ট্রাম্পের এশিয়া সফর: চুক্তি, নতজানু কূটনীতি ও আমেরিকার প্রাপ্তি

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের বিদেশ সফর সাধারণত হয় বিশ্বমঞ্চে আমেরিকার শক্তি প্রদর্শনের এক বড় সুযোগ হিসেবে। কিন্তু ডনাল্ড ট্রাম্পের পাঁচ দিনের পূর্ব এশিয়া সফর ছিল একেবারেই অন্যরকম। এটি ছিল ট্রাম্প নামে এক ব্যক্তির ক্ষমতার প্রদর্শন। তবে সেই সঙ্গে তার সীমাবদ্ধতারও এক প্রকাশ। অনলাইন বিবিসির সাংবাদিক অ্যান্থনি জারচার ট্রাম্পের এশিয়া সফরকে এভাবে মূল্যায়ন করেছেন।

তিনি আরও লিখেছেন, প্রথম চার দিন মালয়েশিয়া, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ট্রাম্পের সফর ছিল এমন এক কূটনৈতিক অনুশীলন, যেখানে সবাই চেষ্টা করছিল এক অস্থির ও অনিশ্চিত মার্কিন প্রেসিডেন্টকে খুশি রাখতে। কারণ ট্রাম্প এক কলমের ছোঁয়ায় শুল্ক বা অন্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন, যা রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিগুলোর জন্য ভয়াবহ হতে পারে।

তবে বৃহস্পতিবার চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তার বৈঠক ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। এটি ছিল দুই সমমর্যাদার পরাশক্তির নেতার মুখোমুখি হওয়া। সেখানে দুই দেশের অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক মর্যাদা এবং নাগরিকদের কল্যাণ, সবকিছুরই বড় ঝুঁকি জড়িত। চীনের ক্ষেত্রে ট্রাম্প কলম চালাতে পারেন, কিন্তু এর পরিণতিও ভয়াবহ। প্রথম চার দিন সফর ছিল বেশ মসৃণ। প্রতিটি স্টপে ছিল বাণিজ্য আলোচনা ও ট্রাম্পকে তুষ্ট করার এক প্রদর্শনী, যা অনেক সময় সীমা ছাড়িয়ে চাটুকারিতার পর্যায়ে পৌঁছায়।

মালয়েশিয়ায় ট্রাম্প গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদে প্রবেশাধিকার পান এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির পথে অগ্রগতি করেন। পাশাপাশি তিনি থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্ত উত্তেজনা প্রশমনে এক ‘শান্তি চুক্তি’ তত্ত্বাবধান করেন, যা ট্রাম্প পছন্দ করেন দেখাতে।

জাপানে ট্রাম্পের হেলিকপ্টার মেরিন ওয়ান টোকিও টাওয়ারের পাশ দিয়ে উড়ে যায়, যা সেদিন আমেরিকার পতাকার লাল-সাদা-নীলে আলোকিত ছিল, আর টাওয়ারের চূড়া ছিল সোনালি- ‘ট্রাম্পীয়’ রঙে।

নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী সানাই তাকাইচি যুক্তরাষ্ট্রে ৫৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেন এবং ট্রাম্পকে উপহার দেন ২৫০টি চেরি গাছ (আমেরিকার ২৫০তম জন্মবার্ষিকীর উপহার হিসেবে) ও প্রয়াত শিনজো আবের ব্যবহৃত গলফ ক্লাব ও ব্যাগ। তাকাইচি ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্যও মনোনয়ন দেন।

দক্ষিণ কোরিয়ায় ট্রাম্পকে রাজকীয়ভাবে স্বাগত জানানো হয়। কামান থেকে ২১ রাউন্ড গান স্যালুট, সামরিক ব্যান্ডে বাজানো হয় ‘হেইল টু দ্য চিফ’ এবং ট্রাম্পের প্রিয় সংগীত ওয়াইএমসিএ। প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং ট্রাম্পকে দেশের সর্বোচ্চ পদক ও এক প্রাচীন রাজবংশীয় মুকুটের প্রতিলিপি উপহার দেন। দুপুরের খাবারে পরিবেশন করা হয় ‘শান্তিদূতের মিষ্টান্ন’- সোনার প্রলেপ দেয়া ব্রাউনি। পরে ছয়টি দেশের নেতাদের নিয়ে ট্রাম্পের সম্মানে নৈশভোজে পরিবেশন করা হয় বিশেষ ওয়াইন।

