাজে নিয়োজিত হলে ওই শিক্ষককে সতর্ক করে দেওয়া, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বন্ধ করে দেওয়া, এমপিও স্থগিত কিংবা বাতিল, বেতন এক ধাপ অবনমন, বিভাগীয় মামলা এবং সাময়িক ও চূড়ান্ত বরখাস্ত করা হবে। এত কঠোর শাস্তির বিধান থাকার পরও শিক্ষকরা কোন শক্তিবলে সরকারের সিদ্ধান্ত অমান্য করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিতে পারেন?
ঢাকার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সিনিয়র একজন শিক্ষক এই নিবন্ধকারকে বলেছেন, তিনি গত নভেম্বর থেকে কোচিং কিংবা প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু ইচ্ছা করলে সেই পথ আঁকড়ে ধরে রাখতে পারতেন তিনি এবং সরকার তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারত না। তাঁর কথা, সরকার গৃহীত নীতিমালার মাধ্যমে এ ধরনের কাজের জন্য কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই নেওয়া যাবে না। আর যদিও নেওয়া হয়, তাহলে আদালতে তা টিকবে না। কারণ কোচিং বন্ধ করার জন্য সরকারের কোনো আইন নেই। আর নীতিমালার ভিত্তিতে কাউকে শাস্তি দেওয়াও আদালতে প্রত্যাখ্যাত হবে।
তবে শিক্ষানুরাগী ও নীতিবান শিক্ষক সবাই মনে করেন, দেশ থেকে কোচিং ও প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করতে পারলে শিক্ষার মান অনেক উন্নত হবে। তাঁদের যুক্তিগুলোও প্রণিধানযোগ্য। এ ক্ষেত্রে নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার বেঞ্জামিন কস্তার উদ্যোগ ও বক্তব্য স্মরণীয়। তাঁর বক্তব্য, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী যদি আন্তরিক হয় তাহলে কোনো শিক্ষার্থীরই প্রাইভেট পড়ার প্রয়োজন হবে না। বোঝা যায়, সরকারেরও তেমনটি লক্ষ্য।
ফাদার বেঞ্জামিন কস্তার বক্তব্য বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই কিছু বিষয়ে নজর দিতে হবে। সেগুলো হচ্ছে, শিক্ষাপদ্ধতি, কারিকুলাম ও সচেতনতাবোধ। একই সঙ্গে দেখতে হবে, কোন কোন কারণে একজন শিক্ষার্থীকে কোচিংনির্ভর হতে হয়। সেসব কারণ নির্ধারণ করে সেগুলো দূর করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
ধরা যাক, কারিকুলামের কথা। শ্রেণীকক্ষে পাঠ গ্রহণ করে কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠ সমাপ্ত করতে পারছে না বলেই তাকে কোচিংয়ে যেতে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে কাজ করে শিক্ষাকাল ও কারিকুলামের ব্যাপ্তি। সরকারের নীতিমালার দুর্বলতাও বড় একটি কারণ। যেমন স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড নির্ধারিত বইয়ের বাইরে অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা। এমনও দেখা গেছে, শিক্ষার্থীর ধারণক্ষমতার কথা চিন্তা না করে তার ওপর বইয়ের বোঝা অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যাক, আইডিয়াল স্কুলের প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের কথা। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড নির্ধারিত বই পড়ার পরও অতিরিক্ত চারটি বই পড়তে হয়। যার মধ্যে আরবিও একটি। তাকে আরবি শব্দ গঠন থেকে শুরু করে বাক্য গঠনও করতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড যেখানে একটি শিক্ষার্থীর ধারণক্ষমতা চিন্তা করে বই নির্ধারণ করে দিল, সেখানে অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা তাকে বইতে হবে কেন? সংগত কারণেই বাড়তি চাপ সীমিত সময়ের মধ্যে সামাল দেওয়া শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব হয় না।
অথচ স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড নির্ধারিত বই-ই যদি তাকে পড়ানো হতো, তাহলে শিক্ষাকালের মধ্যেই প্রতিটি শিক্ষার্থী সিলেবাস অনুযায়ী পাঠগ্রহণ শেষ করতে পারত। এমনটা হলে শিক্ষার মানও বৃদ্ধি পাবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাকালের স্বল্পতার কথা কেউ কেউ উল্লেখ করতে পারেন। বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৮৫ দিনের ছুটির বাইরেও পরীক্ষা, হরতাল-ধর্মঘট নানা কারণে অন্তত ৮০ থেকে ৯০ দিন শ্রেণীকক্ষে পাঠদান সম্ভব হয় না। ফলে শিক্ষার্থী ক্লাসে সময় পায় ২০০ দিনের মতো। এই সময়ে বাড়তি বইসহ কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠ সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। তখন তাকে বাধ্য হয়ে কোচিং কিংবা প্রাইভেটের মুখাপেক্ষী হতে হয়। কিন্তু কারিকুলাম কমে গেলে সেই অসুবিধা থাকবে না। এ ক্ষেত্রে স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড নির্ধারিত বইয়ের বাইরের চাপ বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই।
দ্বিতীয়ত কোচিং ও প্রাইভেট বন্ধ করতে হলে সরকারকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। নীতিমালা নয়, সংসদে আইন পাস করিয়ে নিতে হবে। যাতে প্রাইভেট কিংবা কোচিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারলে শিক্ষার মান বাড়বে এটা যেমন বলা যায়, তেমনি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকও হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন। যদি শিক্ষক প্রাইভেট পড়ানোর সুযোগ না পান, তাহলে তিনি শিক্ষার্থীর প্রতি অধিকতর নজর দিতে পারবেন। নিজ গ্রুপের কয়েকজনকে না দেখে তিনি গোটা ক্লাসকেই চিন্তা করবেন। ফলে মনোযোগ বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া, পরীক্ষার আগে সাজেশন দেওয়ার মতো কাজগুলো থেকে তিনি বিরত থাকবেন। ফলে শিক্ষার্থীর শিক্ষা প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.