ভারত কেবল মুসলিমদের ‘বিদেশি’ বলে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠাচ্ছে by আরশাদ আহমেদ ও মহিবুল হক
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের ৬৭ বছর বয়সী সাইকেল মেকানিক আলী গত ৩১ মে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। এর আগে তিনি চারটি ভয়ংকর দিন কাটিয়েছিলেন বাংলাদেশে। জন্মের পর থেকে তিনি জীবনভর এই প্রতিবেশী দেশটির নাম কেবল ‘গালি হিসেবে’ শুনেছেন বলে দাবি করেন।
আলীর এই এক সপ্তাহের দুর্ভোগ শুরু হয় ২৩ মে। ওই দিন রাজ্যের মোরিগাঁও জেলার কুইয়াদল নামের ছোট একটি গ্রামে তাঁর ভাড়া বাসা থেকে আসাম পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। সেদিন রাজ্য সরকার ঘোষিত ‘বিদেশি নাগরিকদের’ ধরপাকড় শুরু করে। আসামে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকে কেবল ‘বিদেশি নাগরিক’ বলা হয়ে থাকে।
আসাম হচ্ছে চা উৎপাদনকারী এলাকা। এ অঞ্চলে ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে বাংলাভাষী মানুষের আগমন ঘটেছে এবং তাঁরা সেখানে বসবাস করছেন। এর পর থেকে স্থানীয় আদিবাসীদের (যাঁরা মূলত অসমিয়া ভাষায় কথা বলেন) সঙ্গে জাতিগত উত্তেজনা তৈরি করেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ২০১৬ সালে প্রথমবার আসামের ক্ষমতায় এলে এই উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়। রাজ্যের ৩ কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি মুসলিম, যা ভারতের যেকোনো রাজ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ হার।
আলী হচ্ছেন সেই ৩০০-এর বেশি মুসলিমের একজন, যাঁদের মে মাস থেকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো (পুশ ইন) হয়েছে। এমন তথ্য দিয়েছেন খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তিনি বলেছেন, ‘এ ধরনের ঠেলে পাঠানো আরও জোরদার করা হবে। আমাদের রাজ্যকে বাঁচাতে আরও সক্রিয় ও উদ্যোগী হতে হবে।’
নীল আকাশের নিচে নরক
২৩ মে পুলিশ আলীকে আটক করে ২০০ কিলোমিটারের বেশি দূরের গোয়ালপাড়া জেলার মাতিয়ায় নিয়ে যায়। ওই এলাকায় আসামের কথিত ‘অবৈধ’ অভিবাসীদের জন্য রাজ্যের সবচেয়ে বড় বন্দিশিবির নির্মাণ করা হয়েছে।
তিন দিন পর ২৭ মে ভোরবেলায় ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) আলী, পাঁচ নারীসহ ১৩ জনকে একটি ভ্যানে করে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে যায়।
আলী বলেন, ‘বিএসএফ আমাদের জোর করে ওপারে ঠেলে দিতে চাইছিল। কিন্তু বিজিবি (বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড) এবং স্থানীয় বাংলাদেশিরা প্রতিবাদ জানায়, তারা আমাদের নেবে না। কারণ, আমরা ভারতীয়।’
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ নামে পরিচিত একটি খোলা মাঠে আলীসহ অন্যদের পরবর্তী ১২ ঘণ্টা হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। তাঁদের জন্য ছিল না কোনো খাবার, আশ্রয় কিংবা সুরক্ষা।
আলীকে জলাভূমিতে বসে থাকতে এবং তাঁর চোখেমুখে গভীর আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে—এমন একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। তিনি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা নীল আকাশের নিচে নরক দেখেছি আর অনুভব করেছি, কেমন করে জীবন আমাদের ছেড়ে যাচ্ছিল।’
আলী বলেন, তাঁরা যখন ভারতের দিকেই ফিরে যেতে চান, তখন বিএসএফ তাঁদের ভয় দেখিয়ে বলে, ফিরে গেলে গুলি করা হবে।
