রঞ্জিতের দেখা অদেখার জগত্ -মানুষের মুখ by মামুনুর রশিদ মামুন

‘এ পৃথিবী কত সুন্দর! কত আর্কষণীয় তার সব সৃষ্টি। সব দেখেছি, অনুভব করেছি। আজ আর দেখতে পারি না, শুধু অনুভব করি।’ এভাবেই নিজের আবেগের কথা জানালেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কলেজছাত্র রঞ্জিত কুমার পাল (২৪)। একসময় সবকিছু দেখতে পারতেন, নিজের মনের মতো করে সাজাতেন সবকিছু। খেলাধুলা, লেখাপড়া—সবকিছুতে ছিলেন সেরা। আজ তাঁর অনেক কিছুই যেন অনুপস্থিত। কী এক কালবৈশাখী ঝড় সব তছনছ করে দিয়েছে। অপবাদ নিতে হয়েছে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর। তার পরও হাল ছাড়েননি রঞ্জিত পাল। সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। যে স্বপ্ন বুকে লালন-পালন করেছেন শিশুকাল থেকে, বাঁধা পেলেও তা পূরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আবার আগের মতো নিজেকে সাজানোর স্বপ্ন দেখছেন। দৃষ্টিশক্তি হারালেও লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন নিজ প্রচেষ্টায়। নিজেই উপার্জন করে বহন করছেন লেখাপড়ার খরচ। এই সংগ্রামী যুবকের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারার মহব্বতপুর গ্রামে। বাবা ধীরেন্দ্রনাথ পেশায় একজন পাল। মাটির পাতিল বিক্রি করে চলে তাঁর সংসার।
পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলাম। হঠাত্ আটকে গেল পাশের কক্ষের এক পরীক্ষার্থীর দিকে। বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন আর পাশে বসা আরেক ছাত্র লিখে চলেছেন। এ কক্ষেও পরীক্ষা চলছে বুঝতে পারলেও কে পরীক্ষার্থী তা ঠিক করতে পারছিলাম না। তাই ওই কক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সিনিয়র ইয়াদ আলী স্যারের কাছে জানতে চাইলাম, আসল ঘটনা। তিনি জানালেন কথক ছেলেটি বিএ পরীক্ষার্থী। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তাই রাইটারের সহযোগিতায় পরীক্ষা দিচ্ছেন তিনি। পরীক্ষা শেষে আলাপ করলাম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রঞ্জিত কুমার পালের সঙ্গে। তিনি জানালেন তাঁর প্রতিবন্ধী হওয়া ও লেখাপড়া চালানোর সংগ্রামের কাহিনী। দশম শ্রেণীর ছাত্র, ক্লাসের মেধাবী ছাত্রদের মধ্যে তিনিও একজন। ১৯৯৯ সালের কথা হঠাত্ ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হন তিনি। এ দেশে চিকিত্সা শুরু হলো। চিকিত্সকেরা জানালেন, এ দেশে তাঁর চিকিত্সা সম্ভব হবে না। ভারতে নিয়ে গেলে হয়তো তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হবে। কিন্তু এত টাকা কোথায়? তার পরও বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন রঞ্জিত। পিতামাতা অকালে ঝরে যাওয়া দেখতে চান না তাঁদের প্রিয় সন্তানের। তাই জমিজমা সব বিক্রি করে সন্তানকে নিয়ে ছুটলেন ভারতে। চিকিত্সার পর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেও দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে গেল মেধাবী রঞ্জিতের। দুই চোখেই আর কাজ করে না। লেখাপড়া শেষ করতে চাইলেন না রঞ্জিত। তাঁর ইচ্ছে অনেক দূর অগ্রসর হওয়া। কীভাবে পড়বেন তা ভেবে কুলাতে পারছিলেন না তিনি। এভাবে কেটে গেল কয়েক বছর। স্থির করলেন আবার বিদ্যালয়ে যাবেন। কিন্তু কীভাবে? এ রকম নানা প্রশ্ন দেখা দিল তাঁর মধ্যে।
একসময় নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে রঞ্জিত আবার গেলেন বিদ্যালয়ে। সহপাঠীদের সহযোগিতায় বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে মোহনগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ে যান তিনি। কিন্তু কীভাবে লেখাপড়া করবেন, আগের মতো তো আর দৃষ্টিশক্তি নেই। স্থির করলেন পড়ার জন্য বাড়িতে থাকা টেপ রেকর্ডার ব্যবহার করবেন। তাই বইয়ের পাড়া-প্রতিবেশী শিক্ষিত কাউকে ডেকে নিয়ে এসে টেপে তার রেকর্ড করে নেন। পরে একাকী টেপ চালু করে সেসব পড়া মুখস্থ করে বিদ্যালয়ে যেতেন। এভাবে ভালোই চলল রাইটার নিয়ে পরীক্ষা দেওয়া। শিক্ষা বোর্ডের অনুমতি নিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাস করলেন তিনি। ভর্তি হলেন স্থানীয় কলেজে। একই ভাবে লেখাপড়া করে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েও পাস করলেন রঞ্জিত। ভর্তি হলেন মোহনগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে। তাঁকে সহযোগিতা করে আসছেন জুনিয়র রাইটার প্রতিবেশী দীপক কুমার। তিনি উচ্চমাধ্যমিক শাখার দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র, তাঁকে নিয়ে পথচলা তাঁর। রঞ্জিত লেখাপড়ার সুবিধার্থে বেল পদ্ধতি শিখে নিয়েছেন। লেখাপড়ায় এ পদ্ধতি তাঁকে সহায়তা করে বলে জানান। তবে তাঁকে বেশি নির্ভর করতে হয় টেপরেকর্ডারের ওপর। পাড়ার কলেজ-বিদ্যালয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাঁদের মধ্যে আপেল মাহমুদ, দীপক কুমার, তানিয়া ও সুমন উদ্দিনের সহযোগিতা বেশি পেয়েছেন তিনি। তাঁরা বই পড়ে রেকর্ড করেন আর পরে তা বাজিয়ে শোনেন তিনি। এভাবে চলছে তাঁর লেখাপড়া। এতে খরচও বেশি হয় তাঁর। রঞ্জিতের লেখাপড়ার খরচও নিজেকে জোগাড় করতে হয়। বিকেলে বাড়ির পাশে রাস্তায় বসে বিক্রি করেন বাদাম ভাজা। এ থেকে যা পান তা দিয়েই চলে তাঁর লেখাপড়ার খরচ। প্রতিবেশী অনেকেই সহযোগিতা করেন তাঁকে চলার পথে। তবে আরও দূরে যেতে চান, আরও পথ চলার আগ্রহ রয়েছে তাঁর। তাঁর দুই চোখ সেটাই প্রমাণ করে। তাঁকে নিয়ে লেখা হবে জানতে পেরে রঞ্জিত বললেন, ‘স্যার, আমাকে নিয়ে লেখেন, আমি আরও দূরে যেতে চাই।’

No comments

Powered by Blogger.