অন্য রকম আম উৎসব by আদনান মুকিত

সন্তানদের নিয়ে বাবা-মায়েরা সব সময় চিন্তার মধ্যে থাকেন। সন্তান কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে—এসব নিয়ে তাঁদের চিন্তার শেষ নেই। ইদানীং এ ভাবনা পেয়েছে নতুন মাত্রা। ছেলেমেয়েরা ‘টেক্সটবুক’ বাদ দিয়ে সারা দিন ‘ফেসবুক’ নিয়ে মেতে আছে। ফেসবুক জিনিসটা কী, জিজ্ঞেস করলে সন্তান গম্ভীর মুখে বলে, এটা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের একটা ওয়েবসাইট। বাবা-মা আবার চিন্তায় পড়েন। সারা দিন সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করার পরও ছেলে সামাজিক বিজ্ঞানে ৩৩-এর বেশি পায় না কেন? এর ওপর নানা জায়গা থেকে তথ্য আসে—ফেসবুকে ছেলেমেয়েরা সময় নষ্ট করছে, বিপথে চলে যাচ্ছে আরও কত কী! কিসের সামাজিক যোগাযোগ? ফেসবুক তরুণসমাজকে নষ্ট করে দিচ্ছে—এ বক্তব্যের সঙ্গে তাঁরাও একমত। অতএব, ফেসবুক বন্ধ। কিন্তু ফেসবুকের মাধ্যমেও যে অনেক ভালো কিছু হয়, হচ্ছে এবং আরও হওয়া সম্ভব, তা সবাই ভুলে বসে আছে। ফেসবুকে অনেক গ্রুপ আছে, যারা সামাজিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ‘আমরা খাঁটি গরিব...’ তেমনই একটি গ্রুপ। মজা করার জন্য খোলা হলেও শুধু মজাতেই গ্রুপটি আটকে থাকেনি। গত জানুয়ারির তীব্র শীতে এই গ্রুপের সদস্যরা ফেসবুকের মাধ্যমে ত্রাণ সংগ্রহ করে কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দিয়ে এসেছেন। জানুয়ারির সেই মিশনের পর ২৬ জুন পথশিশুদের আম বিতরণ করে তাঁরা সফলভাবে শেষ করেছেন তাঁদের দ্বিতীয় মিশন।
ফেসবুকের মাধ্যমে তাঁরা শিশুদের আম দিলেন কীভাবে—অনেকেই করেন এ প্রশ্নটা। উত্তর খুবই সোজা। ‘আমরা খাঁটি গরিব...’ গ্রুপের সদস্য প্রায় দুই হাজার ৪০০ জন। পথশিশুদের আম খাওয়ানো হবে—এ ঘোষণা শুনে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু কীভাবে খাওয়ানো হবে? আলোচনায় ঠিক হয়, অপরাজেয় বাংলা নামের একটি সংগঠন ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় শ্রমজীবী বা পথশিশুদের জন্য স্কুল পরিচালনা করে; যাকে বলে স্ট্রিট স্কুল। সেই স্কুলের শিশুদের দেওয়া হবে আম। গ্রুপের সদস্যদের সবারই অনলাইনে পরিচয়, কিন্তু দেখে তা বোঝার উপায় নেই। সবাই মিলে টাকা সংগ্রহ করে জমা দেন গ্রুপের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। সেই টাকা দিয়ে কেনা হয় ৩৫০ কেজি আম। ভাড়া করা হয় পিকআপ। তারপর ২৬ জুন সকালে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে শুরু হয় যাত্রা। গ্রুপের তরুণ সদস্যদের আগ্রহের সীমা নেই। ছাদ খোলা পিকআপে বৃষ্টিতে ভিজে গরিব