আলী বলেন, ‘আমরা কান্নাকাটি করে অনুরোধ করেছিলাম যেন আমাদের না ঠেলে দেওয়া হয়। তখন ভারতের নিরাপত্তা সদস্যরা রাবার বুলেট ছোড়েন। ওই স্থান আমাদের জন্য কোনো “নো ম্যানস ল্যান্ড” ছিল না। বরং সেটি ছিল এমন এক জায়গা, যেখানে আমাদের কোনো দেশই ছিল না।’
৫০ বছর বয়সী রহিমা বেগমকে একইভাবে আসামের গোলাঘাট জেলা থেকে ধরে নেওয়া হয়েছিল। তিনি বলছেন, এ ঘটনার স্মৃতি তাঁকে এখনো তাড়া করে।
রহিমা বলেন, ‘আমি যখন দৌড়ে বাংলাদেশের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করি, তখন বিজিবি আমাকে মারধর করে। আমার কোনো পালানোর পথ ছিল না। বিএসএফ হুমকি দেয়, যদি আমরা না যাই ওপারে, তাহলে তারা আমাদের গুলি করে মারবে।’
বাংলাদেশের সীমান্ত শহর রৌমারীর সাংবাদিক জিতেন চন্দ্র দাস। তিনি এ ঘটনা নিয়ে একটি বাংলা দৈনিকে প্রতিবেদন করেছিলেন। এই সাংবাদিক আল–জাজিরাকে বলেন, বিএসএফ ওই আটকে পড়া ভারতীয় নাগরিকদের ওপর রাবার বুলেট ছুড়েছে। বিএসএফ তাঁদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠাতে ‘আকাশে চার রাউন্ড গুলি’ ছুড়েছে।
তবে ২৭ মে বিএসএফ এক বিবৃতিতে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা কেবল বাংলাদেশি নাগরিকদের ‘অবৈধ প্রবেশ ঠেকাতে’ কাজ করেছে।
বাংলাদেশি গ্রামবাসী ও বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপের পর বিজিবি আলীকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তে নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে তিনি জঙ্গল পেরিয়ে ১০ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রা শেষে বাড়ি ফেরেন।
৩১ মে আসামভিত্তিক দ্য সেন্টিনেল পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিজিবির কাছ থেকে বিএসএফ ৬৫ জন সন্দেহভাজন ভারতীয় নাগরিককে ফেরত নেয়।
বাংলাদেশে ঠেলে পাঠনো হয়েছিল, ভারতের এমন মুসলিম নাগরিকেরা আল–জাজিরাকে বলেন, বিজিবি তাঁদের আন্তর্জাতিক সীমান্তে রেখে যায়। সেখান থেকে অন্তত ১০০ জন নিজেরাই বাড়ি ফিরে যান। এসব দাবির সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে অনেকেই জানান, সীমান্তে ‘সাদাপোশাকে থাকা লোকজন’ তাঁদের গ্রহণ করেন এবং পরে হাইওয়েতে ফেলে রেখে চলে যান।
মুসলিমদের বিতাড়নের ঢেউ
গত ২২ এপ্রিল ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে গুলি করে ২৬ জনকে হত্যা করে সশস্ত্র গোষ্ঠী। ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা পাকিস্তান-সংশ্লিষ্ট বলে অভিযোগ তোলে ভারত। ওই ঘটনার পরই ভারতে মুসলিমবিরোধী মনোভাব আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এর পর থেকেই তথাকথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বিতাড়নের প্রচার-প্রচারণা আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি অধ্যাপক অপূর্বানন্দ আল–জাজিরাকে বলেন, পেহেলগাম হামলার পর ভারতের কেন্দ্রীয় ও আসাম রাজ্য সরকারে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি দুর্বল মুসলিম জনগোষ্ঠীকে তাড়িয়ে দেওয়ার অজুহাত খুঁজে পায়। যেমন রোহিঙ্গা সম্প্রদায় কিংবা বাংলাভাষী ভারতের মুসলিম নাগরিক।
অপূর্বানন্দ বলেন, ‘বিজেপি সরকারের অধীন ভারতে মুসলিম পরিচয় মানেই সন্ত্রাসবাদের প্রতীক। এই সরকার বাংলাভাষী মুসলিমদের অবৈধ বাংলাদেশি হিসেবে বিবেচনা করে।’
আসামের বিরোধী দল ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করে আসছে, চলমান কথিত বিদেশি নাগরিক ধরার অভিযানে কেবল মুসলিমদের নিশানা করা হচ্ছে। কংগ্রেস পার্টির নেতা দেবব্রত শইকিয়া আল–জাজিরাকে বলেন, তারা কেবল মুসলিমদেরই মাতিয়া বন্দিশিবির থেকে ঠেলে পাঠিয়েছে।