আমেরিকায় হয়তো ট্রাম্পকেম ‘নো কিংস’ প্রতিবাদে সমালোচিত হতে হয়। কিন্তু এশিয়ায় তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই রাজাদের মতো সম্মানিত। আর রাজাদের মতোই, ট্রাম্পও এসেছিলেন ‘খাজনা’ নিতে- দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে ২০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থপ্রদান (প্রতি বছর ২০ বিলিয়ন ডলার), যা যুক্তরাষ্ট্রের তহবিলে যাবে। এর বিনিময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার রপ্তানিতে মার্কিন শুল্ক ২৫ ভাগ থেকে কমে ১৫ ভাগ করা হয়।

কিন্তু সফরের মূল আকর্ষণ ছিল চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে শেষ বৈঠক। এখানে আগের রাজকীয় আড়ম্বরের কিছুই ছিল না- না ব্যান্ড, না অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান। বরং বুসান বিমানবন্দরের পাশে এক সাধারণ সামরিক ভবনে দীর্ঘ টেবিলের দুই পাশে বসেছিলেন দুই নেতা ও তাদের উপদেষ্টারা।
ট্রাম্পের মুখে তখন টানটান ভাব- একদিন আগেও তিনি বলেছিলেন, আমি বেশ আশাবাদী, ভালো বৈঠক হবে।

কিন্তু এই বৈঠকের পেছনে ছিল মাসের পর মাসের উত্তেজনা। ট্রাম্প চীনকে উচ্চ শুল্কের হুমকি দিচ্ছিলেন, চীনা বাজার খুলে দিতে ও ফেন্টানিল তৈরির রাসায়নিক রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে চাপ দিতে। চীন পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখায়- আমেরিকার কৃষিপণ্য কেনা স্থগিত করে, এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রস্তাব দেয়।

অবশেষে বৃহস্পতিবারের বৈঠকে দুপক্ষ সমঝোতায় আসে- আমেরিকা শুল্ক কমাবে, চীন আবার কৃষিপণ্য আমদানি শুরু করবে, তেল ও গ্যাস কেনা বাড়াবে এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজে প্রবেশাধিকার দেবে। যদিও এটি কোনো যুগান্তকারী চুক্তি নয়, তবে একে উভয় পক্ষের বাস্তবতা স্বীকার বলে দেখা হচ্ছে।

শি বৈঠকের শুরুতে বলেন, বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে মতপার্থক্য হওয়া স্বাভাবিক। এটি হয়তো কিছুটা ইতিবাচক ইঙ্গিত, কিন্তু একই সঙ্গে জানিয়ে দেয় যে ‘ফ্রিকশন’ বা সংঘাত এখানেই শেষ নয়। চীন তার বৈশ্বিক প্রভাব বাড়াতে চায়, আর ট্রাম্প আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করছেন- যেখানে মিত্র ও প্রতিদ্বন্দ্বী উভয়কেই চাপ দিয়ে রাখা হয়।

ফলস্বরূপ, আমেরিকার ঐতিহ্যবাহী মিত্ররা- জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া- নতুন বাস্তবতায় নিজেদের অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ট্রাম্পকে খুশি রাখতে নানা রকম উপহার ও সম্মান দিচ্ছে। কিন্তু বড় আর্থিক দায়, বাড়তি প্রতিরক্ষা ব্যয় ও স্থায়ী শুল্কের বোঝা তাদের ভাবিয়ে তুলছে। শেষ পর্যন্ত এসবই আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার দিকে ঠেলে দিতে পারে- যা চীনের জন্য সুযোগ হয়ে উঠতে পারে।

ট্রাম্প যখন দক্ষিণ কোরিয়া ত্যাগ করছিলেন, ঠিক তখনই সেখানে পৌঁছাচ্ছিলেন শি জিনপিং- এ যেন এক প্রতীকী দৃশ্য। শি অংশ নিচ্ছেন এপেক সম্মেলনের পূর্ণাঙ্গ বৈঠকে, যেটি ট্রাম্প এড়িয়ে গেছেন। যদি আমেরিকা আন্তর্জাতিক নেতৃত্বে ফাঁক তৈরি করে, চীন সেই শূন্যস্থান পূরণে প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে। ট্রাম্প হয়তো এই সফরে নিজের চাওয়া সবকিছুই পেয়েছেন- কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, আমেরিকা কি পেয়েছে তার প্রয়োজনীয়টুকু?

https://mzamin.com/uploads/news/main/187356_trmps.webp

No comments

Powered by Blogger.