তোমরা যারা জিপিএ ফাইভ পাওনি... -অরণ্যে রোদন by আনিসুল হক

তোমরা যারা জিপিএ ফাইভ পাওনি এই লেখাটা তাদের জন্য। আর এই লেখাটা তোমাদের মা-বাবার জন্যও।
গত পরশু আমি গিয়েছিলাম নন্দন পার্কে। ওখানে মাধ্যমিক পর্যায়ে ঢাকায় যারা এবার জিপিএ ফাইভ পেয়েছে, তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। ছেলেমেয়েরা আনন্দ করছে। গান-বাজনা হচ্ছে। বড় বড় মানুষ, আমাদের প্রিয় ব্যক্তিত্বরা কথা বলছেন। ভালো ভালো কথা। যেসব কথা ভবিষ্যতে চলার পথে আলো দেবে তেমনি কথা। এই সমাবেশে যেতে আমার খুবই ভালো লাগে। ছেলেমেয়েদের উজ্জ্বল চোখমুখগুলোয় আশা আর সাফল্যের ঝলকানি দেখে নিজের মরচে ধরা মনটাকে একটা ঘষামাজা করে নেওয়া চলে। ওই ছেলেমেয়েদের আমরা অভিনন্দন জানাই। সাফল্য উদযাপন করারই জিনিস। এসো, যারা সফল হয়েছে, তাদের শুভেচ্ছা জানাই।
কিন্তু আবারও বলি, এই লেখাটা তাদের জন্য, যারা এই দলের নও। যারা পরীক্ষা দিয়েছ, কিন্তু জিপিএ ফাইভ পাওনি, তাদের সংখ্যাই তো বেশি।
আচ্ছা প্রথমে আমি ওদের পাওলো কোয়েলহোর আলকেমিস্ট বই থেকে যে গল্পটা বলেছিলাম, সেটা বলে নিই।
এক বাবা তার কিশোর ছেলেকে পাঠালেন পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে, উপদেশের জন্য। ছেলেটি মরুভূমি পাড়ি দিয়ে পাহাড় ডিঙিয়ে পৌঁছাল জ্ঞানী ব্যক্তির প্রাসাদে। জ্ঞানী ব্যক্তির সামনে ভিড়। অনেকেই বসে আছে তাঁর উপদেশ নেওয়ার জন্য। ছেলেটি বলল, ‘আমি এসেছি আপনার কাছে, বাবা পাঠিয়েছেন, আমাকে উপদেশ দিন।’ জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, ‘তোমাকে উপদেশ দেব। তার আগে তুমি পুরো প্রাসাদটা ঘুরে-ফিরে দেখো। তবে একটাই শর্ত। তোমাকে আমি একটা চামচ দিচ্ছি, চামচে তেল ভরে দিচ্ছি, তুমি পুরো প্রাসাদ ঘুরবে। কিন্তু তোমার চামচ থেকে যেন তেল না পড়ে যায়।’ ছেলেটি প্রাসাদটা ঘুরল, আর তক্কে তক্কে রইল, চামচ থেকে তেল ফেলা যাবে না। ফিরে এসে সে বলল, ‘আমি পুরো প্রাসাদ ঘুরেছি। এবার আমাকে উপদেশ দিন।’ জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, ‘এবার বলো, পাশের ঘরে দেয়ালে কিসের ছবি আছে।’ ছেলেটি বলল, ‘আমি তো কোনো দিকে তাকাইনি, সারাক্ষণ চামচের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।’
জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, ‘না, প্রাসাদে দেখার মতো অনেক কিছু আছে, সেসবও তোমাকে দেখতে হবে। তবে তেল যেন পড়ে না যায়।’ ছেলেটি আবার গেল, দেখল, সত্যি, প্রাসাদের নানা কক্ষে নানা কিছু আছে দর্শনীয়: তৈলচিত্র, ফুল, পাখি, কার্পেট। সব দেখে সে ফিরে এসে বলল, ‘হ্যাঁ, এবার আমি বলতে পারব প্রাসাদের কোথায় কী আছে।’
জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, ‘তোমার চামচের তেল কোথায়?’ ছেলেটি তাকিয়ে দেখল, ‘চামচে তেল নেই।’
জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, ‘এটাই আমার উপদেশ। আমরা আমাদের চারপাশের সবকিছু দেখব, কিন্তু চামচ থেকে তেল পড়তে দেব না। আবার আমরা তেল ধরে রাখব, কিন্তু চারপাশের সবকিছু দেখা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করব না।