অবশ্য বিজেপির মুখপাত্র মনোজ বৌরাহ এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অভিযান ধর্মভিত্তিক নয়। তিনি দাবি করেন, অবৈধ হিন্দুদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়নি। কারণ, তাঁরা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হতে পারেন।
আসামের পরিস্থিতি
আসামে বহু দশক ধরে জাতিগত ও ধর্মীয় উত্তেজনা চলে আসছে। এই উত্তেজনার মূল শিকড় রয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে।
১৯ শতকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা আসামের পার্বত্য এলাকাগুলোয় চা–বাগান তৈরি করে। এতে কাজ করতে বাংলাভাষী মুসলিম ও হিন্দু—উভয় সম্প্রদায়ের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক আসামে আসেন। তাঁদের অনেকে বর্তমান বাংলাদেশের অঞ্চল থেকে এসেছেন।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় ভারত ও পাকিস্তান—দুটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে গঠিত হয়। পাকিস্তানের একটি অংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান, যেখানে বেশির ভাগ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলতেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা ছিল উর্দু।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে ভাষা নিয়ে গণ–আন্দোলনের পর ভারতের সহায়তায় ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধ হয় এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
আজকের দিনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার (২ হাজার ৫৪৫ মাইল) দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ২৬০ কিলোমিটার (১৬০ মাইল) আসামের সঙ্গে।
অন্যদিকে আসামের কর্তৃপক্ষ ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চকে (বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার আগের দিন) একটি সীমারেখা হিসেবে নির্ধারণ করে। বাংলাভাষী বসবাসকারীদের নাগরিকত্ব দাবি করতে হলে প্রমাণ হিসেবে দাখিল করতে হয়, তাঁরা ওই তারিখের আগে আসামে এসেছিলেন।
এ ধরনের নাগরিকত্ব সম্পর্কিত মামলাগুলো নিষ্পত্তি করে আসাম রাজ্যে স্থাপিত বিশেষ ‘ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল’ বা বিদেশি ট্রাইব্যুনাল। এসব ট্রাইব্যুনাল একটি বিশেষ আদালতের মতো কাজ করে এবং সরকারি নথিপত্রে ছোটখাটো বানান ভুল বা অমিল দেখিয়ে মানুষকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করার ক্ষমতা রাখে।
২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছিল, এসব ট্রাইব্যুনাল ছিল ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ এবং তারা ‘ইচ্ছামতো কাজ করে’।
ওই বছরেই আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়। অবৈধ বাসিন্দাদের শনাক্ত করতে সরকার বহু বছর ধরে এই এনআরসি প্রস্তুত করছিল।
এই তালিকায় প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দাকে বাদ দেওয়া হয়, যাঁদের মধ্যে প্রায় ৭ লাখ মুসলিম। এনআরসি প্রকাশের পর জোরপূর্বক ভারত থেকে বহিষ্কার করতে শত শত মুসলিমকে বন্দিশিবিরে ধরে নেওয়া হয়।
আলীর নাম এনআরসিতে ছিল। তবে ২০১৩ সালে মোরিগাঁওয়ের একটি ট্রাইব্যুনাল তাঁকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করেন। কারণ, কিছু কাগজপত্রে তাঁর বাবার নাম ছিল ‘সামত আলী’। আবার কিছু কাগজপত্রে ‘চামত আলী’ এবং ‘চাহমত আলী’ হিসেবে তাঁর বাবার নাম লেখা হয়েছে।
