বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৮৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ আজিজুল হক, বীর বিক্রম অলক্ষ্যের সাহসী এক বীর যোদ্ধা ১৯৭১ সালে আজিজুল হকের মা-বাবা ও তাঁর স্ত্রী জানতেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। দেশের জন্য যুদ্ধ করছেন। সুবেদার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর দলে আছেন।


কিন্তু তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জানতেন না, তিনি সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জানতে পারেন, আজিজুল হক বগাদিয়ায় এক যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। সহযোদ্ধারা তাঁর মরদেহ উদ্ধার করতে পারেননি। কোথায় তিনি সমাহিত, কেউ জানেন না। পরিবারের সদস্যরা পরে খোঁজ করেও তাঁর কবর খুঁজে পাননি।
তারপর সময় গড়াতে থাকে। ১৯৭৩ সালে সরকার ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে অসীম সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য বীরত্বসূচক খেতাব প্রদান করে। মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হক বীর বিক্রম খেতাব পান। কিন্তু এই খবর তাঁর পরিবারের সদস্যরা ২০১১ সালের আগ পর্যন্ত জানতেন না। জনতা ব্যাংকের সংগৃহীত তথ্যে জানা যায় তিনি বীর বিক্রম খেতাব পেয়েছেন।
১৯৯২ সালের ১৫ ডিসেম্বর সরকার প্রথম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের আনুষ্ঠানিকভাবে পদক প্রদান করে। এই অনুষ্ঠানের আগে সরকারিভাবে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজখবর শুরু হয়। ১৯৭৩ সালে গেজেটে বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধার ঠিকানা ছিল না। এরপর ১৯৯৬ ও ১৯৯৮ সালে সরকার আবার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ প্রদান করে। ২০০৪ সালে সরকার ঠিকানাসংবলিত নতুন গেজেট প্রকাশ করে। তখন ৬৬ জন খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওই তালিকায় ছিলেন শহীদ আজিজুল হক।
মুজাহিদ বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আজিজুল হক ১৯৭১ সালে বাড়িতে কৃষি কাজ করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি আর বসে থাকেননি, ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে লুৎফর রহমান নিজের চেষ্টায় নোয়াখালীতে আলাদা একটি বাহিনী গঠন করেন। লুৎফর রহমান ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার। মার্চ মাসে ছুটিতে বাড়িতে ছিলেন। আজিজুল হক তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। লুৎফর রহমানের বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ভেতরে থেকেই নোয়াখালী জেলার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেন। বগাদিয়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লুৎফর রহমানের বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকবার সম্মুখ যুদ্ধ করেন। কোনো এক যুদ্ধে আজিজুল হক শহীদ হন।
সোনাইমুড়ী উপজেলার দক্ষিণে বগাদিয়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় বগাদিয়া মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উভয়ের কাছে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বগাদিয়া সেতুর নিচ দিয়ে নৌকায় করে মুক্তিযোদ্ধারা কানকিরহাট হয়ে ভারতে যাওয়া আসা করতেন। সে জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বগাদিয়ার ওপর কড়া নজর রাখত। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের কড়া নজর উপেক্ষা করে কয়েকবার ওই সেতু ধ্বংস করেন এবং কয়েকবার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর টহল দলের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হন। বেশির ভাগ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীই ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। দুই-তিনবার মুক্তিযোদ্ধাদেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য শহীদ আজিজুল হককে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১০৭।
শহীদ আজিজুল হকের পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার সদর উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের সফিপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মমতাজ মিয়া। মা জমিলা খাতুন। স্ত্রী আংকুরের নেছা। তাঁর ছেলে নেই। তিন মেয়ে। আংকুরের নেছা স্বামীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান। তবে আর্থিকভাবে তিনি বেশ অসচ্ছল। শহীদ আজিজুল হকের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: প্রথম আলোর নোয়াখালী প্রতিনিধি মাহবুবুর রহমান, ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, নবম ও দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.