গ্রুপের সদস্যরা গাইতে গাইতে যখন যাচ্ছিলেন, আশপাশের লোকজন অবাক না হয়ে পারেনি। পিকআপ প্রথমে থামল গাবতলী বাস টার্মিনালের একটি স্কুলে। তারপর একে একে মোহাম্মদপুর টাউন হল, কমলাপুর রেলস্টেশন, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, হাইকোর্ট মাজার, চন্দ্রিমা উদ্যানের স্কুলগুলোর শিক্ষার্থী এবং রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, বছিলা বস্তি এবং ধানমন্ডির পথশিশুদের আম দেওয়া হয়। এক একটা স্কুলে পিকআপ থামে, আর শুরু হয় স্কুলের শিক্ষার্থীদের উল্লাস। তাদের উল্লাস দেখে মনে হচ্ছিল তারা আম না, ঈদের চাঁদ দেখছে। অবশ্য পাকা আম তাদের কাছে ঈদের চাঁদের মতোই। বছরে দুবার চাঁদ দেখা গেলেও দুবার আম খাওয়া তাদের অনেকেরই ভাগ্যে নেই। ‘নেই’ শব্দটা এই শিশুদের সঙ্গে আঠার মতো লেগে আছে। তাদের গায়ে কাপড় নেই, স্কুলে আলাদা কক্ষ, বেঞ্চ, বই-খাতা-কলম কিছুই নেই। এমনকি অনেকের বাবা-মাও নেই। মোহাম্মদপুরের ছোট্ট মেয়ে সুরমা দুই হাতে দুটি আম নিয়ে দাঁত বের করে হাসছিল। আম দুটি সে খাবে না, বাড়িতে তার মা আর বৃদ্ধ নানি আছেন, তাঁদের জন্য নিয়ে যাবে। আর বাবা? ‘বাবা নাইগা, আরেকটা বিয়া কইরা ভাগসে।’ এত কষ্টের পরও সে স্কুলে আসছে, সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে পড়ছে—আ-তে আম। কিন্তু ওই পড়া পর্যন্তই, আম আর তাদের খাওয়া হয় না। তার পরও বছরের প্রথম আম পেয়ে একা না খেয়ে নিয়ে যাচ্ছে মা আর নানির জন্য!
এদের মধ্যে কোনো জড়তাও নেই। দেখে মনে হচ্ছিল আম দিতে আসা ভাইয়া-আপুদের তারা খুব ভালো করে চেনে। কী চমৎকার করে বলে—‘ভাইয়া, আমার একটা ছবি তুলে দ্যান তো।’ সেই ছবি দেখানোর পর আরও সুন্দর করে বলে, ‘ছবি ভালো আসেনি, আবার তোলেন।’ চন্দ্রিমা উদ্যানের মামুন আম দেওয়ার সময় গাছে উঠে বসে আছে। সবাই আম নিয়েছে, সে নেবে না, গাছ থেকেও নামবে না। তার মন খারাপ। আম দিতে আসা এক ভাইয়া তাকে গাছ থেকে নামিয়ে হাতে আম তুলে দিতেই তার মন ভালো হয়ে গেল। শুধু ভালোই না, খুশিতে তার চোখে পানি চলে এল। হাসি-কান্না দুটোই একসঙ্গে। কী সুন্দর দৃশ্য!
রায়েরবাজারে পিকআপে ব্যানার দেখে একজন প্রশ্ন করলেন, ‘এই ফেসবুক জায়গাটা কোথায়?’ সব খুলে বলার পর তিনি বললেন, ‘সবই বুঝছি, কিন্তু আপনাদের উদ্দেশ্যটা কী?’ উদ্দেশ্য একটাই। হাসি দেখা। মাত্র দুটি আম পেয়েই দরিদ্র শিশুগুলোর মুখে যে হাসি ফুটেছে, তা কয়জন দেখতে পারে? আম পেয়ে শিশুরা সবাই মিলে গলা ফাটিয়ে বলছিল ‘থ্যাংক ইউ!’ গ্রুপের সদস্যরা এই শব্দটা জীবনে অনেকবার শুনেছেন; কিন্তু কখনোই এতটা ভালো লাগেনি।

No comments

Powered by Blogger.