আমি ছেলেমেয়েদের বলেছি, পরীক্ষায় ফল ভালো করতে হবে, আবার চারপাশের জগত্ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখা চলবে না। সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিতর্ক-খেলা-বিজ্ঞান সবকিছুর চর্চা করবে, সংগঠন করবে, সামাজিক কাজে আর দেশের কাজে অংশ নেবে, আবার ফলও ভালো করতে হবে।
এই কথাটা সবাইকেই বলি। যারা জিপিএ ফাইভ পেয়েছ, আর যারা পাওনি, আসো আমরা আমাদের স্কুল-কলেজের লেখাপড়াটা ভালোভাবে করি।
কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে যে কথাটা আমাদের বলতে হবে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ভালো ফল করা নয়। ভালো ফল করার পরও বহু সমাজবিরোধী মানবতাবিরোধী মানুষ পৃথিবীর অপার ক্ষতি ও দুঃখের কারণ ঘটিয়েছেন, আবার ভালো ফল না করে পৃথিবীতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন, সেই রকম মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। পরীক্ষার ফল ভালো করে পরবর্তী জীবনে কোনো অর্থেই সফল হননি, এমন মানুষও পৃথিবীতে দেদার আছেন, আবার ভালো ফল করে পরবর্তী জীবনে পৃথিবী ও সভ্যতাকে আলোকিত করেছেন, এমন উদাহরণ তো আছেই।
কিছুদিন আগে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরুল। ছয় লাখ ১৮ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার পেয়েছে জিপিএ ফাইভ। ওরা খুশিতে নাচছে, গাইছে, লাফাচ্ছে, টিভিতে আমরা সেই সব ছবি দেখলাম, পরের দিনের কাগজে সেই ছবি ছাপাও হলো। কিন্তু যে ছয় লাখ জিপিএ ফাইভ পায়নি, তারা কি তাতে দমে যাবে? আর তাদের কথা কে ভাববে, যে দুই লাখ ছেলেমেয়ে পাসই করতে পারল না?
প্রথমে বাবা-মাকে বলি, ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার ফল নিয়ে বেশি চাপাচাপি করবেন না। তোমাদেরও বলি, যারা পরীক্ষায় ভালো করেছ, তারা জীবনে ভালো করবে, কিন্তু যারা পরীক্ষায় ভালো করনি, তারা জীবনে আরো ভালও করতে পার, এই বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হয়ো না। জীবন মানে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার খাতা নয়। জীবন আরও বড় কিছু।
শিক্ষা আসলে মানুষকে দক্ষ করে, তাকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার শক্তি দেয়, তার ভেতরের সৃজনশীলতাকে বাড়িয়ে দেয়, তার সমস্ত সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত করে। সেটা শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য। আসল মাপকাঠিটাও ওখানেই। তুমি নিজেকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছ কি না। তোমার ভেতরে যে গুণগুলো আছে, তাকে ব্যবহার করতে পারছ কি না।
