আওয়ামী লীগ নেতার সিমকার্ড ঘিরে রহস্য-টিপ্পন-সেলিম জড়িত জিজ্ঞাসাবাদ চলছে by শাহেদ চৌধুরী,পিনাকি দাসগুপ্ত ও প্রীতিরঞ্জন সাহা

রসিংদী পৌরসভার জনপ্রিয় মেয়র, শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন হত্যারহস্যের জট একটু একটু করে খুলতে শুরু করেছে। গ্রেফতারকৃত দুই আসামি কাজী মাসুদ ওরফে টিপ্পন কাজী ওরফে পংকা ও হাজি মোহাম্মদ সেলিম পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকা ের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। হত্যার আগের-পরের নানান বর্ণনা দিলেও উভয়েই অবশ্য সরাসরি জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন।


নরসিংদীর পেশাদার খুনি টিপ্পনকে গতকাল আট দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। এর আগের দিন সেলিমকে চারদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে টিপ্পন জানান, লোকমান হত্যাকাণ্ডে চার পেশাদার কিলার সরাসরি অংশ নেয়। এদিকে রোববার শহরের ভেলানগর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। পিস্তলটি হত্যাকা ে ব্যবহৃত হয়েছে কি-না খতিয়ে দেখছে পুলিশ। অন্যদিকে হত্যাপরিকল্পনাকারীদের অন্যতম স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোবারক হোসেন ওরফে মোবাকে মালয়েশিয়া থেকে ফিরিয়ে আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। সূত্র জানিয়েছে, লোকমান হত্যার চূড়ান্ত ছক কষে দিয়ে পাঁচ দিন আগে দেশ ত্যাগ করেন মোবা। ২৭ অক্টোবর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে দেশ ত্যাগ করেন তিনি। হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়ন ও সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়ে যান টিপ্পনকে। খুনিদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রক্ষার জন্য মোবা নিজের একটি মোবাইল ফোন সিমও দিয়ে যান।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি আসাদুজ্জামান সমকালকে বলেন, গ্রেফতারকৃতদের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তদন্তাধীন বিষয় হওয়ায় আগাম কিছু বলতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।
জানা গেছে, টিপ্পন ও সেলিম এ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি না হলেও হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের সূত্র ধরে তারা গ্রেফতার হন। অবশ্য চৌদ্দ দিনেও এজাহারভুক্ত কোনো আসামিকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। মোবা লোকমান হত্যা মামলায় তিন নম্বর আসামি। তিনি নরসিংদী পৌর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। মোবার নির্দেশে একটি (কুমিল্লা হ-১১-৩১৫২, বাজাজ, সিলভার রঙ, ১২৫ সিসি) মোটরসাইকেল টিপ্পনকে সরবরাহ করেছিলেন টঙ্গীর মোটরসাইকেল গ্যারেজ মালিক হাজি সেলিম। মোবার ভাইয়ের মেয়ের জামাই এই হাজি সেলিম। লোকমান হত্যাকাণ্ডের পর ৭৩টি মোটরসাইকেল আটক করে নরসিংদী মডেল থানা পুলিশ।
নরসিংদী পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদউদ্দিন সমকালকে বলেন, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তিনি আশাবাদী শিগগিরই হত্যারহস্য উদ্ঘাটন ও অন্য আসামিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। মহিদ আরও বলেন, টিপ্পন ও সেলিম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। টিপ্পন দুই মামলায় ১৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। তিন মাস কারাভোগের পর তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান।
মামলার তদন্ত সূত্র জানায়, গ্রেফতারের পর টিপ্পন ও সেলিমকে পরস্পরের মুখোমুখি করা হয়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার তদন্তের স্বার্থে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তদন্ত সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া খুনিদের গ্রেফতারের ওপরই বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ বলছে, খুনিদের গ্রেফতার করা গেলে নেপথ্য গডফাদারদের চিহ্নিত করা সম্ভব।
