ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় আরও ক্ষমতা চান ডিসিরা by মোশতাক আহমেদ

ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতা বৃদ্ধি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ারসহ মাঠ প্রশাসনে আরও নজরদারির ক্ষমতা চেয়ে প্রস্তাব পেশ করেছেন জেলা প্রশাসকেরা (ডিসি)। ডিসিরা অভিযোগ করেন, জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সার্বিক দায়িত্ব জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (ডিসি) ওপর ন্যস্ত থাকলেও অনেক সময়


তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ পাওয়া যায় না। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সরকারি সম্পদ সংরক্ষণ, উচ্ছেদ অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা বিঘ্নিত হয়। এ জন্য মাঠ পর্যায়ে পুলিশ বৃদ্ধিসহ জেলা প্রশাসনের চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় পুলিশ পাওয়া নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম হয় বলেও অভিযোগ করেন তাঁরা।
তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলনের শুরুর দিন গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের কাছে এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন ডিসিরা। সকালে সম্মেলনের উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী তাঁর কার্যালয়ে জেলা প্রশাসন বিষয়ে ডিসিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় প্রায় ১৫ জন ডিসি বক্তব্য দেন বলে জানা গেছে।
এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, অর্থ, স্বরাষ্ট্র, মুক্তিযুদ্ধ, পরিকল্পনা এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে আলাদা আলাদা বৈঠক করেন জেলা প্রশাসকেরা। এতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিবেরা উপস্থিত থেকে কথা বলেন এবং ডিসিদের কথা শোনেন।
বৈঠকে উপস্থিত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ডিসিরা ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন সংশোধনের প্রস্তাব করে বলেছেন, বিদ্যমান ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনে কেউ দোষ স্বীকার না করলে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হয়। এ জন্য অপরাধ আমলে নিয়ে বিচার করার ক্ষমতা রেখে এই আইন সংশোধন করা দরকার।
এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় পুলিশ-সংকটের কথা উল্লেখ করে মাঠ পর্যায়ে পুলিশ বাড়ানোর কথা বলেন তাঁরা। জেলা প্রশাসকেরা আদালত অবমাননা আইন সংশোধন দ্রুত কার্যকর করতে বলেছেন।
জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদসচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা গতকালকের আলোচনার কিছু বিষয় অবহিত করেন।
সূত্রমতে, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জনপ্রশাসন ও জনপ্রতিধিদের সমন্বয়ে কাজ করতে ডিসিদের প্রতি আহ্বান জানান। ডিসিরা ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি দ্রুত সম্পন্ন করার সুপারিশ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর সেখানেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বিষয়ে সভা করেন ডিসিরা। এখানে উপজেলা তথ্য ও সেবাকেন্দ্র স্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানোসহ বেশ কিছু বিষয় আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়।
শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ: বিকেলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা—এই দুই মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কে ডিসিরা ১৬টি ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কে ছয়টি সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের প্রস্তাব দেন। সভায় ডিসিদের পক্ষে বলা হয়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি ভালো হলেও বেসরকারি স্কুল-কলেজে নিয়োগ-বাণিজ্য হয়। এ জন্য তাঁরা এসব প্রতিষ্ঠানেও প্রাথমিকের মতো শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব দেন। তাঁরা জেলা প্রশাসককে প্রধান করে নিয়োগ বোর্ড গঠন অথবা কেন্দ্রীয় সার্ভিস গঠনের প্রস্তাব করেন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির প্রধান হিসেবে সরকারি কর্মকর্তাদের মনোনয়ন দেওয়া, সভাপতির ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণসহ আরও কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেন তাঁরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এ দুটি প্রস্তাবের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে হবে। তার পরও এ-সংক্রান্ত প্রবিধানমালা পরীক্ষা করে দেখা হবে। সভায় ডিসিরা বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে শিক্ষকদের প্রেষণে নিয়োগ দেওয়ার বিরোধিতা করেছেন।
সভা শেষে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ডিসিরা বিভিন্ন সুপারিশ করেছেন, এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিচালনা কমিটির সভাপতি পদের ন্যূনতম যোগ্যতার বিষয়ে সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে তিনি বলেন, অনেক ব্যক্তি আছেন, যাঁরা শিক্ষানুরাগী কিন্তু ডিগ্রি নেই। এগুলোও ভাবতে হবে। সভায় শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা বাস্তবায়নে ডিসিদের ভূমিকা রাখার বিষয়টিও উল্লেখ করেন মন্ত্রী।
পঞ্চম শ্রেণী ছাড়া প্রাথমিকের অন্যান্য শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা একই তারিখে ও একই প্রশ্নপত্রে সমগ্র জেলায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির মাধ্যমে নেওয়ার প্রস্তাব করেন ডিসিরা। এ সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফছারুল আমীনও বক্তব্য দেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত আলোচনায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতা বৃদ্ধি, তাৎক্ষণিকভাবে জেলা প্রশাসন পুলিশ না পাওয়াসহ ৩২টি সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের প্রস্তাব তুলে ধরেন ডিসিরা। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়টিও আলোচনায় আসে। ডিসিরা বলেন, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বৃদ্ধি, এক সীমান্তচৌকি (বিওপি) থেকে আরেক সীমান্তচৌকির মধ্যবর্তী স্থানে পোস্ট বা ক্যাম্প এবং নতুন সীমান্তচৌকি স্থাপন ও সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে অনুপ্রবেশ রোধ করা সম্ভব। সভায় মাদকের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপ জোরদার করার বিষয়ে আলোচনা হয়।
একই সঙ্গে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের বিধানের লঙ্ঘনের দায়ে জরিমানা বৃদ্ধি, ভ্রাম্যমাণ আদালত কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য মন্ত্রণালয়ে পৃথক সেল বা অধিশাখা খোলার প্রস্তাব করেন ডিসিরা। সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু উপস্থিত ছিলেন।
সভা শেষে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন বিষয়ে ডিসি-এসপিদের একসঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছি। ডিসিরা মাদকের কথা বলেছেন। আমরা তাদের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছি।’ আর পুলিশ না পাওয়ার অভিযোগ ঠিক নয় বলে দাবি করেন প্রতিমন্ত্রী।
অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কে ডিসিদের এক প্রস্তাবে বলা হয়, উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ অনেক সময় অর্থবছরের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে ছাড় করা হয়। এতে প্রকল্প বাস্তবায়ন যেমন দুরূহ হয়, তেমনি অর্থ অপচয়ের আশঙ্কা থাকে। সভায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান বক্তব্য দেন।

No comments

Powered by Blogger.