রোনালদো বা শচীন টেন্ডুলকার জিপিএ ফাইভ পেয়েছিলেন কি না, সেটা কেউ জানতে চায় না। যেটা জানতে চায়, তারা খেলার মাঠে ভালো করলেন কি না। তারপর? সারাটা জীবন বা সারাটা ক্ষণ তো তাঁরা খেলবেন না। বাকি সময়টা তাঁরা সুন্দর করে জীবনটাকে যাপন করলেন কি না, সেটাও দেখতে হবে। ওখানে হয়তো খেলার দক্ষতার বাইরে আমরা সামগ্রিক শিক্ষার কথা বলব। শিক্ষা মানেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়। সুশিক্ষিত মানুষ মানেই স্বশিক্ষিত মানুষ। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যলয়ে খুব কম জিনিসই পড়ানো হয়, আসল শিক্ষাটা মানুষ নেয় ক্লাসের বাইরে, বই পড়ে, মানুষের সঙ্গে মিশে, চলচ্চিত্র-টিভি-কম্পিউটার-সংবাদপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে, চলতে ফিরতে, দেশ ভ্রমণ করে, প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে এবং কাজ করতে করতে। ঠেকে শেখে, ঠকে শেখে।
রবীন্দ্রনাথের ফল ভালো ছিল না, নজরুলেরও না। স্কুলের পরীক্ষায় আইনস্টাইন ভালো করেছেন বলে শুনিনি। বিল গেটস হার্ভার্ডের পড়াশোনা শেষ করেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তো জিপিএ ফাইভ পাননি, তখন অবশ্য ছিলও না সেসব, তবে যাকে বলে ক্লাসের ফার্স্ট বয়, সেই ধরনের ভালো ছাত্র তিনি ছিলেন না। কী ছিল তাঁর? ছিল দেশপ্রেম, ছিল সাহস, ছিল দেশের জন্য একটা কিছু করার দুর্বার প্রতিজ্ঞা, ছিল মানুষকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা। তাজউদ্দীন আহমদ ভালো ছাত্র ছিলেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্ট্যান্ড করেছিলেন। কিন্তু তারপর পড়াশোনা ও ক্লাসে নিয়মিত হতে পারেননি রাজনীতির টানে। এঁরা স্বাধীনতার সময় আমাদের নেতা ছিলেন বলে দেশটা স্বাধীন হতে পেরেছিল।
জিপিএ ফাইভ পাওয়া ভালো। যে ৬২ হাজার ছেলেমেয়ে দেশজোড়া জিপিএ ফাইভ পেয়েছে, তাদের সাবধান করে দিই। উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে এই সংখ্যা কমে যাবেই। এবার পেয়েছে আঠারো হাজার। কাজেই তোমরা ভালো করে লেখাপড়া করো। যাতে তোমাদের সাফল্যের ধারা অব্যাহত থাকে। যাতে তোমরা নেতৃত্ব দিতে পারো। কিন্তু নেতৃত্ব দিতে হলে শুধু পড়লে চলবে না, নিজের মনের পরিধিটাকে, দেখার পরিধিটাকে বড় করে নিতে হবে। শুধু বই পড়ে সেটা অর্জন করা যায় না। কিন্তু যারা জিপিএ ফাইভ পাওনি, পরীক্ষায় যারা চেষ্টা করেও ভালো করতে পার না, তারা একদম মন খারাপ করবে না। জেনে রেখো, পরীক্ষার ফলের সঙ্গে জীবনের পরীক্ষায় ভালো করার সম্পর্ক খুব বেশি নয়।
উচ্চমাধ্যমিকের ফল বেরোনোর দিন শুনতে পেলাম, একটা মেয়ে প্রত্যাশিত ফল পায়নি বলে ধানমন্ডির লেকের পানিতে নেমে গেছে। সবাই মিলে টেনে তাকে তুলতে পারে না। এ রকম করার কোনো দরকার নেই। জিপিএ ফাইভ না পেলেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে না। বরং, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি, ‘আকাশ তবু সুনীল থাকে, মধুর ঠেকে ভোরের আলো/ মরণ এলে হঠাত্ দেখি, মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।’
যারা আজকে ভালো করনি, তারা এই ব্যাপারকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নাও, ভবিষ্যতে তোমাদের ভালো করতে হবে। আর আমাদের আসল লক্ষ্য হবে, মানুষ হওয়া। দেশপ্রেমিক ভালো মানুষ হওয়া। মানুষের জন্য, জগতের জন্য ভালো কিছু করে যাওয়া। তোমাদের ভেতর থেকেই বেরিয়ে আসবে খুব বড় কবি, খুব বড় ভাবুক, খুব বড় নেতা, খুব বড় বিজ্ঞানী, খুব বড় ব্যবসায়ী, খুব বড় শিল্পোদ্যোক্তা, খুব বড় শিল্পী, খুব বড় খেলোয়াড়, আর খুব বড় মানুষ।