নাগরিকত্ব বাতিলের পর আলী দুই বছর বন্দিশিবিরে কাটান। ২০১৪ সালে আসাম হাইকোর্টও ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রাখেন।
আলী বলেন, তিনি এতটাই দরিদ্র যে সুপ্রিম কোর্টে এই রায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার সামর্থ্য তাঁর নেই।
‘তারা আমাকে বাংলাদেশি বানিয়ে দিল’
বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এমন অনেক মুসলিমের নাগরিকত্ব–সংক্রান্ত মামলা এখনো আদালতে বিচারাধীন।
হয়রানির শিকার এসব মুসলিমের দাবি, এ পরিস্থিতিতে তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারের ধরপাকড় বেআইনি। তারা অবৈধ বিদেশি ধরার নামে ইচ্ছামতো হয়রানি করছে।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা স্বীকার করেছেন, ‘যাদের মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে, এমন কিছু মানুষকে কূটনৈতিক চ্যানেলে বাংলাদেশ থেকে ফেরত আনা হয়েছে।’
তাঁদের একজন হলেন সোনা বানু। তিনি রাজ্যের বরপেটা জেলার বুড়িখামার গ্রামের বাসিন্দা। তাঁকে ২৭ মে বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে পাঠানো হয়।
৫৯ বছর বয়সী সোনা বানু আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আমি কখনো ভাবিনি, যে দেশে আমি জন্মেছি, যেখানে আমার মা–বাবা ও দাদু-দাদির জন্ম, সেই দেশ আমাকে বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে পাঠাবে। তারা আমাকে বাংলাদেশি বানিয়ে দিল। অথচ বাংলাদেশকে আমি জীবনে কেবল ১০ মিটার দূর থেকে দেখেছি, নো ম্যানস ল্যান্ডের পাশে দাঁড়িয়ে।’
মোরিগাঁও জেলার মিকিরভেটা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে জোরপূর্বক ঠেলে দেওয়া যেন আমার জন্য মৃত্যুদণ্ডের মতো ছিল।’
আসামের মুসলিম খায়রুল
খায়রুল ইসলাম বলেন, প্রাসঙ্গিক দলিল-দস্তাবেজ থাকার পরও ২০১৬ সালে তাঁকে ‘বিদেশি’ নাগরিক ঘোষণা করা হয়। তাঁর পরিবার ব্রিটিশ আমলের জমির দলিল আদালতে জমা দিয়েছিল, যেখানে তাঁর দাদার নামে ভূমি রেকর্ড ছিল। তিনি এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছেন।
খায়রুল বলেন, ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে কাটানো সময় আমাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। আমাদের শরণার্থীর চেয়েও খারাপ অবস্থায় রাখা হয়েছিল। আমাদের কষ্ট পুরো পৃথিবীর চোখে দৃশ্যমান ছিল। আমরা যেন ভারত ও বাংলাদেশ—উভয় দেশের জন্যই বিদেশি ছিলাম।’
কিন্তু ৫০ বছর বয়সী নিজাম আহমেদ সরকারি নথি অনুযায়ী, কোনোভাবেই বিদেশি ছিলেন না। গোলাঘাট জেলার জামুগুড়ি চা–বাগান এলাকায় ট্রাকচালক হিসেবে কর্মরত নিজামের নাম এনআরসিতে রয়েছে। তবু তাঁকে নো ম্যানস ল্যান্ডে ফেলে দেওয়া হয়।
নিজামের ছেলে জাহিদ বলেন, একটি ভাইরাল ভিডিও থেকে তিনি তাঁর বাবার আটক হওয়ার খবর জানতে পারেন। ওই ভিডিওতে তাঁর বাবাকে বিজিবির সদস্যদের সঙ্গে দেখা যায়।
জাহিদ বলেন, ‘[আমরা] ভারতীয়। আমার দাদা সেকেন্ড আসাম পুলিশ ব্যাটালিয়নে ছিলেন।’
আল–জাজিরা এ তথ্য যাচাই করে নিশ্চিত করেছে, নিজামের বাবা সেলিম উদ্দিন আহমেদ ১৯৬০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত রাজ্য পুলিশের সদস্য ছিলেন।
জাহিদ বলেন, ‘আমার দাদা যদি এখন বেঁচে থাকতেন, এটা তাঁকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিত। একজন পুলিশ কর্মকর্তার ছেলেকে বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হলো।’
‘ফিরে এলে গুলি করব’
সম্প্রতি ভারতের বিজেপিশাসিত অন্যান্য রাজ্যেও কথিত অবৈধ বাংলাদেশিদের বিতাড়নের অভিযান ছড়িয়ে পড়েছে।
