গল্প- 'নাকিবের একা একা ঝিল দেখা' by হারুন ইবনে শাহাদাত

সবুজ সুন্দর গ্রাম। দিগন্ত প্রসারিত ফসলের মাঠ। মাঝে একটি ছোট ঝিল। ঝিলে আষাঢ়, শ্রাবণ, কার্তিক, অগ্রহায়ণ এই চার মাস পানি থাকে। কাকের চোখের মত স্বচ্ছ টলটলে পানি। পানির নিচে মাছেরা খেলা করে।
দুপুরের প্রখর রোদের সময় পানি যখন খুব গরম থাকে মাছগুলো ঝিলের একেবার মাঝে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সকাল বিকেল তারা ঝিলের কিনারে এসে মুখ তুলে, তারপর আবার টুপ করে ডুব দেয়।
নাকিব ওর বাবার সাথে মাঝে মাঝে ঝিলের ধারে বেড়াতে আসে। ওর খুব ভাল লাগে। ওর ইচ্ছে করে ঝিলের পানিতে নেমে মাছ ধরতে। কিন্তু ওর আব্বু ওকে পানিতে নামতে দেন না। কারণ নাকিব তো খুব ছোট, পানিতে ডুবে যাবে। বড় হলে সে অবশ্যই ঝিলের পানিতে নেমে মাছ ধরবে। তখন আর কেউ মানা করতে পারবে না। নাকিব সাঁতার শিখবে, যত অথৈ পানি থাক না কেন, তখন সে আর ডুবে যাবে না।

গ্রীষ্মকাল। রোদের তেজে পুড়ে যাচ্ছে সবকিছু। খাল, বিল, ঝিলের পানি শুকিয়ে একবারে তলানিতে ঠেকেছে। রাস্তা- ঘাটে শুধু ধুলো-বালি। মাঝে মাঝে ঘূর্ণি বাতাসে ধুলো আর শুকনো পাতা উড়ে। বাতাসের দাপটে চোখ-মুখ বন্ধ হয়ে যায়। প্রকৃতিতে আর আগের মত সজীবতা নেই। নাকিবের খুব ইচ্ছে করে ঝিলের পাড়ে গিয়ে মাছের খেলা দেখতে। কিন্তু ওর আব্বুর এক কথা, না  এখন যাওয়া যাবে না। ঝিল শুকিয়ে গেছে। এখন আর ওখানে মাছদের খেলা দেখা যায় না। নাকিবের মন খারাপ হয়ে যায়, সে  ভাবে ঝিলে পানি নেই, তাহলে মাছরা বাঁচবে কিভাবে? এ কথা সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না। নাকিব মনে করে আব্বু ওকে নিয়ে যেতে চান না, বলে এমন কথা বলছেন। সে একাই যাবে। কাউকে কিছু বলবে না।

আজ মঙ্গলবার। ঝাওয়াইল হাটবার। নাকিবের আব্বু বাজার সওদা আনতে হাটে গেছেন। আম্মু ব্যস্ত ঘর-সংসারের কাজ নিয়ে। নাকিব আস্তে আস্তে বাড়ি থেকে বের হয়। তারপর হাঁটতে থাকে। গ্রামের বড় রাস্তা পেরিয়ে ধানক্ষেতের আলের ওপর  দিয়ে হাঁটছে নাকিব। সবুজ ধানগাছের পাতাগুলো কেমন হলুদ হলুদ লাগছে, ক্ষেতে একটু পানিও নেই। মাটি ফেটে চৌচির। নাকিবের মন খারাপ হয়ে যায়। তারপরও সে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে তার পা ব্যথা করে, রোদে ফর্সা শরীর লাল হয়ে গেছে। মাথার ওপরের সূর্যটাকে মনে হয় জ্বলন্ত আগুন। নাকিবের খুব পিপাসা পায়, কিন্তু পান করার মত পানি  সে কোথায় পাবে ?

ঐ যে দূরে একটি গভীর নলকূল দেখা যায়, সে খুশি হয়। মনে মনে ভাবে ওখানে গিয়ে মাটির গভীর থেকে উঠানো ঠাণ্ডা পানি পান করবে। খুব মজা হবে। ঠাণ্ডা পানির কথা মনে হতেই তার মন খুশিতে নেচে ওঠে। মনের শক্তি বেড়ে যায়। সে আরো দ্রুত হাঁটতে থাকে। কিন্তু এ কী!  বিদ্যুৎ  নেই,  নলকূপ বন্ধ। হতাশায় তার পিপাসা আরো বেড়ে যায়। গ্রামে বিদ্যুৎ আসার পর হয়েছে এই এ জ্বালা, দিন-রাত্রির অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ থাকে না। রাতে কিছু সময়ের জন্য আসে। কিন্তু নাকিবের সাথে বিদ্যুতের খুব একটা দেখা হয় না। বিদ্যুৎ যখন আসে, তখন সে গভীর ঘুমে অচেতন থাকে। না সে আর কিছুই ভাবতে পারছে না। পিপাসায় তার ছোট বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। কলঘরের সামনের ড্রেনে একটু পানি জমে আছে। নাকিব জানে এ পানি পান করা নিরাপদ নয়। কিন্তু পিপাসায় কাতর নাকিব হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। দু’হাতে সে ড্রেনে জমা পানি পান করে।

