সোমালিয়ায় শিশুদের বেঁচে থাকার লড়াই

ইব্রাহিমের বয়স তিন বছর । কিন্তু তার ওজন আট কেজিরও কম। তার এই ওজন আট মাস বয়সী একটি শিশুর ওজনের কাছাকাছি। পাঁজরের ছোট ছোট হাড়ের সঙ্গে সেঁটে রয়েছে ছোট্ট শিশুটির শরীরের চামড়া। অপুষ্টির শিকার সোমালীয় এই শিশুটি এখন মায়ের সঙ্গে রাজধনীি মোগাদিসুর একটি শরণার্থী শিবিরে রয়েছে। ইব্রাহিমের মা রুকিও আবদুল্লাহি বলেন, ‘আমার সন্তান খুব অসুস্থ। হাম ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত সে। একই সঙ্গে জ্বর ও বমি হচ্ছে। স্থানীয় ওষুধের দোকান থেকে কিছু ওষুধ খাইয়েছিলাম, কিন্তু এতে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে ওর।’ নর্দমায় বয়ে যাচ্ছে শিশুটির মুখ থেকে বের হওয়া রক্তের ধারা। অসুস্থ এই শিশুসন্তানকে নিয়ে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে গত সপ্তাহে মোগাদিসুতে পৌঁছান রুকিও আবদুল্লাহি। ব্যাপক সহিংসতার জন্য সোমালিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত রাজধানী মোগাদিসু এখন বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক শহরগুলোর একটি। সন্তানের জীবন বাঁচাতেই তাঁর এই দুঃসাহসী প্রচেষ্টা। ক্লান্তি ও দুঃখবিজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার হাতে কোনো অর্থ নেই, যা দিয়ে পরিবারকে সাহায্য করতে পারি।’ এ সময় কান্নারত শিশুটিকে ঘিরে থাকা মাছির ঝাঁক তাড়াচ্ছিলেন তিনি। মোগাদিসুর বানাদির হাসপাতালে নেওয়ার পর বেঁচে থাকার জন্য লড়াই শুরু হয় শিশু ইব্রাহিমের। সে এতটাই দুর্বল ছিল যে খেতে পারছিল না। খাওয়ানোর জন্য চিকিৎসকেরা তাঁর নাকের মধ্যে নল স্থাপন করে দেন।
সংঘাতপূর্ণ সোমালিয়ায় বর্তমানে চলছে চরম খরা ও দুর্ভিক্ষ। হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চল জুড়ে এক কোটি ২০ লাখ মানুষ এই দুর্যোগের শিকার হয়েছে। মোগাদিসু ও চারটি অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। চলতি শতাব্দীতে এটিই প্রথম কোন দেশে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হলো।
খাবার, পানি ও আশ্রয়ের সন্ধানে গত দুই মাসে প্রায় এক লাখ মানুষ মোগাদিসুতে গেছে। চিকিৎসকেরা সেখানে উপচে পড়া রোগীদের সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যেই তাঁরা যতটুকু সম্ভব সেবা দিয়ে যাচ্ছেন রোগীদের।
জাতিসংঘের খাদ্য তদারক বিভাগ বর্ণনা করেছে, সোমালিয়া বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। ১৯৯১-১৯৯২ সালের পর এটিই আফ্রিকার তীব্রতম খাদ্যসংকট। বানাদির হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগের প্রধান লুলু মোহাম্মদ বলেন, ১৯৯২ সালের পর এটিই তাঁর দেখা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি। ওই বছরের বিপর্যয়ের পর ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সিয়াদ বারে। এরপর শুরু হওয়া রক্তক্ষয়ী লড়াই চিরকালের জন্য গ্রাস করে সোমালিয়াকে। ডা. মোহাম্মদ আরও বলেন, সেই বছরের পর এবারই প্রথম একসঙ্গে এত বেশিসংখ্যক অপুষ্টির শিকার শিশুকে দেখা গেল।
জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ত আল-শাবাব বিদ্রোহীরা এত দিন মোগাদিসুর প্রায় অর্ধেক এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত। গত সপ্তাহে তারা আকস্মিকভাবে মোগাদিসু ছেড়ে চলে যায়। তবে বিদ্রোহীদের একাংশ এখনো রয়ে গেছে মোগাদিসু শহরে। আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) সমর্থিত সরকারি বাহিনীর সঙ্গে তাদের লড়াই অব্যাহত রয়েছে।
স্থানীয় ত্রাণকর্মীদের মতে, শহরে কিছু সাহায্য পাঠানো হলেও অতিরিক্ত চাহিদার তুলনায় সরবরাহ নিতান্তই অপ্রতুল। ত্রাণকর্মী আদান ইউসুফ মাহাদি বলেন, খরাপীড়িত বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ মোগাদিসুতে চলে আসায় দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। মানুষ এখানে অসহায়, তাদের আরও সাহায্য প্রয়োজন। বর্তমান সীমিত সহায়তার উদ্যোগে বিপুলসংখ্যক দুর্গত মানুষের চাহিদা মেটানো কোনোভাবেই সম্ভব হবে না বলে তিনি সতর্ক করে দেন।
শহরের বাইরের পরিস্থিতি আরও করুণ। প্রাণ বাঁচানোর জন্য খাবারের সন্ধানে সেখান থেকে হাজার হাজার মানুষ অন্যত্র চলে যাচ্ছে। ত্রাণতৎপরতা সেখানে আরও সীমিত। বৃষ্টির অভাবে শস্যখেত শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে যাওয়ার পর এবং গবাদিপশুগুলো মরে যাওয়ার পর ভিটেমাটি ছেড়ে মোগাদিসুতে চলে এসেছেন আবদুল্লাহি। তিনি বলেন, ‘আমি যেখান থেকে এসেছি, সেখানকার পরিস্থিতি আরও খারাপ। সেখানে কেউ সাহায্য পৌঁছে দিচ্ছে না। আমরা কখনোই কোনো সাহায্য পাইনি।

No comments

Powered by Blogger.