কোনো জীবনই ব্যর্থ হয়ে যায় না। প্রত্যেকটা জীবনই আসলে সফল, সার্থক। এই জগতে প্রত্যেকের বেঁচে থাকার কিছু না কিছু সার্থকতা আছে আর আছে অপার আনন্দ। সবচেয়ে বড় কথা হলো, অন্যের ক্ষতির কারণ না হওয়া।
এবার মা-বাবাদের বলি, শুধু রেজাল্ট রেজাল্ট করে ছেলেমেয়ের জীবনটাকে অতিষ্ঠ করে মারবেন না। ওকে একটু জিরোতে দিন। ওকে একবার জানালার ধারে গিয়ে সবুজ পাতার দিকে তাকাতে দিন। ছাদে গিয়ে আকাশটাকে দেখতে দিন। বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নিজের যোগ্যতা যাচাই করতে দিন।
এবার একটা অন্য প্রসঙ্গ। আমাদের ক্রিকেট দল বেশ ভালো করছে। তারা ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্ট আর ওয়ানডে সিরিজের সবগুলো ম্যাচ জিতেছে। আমরা ভীষণ খুশি। জিম্বাবুয়ের সঙ্গেও খুব ভালো করুক দলটা, এটা আমরা চাই। কিন্তু দলটা তো খারাপও করতে পারে। খেলায় হারজিত আছে। আর আমাদের যে ক্রিকেট-ঐতিহ্য, আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের যে দশা, আমাদের যে ক্রিকেট-কাঠামো, তাতে পৃথিবী-সেরা আসরে এই দলকে যখন আমরা পাঠাই, তখনই ওদের ঠেলে দিই এক অসম প্রতিযোগিতায়। তার পরও ওরা কখনো কখনো জেতে। এটাই বেশি। ফলে হারটাকেও আমাদের মেনে নিতে হবে। যখন ওরা হেরে যায়, তখনো যেন আমরা ওদের পাশে থাকি।
তেমনি করে, আমার যে সন্তানটি জিপিএ ফাইভ পায় না বা পাস করতে পারে না, তার পাশেও আমাকে থাকতে হবে। তার ভেতরের যে অমিত সম্ভাবনাটা আছে, সেটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমরা যেন মেরে না ফেলি।
প্রত্যেকটা মানুষই একেকটা অপার সম্ভাবনার নাম। প্রত্যেকটা হূদয়ের ভেতরে আছে এক অন্তহীন দিগন্তহীন জগত্। সেই জগতের দরজা-জানালা আমরা যেন বন্ধ না করি। তোতাকাহিনীতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘এক যে ছিল পাখি। সে ছিল মূর্খ। সে গান গাহিত, শাস্ত্র পড়িত না। লাফাইত, উড়িত, জানিত না কায়দাকানুন কাকে বলে।’ রাজা মন্ত্রীকে বললেন, ‘পাখিটাকে শিক্ষা দাও।’ সোনার খাঁচা বানানো হলো। পুঁথিলেখকেরা পর্বতপ্রমাণ পুঁথি নকল করলেন। বহুত জবরদস্তির পর যা হলো, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘পাখিটা মরিল।’...‘রাজা পাখিটাকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হুঁ করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খস্খস্ গজ্গজ্ করিতে লাগিল।’
আমাদের লক্ষ লক্ষ তরুণের প্রাণের তোতাটাকে আমরা যেন মেরে না ফেলি।
তোমরা যারা জিপিএ ফাইভ পাওনি, এই লেখাটা তোমাদের জন্য। তোমরা প্রত্যেকেই একদিন অনেক বড় হবে, এটা তুমিও জানো, আমিও জানি। তোমাদের আব্বু-আম্মুরাও সেদিন অনেক খুশি হবেন। সেদিনের কথা ভেবে তাঁদের এখন একটু হাসতে বলি।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.