সোমবার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিতাই চন্দ্র সাহার এজলাসে টিপ্পনকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদনে পুলিশের সিএসআই আশরাফুল আলম বিশ্বাস ও আনোয়ার হোসেন বলেছেন, টিপ্পনকে গ্রেফতারের পর হাজি মোহাম্মদ সেলিম তাকে শনাক্ত করেন। টিপ্পন জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডে খুনিরা একটি মোটরসাইকেল ব্যবহার করে। হত্যাকাণ্ডের পর খুনিরা পালিয়ে যাওয়ার সময় স্টার্ট না নেওয়ার কারণে মোটরসাইকেলটি ঘটনাস্থল জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের কাছাকাছি জায়গায় ফেলে রেখে চলে যায়। মোটরসাইকেলটি ২৯ অক্টোবর টিপ্পন টঙ্গী থেকে নরংসিদীতে নিয়ে যান। ওই দিন সকালে টিপ্পন তার মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। পরে সেলিম মোবাইল ফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে মোবার নির্দেশে মোটরসাইকেলটি দেন। পরে মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে টঙ্গী থেকে ওই মোটরসাইকেলেই নরসিংদী যান টিপ্পন।
জিজ্ঞাসাবাদে হাজি সেলিম জানান, তার চাচা শ্বশুর মোবারক হোসেন মোবা তাকে বলেন, তার একটি ভালো মোটরসাইকেল (রেজিস্ট্রেশনবিহীন) দরকার। তিনি জরুরি প্রয়োজনে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। মোবা আরও বলেন, 'আমার মোবাইল সিমটি টিপ্পন নামের এক ব্যক্তির কাছে রেখে যাচ্ছি। মোটরসাইকেল পাওয়া গেলে নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন দিয়ে টিপ্পনকে মোটরসাইকেলটি দিতে হবে।' চাচা শ্বশুরের নির্দেশ অনুযায়ীই টিপ্পনকে ফোন করেন এবং মোটরসাইকেলটি বুঝিয়ে দেন সেলিম। জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম আরও জানান, তিনি টিপ্পনকে আগে কখনোই দেখেননি। মোবা মালয়েশিয়া যাওয়ার দু'দিন পর টিপ্পন তার টঙ্গীর গ্যারেজ থেকে মোটরসাইকেলটি নিয়ে যান। সেলিম দাবি করেন, টিপ্পন কেন মোটরসাইকেল নিয়েছিলেন তিনি জানেন না। হত্যাকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্ততার কথা সেলিম স্বীকার করেননি। তিনি বলেন, মোটরসাইকেলটি জনৈক ইব্রাহিম সরকার রনির কাছ থেকে কিনেছিলেন। ৯ নভেম্বর পুলিশ সেলিমকে টঙ্গী থেকে গ্রেফতার করে নরসিংদী নিয়ে যায়।
তদন্ত সূত্র জানায়, টিপ্পন পেশাদার কিলার। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তার বাড়ি নরসিংদী শহরের শাটিরপাড়ায় (কুমিল্লা কলোনি)। হত্যাকাণ্ডের পরই তিনি নরসিংদী ছেড়ে গোপালগঞ্জে গোপীনাথপুর পৈতৃক বাড়িতে আত্মগোপন করেন। জিজ্ঞাসাবাদে টিপ্পন জানিয়েছেন, মোবা মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে একটি মোবাইল ফোন সিম দিয়ে যান। মোবা বলে যান, তিনি বিদেশ থেকে এ নম্বরে তার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। পাশাপাশি টঙ্গীর সেলিমসহ বেশ কয়েকজন তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ করবেন।
তিন আসামি দেশের বাইরে : মামলার এজাহারভুক্ত তিন আসামি বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন। তারা হচ্ছেন নরসিংদী সদর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম। বিমানবন্দর সূত্র জানায়, ১৫ অক্টোবর তিনি মালয়েশিয়া গেছেন। তিনি মামলার পাঁচ নম্বর আসামি। অন্যদিকে মামলার ৮ নম্বর আসামি জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও নরসিংদী কলেজের সাবেক ভিপি এবং শিল্পপতি তারেক আহমদ। পারিবারিক সূত্র দাবি করেছে, তিনি হজ করতে সৌদি আরব গেছেন। বিমানবন্দর সূত্র অবশ্য জানিয়েছে, তারেক গত ৩০ অক্টোবর আবুধাবির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। এছাড়া মালয়েশিয়া রয়েছেন মোবারক হোসেন ওরফে মোবা।