গুজরাট রাজ্যের প্রধান শহর আহমেদাবাদের পুলিশ জানিয়েছে, তারা ২৫০ জনের বেশি ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে। এসব ব্যক্তি ‘অবৈধভাবে এখানে বসবাস’ করছেন। তাঁরা ‘বাংলাদেশি অভিবাসী’ বলে পুলিশ দাবি করছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে পুলিশ কর্মকর্তা অজিত রাজিয়ানের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের বহিষ্কারের প্রক্রিয়া চলছে।
ভারতের সবচেয়ে ধনী রাজ্য মহারাষ্ট্রেও গত মাসে সাতজন মুসলিমকে বিদেশি দাবি করে আটক করে পুলিশ। পরে তাঁদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর জন্য বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
তবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপে ১৫ জুন তাঁদের সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে আনা হয় বলে জানান পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য সমীরুল ইসলাম। এ দলটি বিজেপিবিরোধী ইন্ডিয়া জোটের শরিক।
সমীরুল আল–জাজিরাকে বলেন, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ও অন্যান্য রাজ্য কর্তৃপক্ষ মহারাষ্ট্র পুলিশকে জানিয়েছিল, এসব ব্যক্তি পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা, তাঁরা ভারতীয় নাগরিক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ বা সরকারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না করেই তাঁদের বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।
১৬ জুন কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহারাষ্ট্র পুলিশের কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণেই তাঁদের বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আল–জাজিরার সঙ্গে কথা বলা ওই সাত মুসলিমের মধ্যে তিনজন বলেন, তাঁরা যখন মহারাষ্ট্র পুলিশের হেফাজতে ছিলেন, তখন পরিবার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁদের ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণস্বরূপ কাগজপত্র জমা দেয়।
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বাসিন্দা মিরানুল শেখ ও নিজামউদ্দিন শেখকে আরেকটি ভাইরাল ভিডিওতে নো ম্যানস ল্যান্ডে দেখা গেছে।
৩২ বছর বয়সী মিরানুল আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা বারবার বলছিলাম, আমরা মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছি। কিন্তু বিএসএফ আমাদের মারধর করেছে। তারা গালাগাল করে বলেছিল, “ফিরে এলে গুলি করব।”’
আল–জাজিরা ১৯ জুন বিএসএফের কাছে এসব অভিযোগ সম্পর্কে মন্তব্য জানাতে ই–মেইল করলেও এই প্রতিবেদন করা পর্যন্ত কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
আসামের ‘মিয়া’ মুসলিমরা
এই ব্যাপক অভিযান চলাকালে আসামের পুলিশ ২৫ মে গোলাঘাট জেলার নোয়াজান গ্রাম থেকে বাংলাভাষী মুসলিম আবদুল হানিফকে তাঁর বাড়ি থেকে আটক করে। কিন্তু তাঁকে আটকের কোনো কারণ জানানো হয়নি।
আল–জাজিরাকে হানিফের বড় ভাই দীন ইসলাম বলেন, পুলিশ বলেছিল, দুই দিনের মধ্যে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
পূর্ব আসামে বাংলাভাষী মুসলিমদের জন্য পুলিশি অভিযান নতুন কিছু নয়। রাজ্যের চা-বাগান অঞ্চলে অভিবাসীবিরোধী মনোভাব ব্যাপকভাবে দেখা যায়। তবে পুলিশ যে এটি একটি ‘রুটিন যাচাই-বাছাই অভিযান’ বলে উল্লেখ করেছে, সেটিই হানিফকে খুঁজে বের করতে পরিবারকে মরিয়া করে তোলে।
দীন ইসলাম বলেন, ‘আমরা তার খোঁজে এক থানা থেকে আরেক থানায় ঘুরছি; কিন্তু পুলিশ কিছু বলছে না।’