সে আস্তে আস্তে হাঁটছে। ঝিলের পথ আর বেশি দূরে নয়।  ঝিলের কথা মনে হতেই তার ভাল লাগা  বেড়ে যায়। উহ্ সে একাই আজ মাছদের খেলা দেখবে। না। আর ভাবতে পারে না। এই তো ঝিলের পাড়ের বটগাছ, আর কয়েক পা এগুলেই ঝিলের পানি দেখা যাবে।

ঝিলের পাড়ের বটগাছের বাতাস তার খুব ভাল লাগে। গাছের ডালে ডালে কচিপাতার ফাঁকে পাখির কিচির মিচির ডাকে নাকিবের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। কিন্তু এ কী! ঝিলের পানি গেল কোথায়? মাছগুলোর কী হয়েছে? না। সে আর ভাবতে পারছে না। ধপ করে বসে পড়ে বটগাছের নিচে।

কতক্ষণ সে এভাবে বসে আছে, তা নাকিব নিজেও জানে না।

: নাকিব, ডাক শুনে চমকে ওঠে!

: আব্বু।

: দুষ্ট ছেলে এ ভাবে কাউকে কিছু না বলে কেউ বাড়ি থেেেক বের হয়?

ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে নাকিব বলে: ভুল হয়ে গেছে, আব্বু আর কোনদিন এমন হবে না।

নাকিবের বাবা ওর চেহারা দেখে বুঝতে পারেন সারাদিন ওর ওপর দিয়ে বেশ ধকল গেছে। তাই তিনি আর কথা বাড়ান না। পরম স্নেহমাখা হাত বাড়িয়ে দেন। নাকিবকে কাঁধে নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ান।

আব্বুর  কাঁধে ওঠে নাকিব বাড়ি আসে।

নাকিবের শরীরটা ভাল নেই। ঘন ঘন বমি আর পাতলা পায়খানা হচ্ছে না। ডাক্তার তাকে খাবার স্যালাইন দিয়েছেন। ওর কাছে বসে বাবা মাথায় হাত বুলাছেন।

নাবিক তার বাবার কাছে জানতে চায়: আব্বু ঝিলের পানি কোথায় গেল, মাছগুলোর কী হয়েছে?

: পানি শুকিয়ে গেছে।

: কেন?

: এখন গ্রীস্মকাল , তাই খাল, বিল, নদী-নালা সব শুকিয়ে গেছে।

: প্রত্যেক গ্রীষ্মকালেই কি পানি শুকিয়ে যায়?

: না আমরা যখন ছোট ছিলাম  নদীতে সারা বছর পানি থাকতো। সে সময় এমন নলকূপ ছিল না। নদী থেকে পাম্প ইঞ্জিনের সাহায্যে পানি তুলে ফসল ক্ষেতে পানি সেচ দিতেন কৃষকরা। এখন নদীতে পানি থাকে না। তাই মাটির নিচ থেকে পানি উঠানোর এ ব্যবস্থা। মাটির নিচের পানিও দিন দিন আরো নিচে নেমে যাচ্ছে।

: কেন, আব্বু ?

: নদী-নালা, খাল-বিল-ঝিলে পানি না থাকলে এমন হয়।

: এখন আর সারা বছর পানি থাকে না কেন?

: আমাদের দেশের নদীগুলোর উৎস আমাদের উজানের দেশ ভারতে। ভারত  নদীগুলোর  চলার পথে বাঁধ দিয়েছে। তারা ইচ্ছেমত পানি  ছাড়ে এবং আটকে রাখে। গ্রীষ্মকালে তারা পানি ছাড়ে  না

: এটা অন্যায় নাকিবের কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর মুখ মাথাটা ঝিম ধরে আসে। গুলিয়ে ওঠে সারাটা শরীর।
======================
গল্প- 'উসামার বায়না ও আইলার জন্য ভালোবাসা' by চেমন আরা  গল্প- 'উরুমকিতে আর্তনাদ' by আহমদ মতিউর রহমান  গল্প- 'টবের গোলাপ' by দিলারা মেসবাহ রম্য গল্প- 'তুচ্ছ ঘটনা' by মোহাম্মদ লিয়াকত আলী  গল্প- 'নদী কত দূর' by অজিত হরি সাহু, অনুবাদ- হোসেন মাহমুদ  গল্প- 'নতুন জীবনের গল্প' by মুহিব্বুর রহমান রাফে  গল্প- 'বুবুর জন্য' by জুবায়ের হুসাইন গল্প- 'দ্বীপ রহস্য-০০১' by হারুন ইবনে শাহাদাত  গল্প- 'নীয়নের মোবাইল পকেট' by ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ  গল্প- 'শুভরা জানতে চায়' by জুবাইদা গুলশান আরা  গল্প- 'জোড়া ঘোড়া' by মাখরাজ খান  গল্প- 'গর্ব' by আবদুল ওহাব আজাদ গল্প- 'তিতিরের ঘুড়ি' by ঝর্ণা দাস পুরকায়স্থ  গল্প- 'একটি বাঘের কথা' by মুহম্মদ জাফর ইকবাল ছেলেবেলার গল্প' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম  একটি ভাদ্র মাসের গল্প' by আতাউর রহমান


কিশোরকন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ হারুন ইবনে শাহাদাত


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.