পলাতক আসামিদের ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়া হবে : তদন্ত সূত্র জানায়, বিদেশে পালিয়ে থাকা আসামিদের মধ্যে দু'জনের ব্যাপারে ইতিমধ্যে হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পরই তাদের ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়া হবে।
হত্যার নেপথ্য কারণ : সূত্র জানায়, মোবা ছিলেন নিহত মেয়র লোকমানের বাল্যবন্ধু। নরসিংদী পৌর নির্বাচনের ৫-৬ মাস আগে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের একটি দরপত্র নিয়ে মেয়র লোকমানের সঙ্গে মোবারকের বিরোধ বাধে। বিরোধ প্রবল আকার ধারণের এক পর্যায়ে দুই বন্ধুর মধ্যে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় লোকমানকে ঘায়েল করতে মোবা টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর সমর্থিত পক্ষে যুক্ত হন। মোবা টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর পক্ষের সমর্থনে পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে লোকমানের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
যেভাবে গ্রেফতার হলেন টিপ্পন : সমকালের গোপালগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, মোবাইল ফোনের কল ট্র্যাকিং করে গোপালগঞ্জ থেকে টিপ্পনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় তিনি তার চাচা টুকু কাজীর ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। টিপ্পন ঈদের আগেই গোপালগঞ্জের গোপীনাথপুর গ্রামের শরিফপাড়ার পৈতৃক বাড়িতে আত্মগোপন করেন। নরসিংদী শহরে থাকার সময় তার মুখে দাড়ি থাকলেও শনিবার রাতে টিপ্পন ছিলেন ক্লিন সেভ করা অবস্থায়।
পুলিশ জানিয়েছে, নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হত্যার পর টিপ্পন আত্মগোপনে যান। সর্বশেষ তিনি গোপালগঞ্জের নিজের গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নেন। তার মোবাইল ফোনের কল ট্র্যাকিং করে অসংখ্য লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর পুলিশ তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। লোকমান হত্যায় তার জড়িত থাকার নিশ্চিত প্রমাণ পেয়ে রোববার রাতে তাকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। নরসিংদী নেওয়ার পর অত্যন্ত গোপনীয়তার পুলিশ তাকে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তার কাছ থেকে পুলিশ এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য ও কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া অন্য আসামিদের নাম জানতে পারে।
টিপ্পনের চাচা ইকবাল কাজী জানান, ২৫-৩০ বছর আগে টিপ্পনের বাবা কাজী নূর মোহাম্মদ গ্রাম ছেড়ে নরসিংদী শহরে গিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। গ্রামের বাড়িতে নূর মোহাম্মদ ও তার সন্তানদের যাতায়াত ছিল না। টিপ্পন ধীরে ধীরে নরসিংদীর অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়েন।
পুলিশ জানিয়েছে, টিপ্পনের বিরুদ্ধে ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি নরসিংদীর শাটিরপাড়া এলাকায় শহর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নেয়ামত উল্লাহ লিটু, ২০০২ সালের ডিসেম্বরে শান্ত, ২০০২ সালে মধু স্বপন এবং ২০০৫ সালে নজরুল হত্যা মামলা রয়েছে। এ ছাড়া ২০০৭ সালে নরসিংদী প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এমএ আউয়ালের ওপর হামলা, ২০০০ সালে মরজালে বাস ডাকাতি, ২০০১ সালে হারুন তালুকদারের ফ্যাক্টরিতে অগি্নসংযোগ, একাধিক ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। টিপ্পন '৯৯ সালে একটি দোনলা বন্দুকসহ গ্রেফতার হন।

No comments

Powered by Blogger.