দীন ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী, হানিফকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল গোলাঘাটের পুলিশ সুপার রাজেন সিংয়ের কার্যালয়ে। সেখানে হানিফসহ আরও কয়েকজনকে আটক রাখা হয়েছিল। পরে তাঁদের সবাইকে বাংলাদেশ সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
হানিফের পরিবার দৃঢ়তার সঙ্গে বলছে, তিনি বিদেশি নন। দীন ইসলাম বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে কোনো ট্রাইব্যুনালে মামলা নেই। শুধু আমরা “মিয়া” বলে সন্দেহ থেকে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
আসামে মিয়া একটি অপমানসূচক শব্দ, যা আদিবাসী অসমিয়ারা বাংলাভাষী মুসলিমদের ‘বাংলাদেশি’ বোঝাতে ব্যবহার করে।
আল–জাজিরা হানিফের অবস্থান জানতে চাইলে পুলিশ সুপার রাজেন সিং বলেন, এ ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায় না।
হানিফের সঙ্গে রাজেন সিংয়ের কার্যালয়ে ছিলেন একজন স্থানীয় ব্যক্তি। তিনি বলেন, তাঁদের দলটিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। হানিফকে সম্ভবত বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছে।
নিজের পরিচয় গোপন রেখে স্থানীয় ওই ব্যক্তি বলেন, তাঁকেও বাংলাদেশ সীমান্তে নেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, মানুষ রাতারাতি গায়েব হয়ে যাচ্ছে। হানিফ হয়তো অনেকের মতো বাংলাদেশে হারিয়ে গেছেন।
আল–জাজিরা স্বাধীনভাবে নিশ্চিত করেছে, গত মাসে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী যাঁদের জোর করে নো ম্যানস ল্যান্ডে ঠেলে পাঠিয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্তত ১০ জনের অবস্থান এখনো অজানা।
নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধানের জন্য আসামে অন্তত চারটি পরিবার হাইকোর্টে আবেদন করেছে। তাদের মধ্যে অন্তত দুটি পরিবার ‘দেশি’ মুসলিম সম্প্রদায়ের, যাদের রাজ্য সরকার নিজস্ব আদিবাসী মুসলিম হিসেবে গণ্য করে।
সামসুল আলীর ছেলে বক্কার আলী বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, আমরা আদিবাসী মুসলিম; তাই নিরাপদ। কিন্তু এখন দেখছি, এখানে কোনো মুসলিমই নিরাপদ নন।’
বক্কার বলেন, তাঁর বাবাকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছে। এখন তিনি সে দেশের পুলিশের হেফাজতে আছেন।
বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার জেল সুপার আমিরুল ইসলাম ১৬ জুন আল–জাজিরাকে জানান, আরেকজন ভারতীয় নাগরিক দইজান বিবি বাংলাদেশ পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন।
নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের মুখপাত্র ফয়সাল মাহমুদ আল–জাজিরাকে বলেন, বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারকে একটি কূটনৈতিক বার্তা পাঠিয়েছে, যাতে বলা হয়েছে, বিএসএফ যে পদ্ধতিতে মানুষকে বাংলাদেশ সীমান্তে ঠেলে দিচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে হচ্ছে না।
ভারতীয় বাহিনী মুসলিমদের বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে—এমন অভিযোগ নিয়ে আল–জাজিরা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে মন্তব্য জানতে চাইলেও এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা (২৪ জুন) পর্যন্ত কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
‘মুসলিমদের বেছে বেছে ঠেলে পাঠানো হয়েছে’
