২৮ টাকা কেজি দরে চাল কিনবে সরকার

লতি আমন মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে দুই লাখ টন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রতি কেজি চালের জন্য কৃষকেরা পাবেন ২৮ টাকা। চাষিদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য আমনের চাল সংগ্রহের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক গতকাল সোমবার সচিবালয়ে তাঁর নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। তিনি জানান, চাল সংগ্রহের কাজ আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে।

চাল সংগ্রহ শুরু করতে এরই মধ্যে জেলাপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সরকারিভাবে চাল কেনার উদ্যোগের খবরে খুশি কৃষকেরা। বিশ্লেষকেরাও উদ্যোগটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তাঁরা বলছেন, চলতি মৌসুমে ন্যায্য দাম না পেয়ে আগামী বোরো মৌসুমে ধান চাষ করা নিয়ে কৃষকদের মধ্যে যে হতাশা তৈরি হয়েছিল, তা কিছুটা কমবে।
সাধারণত আমন ওঠার আগের সময়টা অর্থাৎ নভেম্বর মাসে ধান-চালের দাম চড়া থাকে। ডিসেম্বরে নতুন ধান উঠলে দাম বাড়তে শুরু করে। কিন্তু এ বছরের চিত্র উল্টো। চালের দাম কমতে শুরু করে। এ কারণে আমন ধানের উৎপাদন খরচ ও বাজারদর সমান হয়ে যায়। আর লোকসানের আশঙ্কায় পড়েন কৃষকেরা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর প্রতি কেজি আমন ধান চাষ করতে কৃষককে ১৬ টাকা ৫০ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। আর ধান থেকে চাল করতে গেলে খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ থেকে ২৫ টাকা। মূলত ইউরিয়া সার ও কৃষি মজুরের দাম বাড়ায় গত বছরের তুলনায় উৎপাদন খরচ এবার দুই টাকা ৭৫ পয়সা বেড়ে যায়।
উৎপাদন খরচ বাড়লেও ধানের দাম বাড়েনি। অন্যান্য বছরের তুলনায় কম দামে ধান বিক্রি হয়। দেশের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি মণ ধান ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। অথচ সরকারি হিসাবে প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ ৫৬০ টাকা। সে তুলনায় গত বছর প্রতি মণ ধানে ৫০০ টাকা খরচ করে মৌসুমের শুরুতেই কৃষকেরা ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় ধান বিক্রি করেছেন।
কৃষকেরা যা বলেন: কুষ্টিয়া সদরের বারুইপাড়া গ্রামের কৃষক লালু সরদার জানান, বাজারে প্রতি মণ ধান ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি মণ ধানে চাল হয়েছে ২৫ কেজি। সে হিসাবে সরকার ২৮ টাকা করে চাল কিনলে কৃষকের লাভ হবে। তবে চাল যেন সরাসরি কৃষকের কাছ থেকেই কেনা হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা বলেন তিনি।
নওগাঁর আত্রাই উপজেলার সাহাগোলা গ্রামের কৃষক আবদুর রশিদ জানান, চাল কেনার এ ঘোষণা অন্তত আরও তিন সপ্তাহ আগে দেওয়া উচিত ছিল। কারণ, অনেক কৃষকের ঘরেই এখন বিক্রি করার মতো চালের মজুদ নেই। লোকসানে চাল বিক্রি করেছেন তাঁরা।
রানীনগর উপজেলার শফিকপুর গ্রামের কৃষক রাজন শেখ জানান, সরকারিভাবে যেহেতু চালের দাম বাড়ানো হয়েছে, তাই বাজারে ধানের দাম বেড়ে যাবে। এতে কৃষকেরা কিছুটা হলেও উপকৃত হবেন।
কেন ধান কেনা নয়: ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব হোসেন গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, এ ক্ষেত্রে সাধারণ কৃষকেরা খুব একটা লাভবান হবেন না। মিল থেকে ভাঙিয়ে বিক্রি করতে পারবেন বড় কৃষকেরা। তা ছাড়া অনেক মিলমালিকও কৃষক সেজে সরকারের কাছে চাল বিক্রির সুযোগটা কাজে লাগাবেন। তিনি আরও বলেন, সরকার ধান কিনতে পারলে ভালো হতো। এর ফলে সব ধরনের কৃষকই সরকারের এই উদ্যোগের সুফল পেতেন।
ধান বাদ দিয়ে কেন চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে, জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, অনেক সময় অগ্রিম টাকা নিয়েও কৃষকেরা পরে ধান সরবরাহ করেন না। তা ছাড়া গুদামে রাখার জন্য ধান যে পরিমাণ শুষ্ক থাকা উচিত, সেভাবে কৃষকেরা ধান সরবরাহ করেন না। সে কারণেও তাঁদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।
তবে এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে মাহবুব হোসেন বলেন, খুব একটা সেচ লাগে না বলে আমনে মূলত শুকনো ধানই আসে। তা ছাড়া এ ধান মাঠেই শুকানো হয়। তাই ধান কিনলে সরকারের কোনো ক্ষতি হতো না, যেটা বোরোর ক্ষেত্রে হয়।
মাহবুব হোসেন বলেন, চাল সংগ্রহের পরিমাণ বেশি হলে বাজারে এর প্রভাব থাকত। কিন্তু এই সামান্য পরিমাণ চাল সংগ্রহ করে বাজারে কোনো প্রভাব ফেলা সম্ভব নয়।
একই মন্তব্য করেছেন দেশের অন্যতম বড় চালকল কুষ্টিয়ার রশিদ এগ্রো-প্রোডাক্টস লিমিটেডের মালিক আবদুর রশিদ। তিনি প্রথম আলোকে জানান, কৃষকের কাছ থেকে চাল কেনার সিদ্ধান্তটা ভালো। তবে এর ফলে চালের বাজারে তেমন প্রভাব পড়বে না। দুই লাখ টন চাল সংগ্রহকে নিতান্তই যৎসামান্য বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চাল সংগ্রহের প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী জানান, বর্তমানে ১৪ লাখ ৪৩ হাজার টন চাল ও গম মজুদ আছে। এর মধ্যে ১১ লাখ ৫৩ হাজার টন চাল ও দুই লাখ ৯০ হাজার টন গম। আরও ৪২ হাজার টন চাল ও এক লাখ ৬০ হাজার টন গম আসার পথে রয়েছে। গুদামে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টন মজুদের ব্যবস্থা আছে। তিনি বলেন, কোনো ধরনের দুর্যোগ না হলে আগামী জুন পর্যন্ত চাল আমদানি করতে হবে না। এর পরও যদি প্রয়োজন হয়, তবে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হবে। (প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কুষ্টিয়া ও নওগাঁ প্রতিনিধি)

No comments

Powered by Blogger.