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর এবং কিংস কলেজ লন্ডনের যৌথ ডক্টরাল ফেলো এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের বিশ্লেষক অংশুমান চৌধুরী বলেছেন, আসাম সরকার যে কথিত ‘অবৈধ অভিবাসী’দের ঠেলে পাঠানোর (পুশ ব্যাক) দাবি করছে, তা আসলে ‘জোরপূর্বক বহিষ্কার’।
আল–জাজিরাকে অংশুমান চৌধুরী বলেন, ‘পুশ ব্যাক’ অর্থ হচ্ছে—যে অভিবাসীরা আপনার সীমান্তে ঢোকার চেষ্টা করছেন, তাঁদের ঠেলে ফেরত পাঠানো। কিন্তু সরকার যা করছে, তা হলো মানুষকে ধরে তুলে নেওয়া এবং তাদের আরেকটি দেশে ছুড়ে ফেলা।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার সরকার যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেটিকে তিনি ন্যায্য বলেই মনে করছেন। কারণ, তিনি ১৯৫০ সালের একটি আইনের কথা উল্লেখ করছেন, যা জেলা কমিশনারদের নির্দিষ্ট কিছু কাগজপত্রহীন অভিবাসীকে বহিষ্কার করার ক্ষমতা দেয়।
কিন্তু আসাম হাইকোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ওলিউল্লাহ লস্কর বলছেন, এই আইন কেবল তাঁদের জন্য, যাঁরা অবৈধভাবে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছেন বা যাঁরা ভিসার মেয়াদ শেষে থেকে যাচ্ছেন।
ওলিউল্লাহ লস্কর আল–জাজিরাকে বলেন, যাঁরা বহু প্রজন্ম ধরে আসামে বসবাস করছেন এবং যাঁদের হাতে রাজ্য সরকার-প্রদত্ত নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এই আইন নয়।
সরকারি প্রতিশোধের আশঙ্কায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন আইনজীবী বলেন, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টে ‘ঘোষিত বিদেশি’ বন্দিদের বিষয়ে শুনানির সময় আসাম সরকার নিজেই বলেছে, যাঁদের বাংলাদেশের ঠিকানা জানা নেই, তাঁদের বহিষ্কার করা সম্ভব নয়।
সরকার এক হলফনামায় বলেছে, বিনীতভাবে অনুরোধ করা হচ্ছে যে সংশ্লিষ্ট বিদেশি দেশের নাগরিকত্ব যাচাই ও ভ্রমণ অনুমতির (ট্রাভেল পারমিট) ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত এই বন্দিদের বহিষ্কার করা যাবে না।
অমুসলিম, বিশেষ করে হিন্দুদের যাঁরা ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে আসামে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের মামলাগুলো ট্রাইব্যুনালে না পাঠাতে গত বছর আসাম সরকার পুলিশকে নির্দেশ দেয়। এ তারিখটি ছিল ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) অনুযায়ী নির্ধারিত সময়সীমা।
২০১৯ সালের এ আইন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ওই নির্ধারিত তারিখের আগে প্রতিবেশী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে ‘ধর্মীয় নির্যাতনের’ শিকার অমুসলিমদের কেউ ভারতে প্রবেশ করলে তাঁদের জন্য সে দেশের নাগরিকত্ব পাওয়া সহজতর করা হয়েছে। এই আইনের বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। কারণ, এটি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের লঙ্ঘন বলে অভিযোগ ওঠে। জাতিসংঘ একে ‘মৌলিকভাবে বৈষম্যমূলক’ বলে অভিহিত করেছে।
ক্ষুব্ধ আলী বলেন, ‘আমাদের জাতীয়তা প্রমাণ করতে ২০-৩০টা কাগজ দেখাতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দুরা শুধু বললেই হয়, তারা হিন্দু, তাহলেই তারা নাগরিকত্ব পেয়ে যায়।’
বিএসএফ সীমান্তে ধরে নিয়ে যাওয়া ৫০ বছর বয়সী রহিমা বেগম গোলাঘাটে নিজের বাড়ির বাইরে বসে আল–জাজিরাকে বলেন, যে দেশকে তিনি নিজের দেশ মনে করেন এবং যেখানে তাঁর জন্ম, এখন তিনি সেই দেশের কাছে নিজেকে প্রতারিত মনে করেন।
রহিমা বলেন, ‘এই দেশ আমার, কিন্তু আমি এ দেশের নই।’
![]() |
| ৪ থেকে ৭ মে ভারত থেকে ১৬৭ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ছবি: বন বিভাগের সৌজন্যে |

No comments