ট্রাম্প কেন মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চান by ইয়ান ব্রেমার

সংকেতটা ক্রমে জোরালো হচ্ছে যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চান। তিনি তা এমনভাবে করতে চান, যাতে পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে কোনো যুদ্ধ শুরু না হয়।

এ পর্যন্ত ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পদক্ষেপ সীমিত রয়েছে এক ডজনের বেশি নৌকায় হামলার মধ্যে। হোয়াইট হাউস দাবি করেছে, এসব নৌকায় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দশে মাদক বহন করা হচ্ছিল। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছেন, ‘এ মাদক আমাদের গোটা দেশের পরিবারগুলোকে ধ্বংস করছে।’ তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘এর মানে কি যুদ্ধ?’ উত্তরে ট্রাম্প বলেন, ‘আমার তা মনে হয় না। কিন্তু তারা আমাদের সঙ্গে খুব বাজে আচরণ করেছে।’ সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় ক্যারিবীয় সাগর ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন হামলায় অন্তত ৬৯ জন নিহত হয়েছেন।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় অঞ্চলে উল্লেখ করার মতো সামরিক শক্তি মোতায়েন করেছে। একটি বিমানবাহী রণতরিসহ সেনাসদস্যরা ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি অবস্থান করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরে হামলা চালাতে পারে। গত মাসে নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের বরাতে জানিয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন গোপনে সিআইএকে ভেনেজুয়েলায় গোপন অভিযান পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছে।

যদিও যুক্তরাষ্ট্রে যে পরিমাণ মাদক পাচার হয়ে আসে, তাতে ভেনেজুয়েলার ভূমিকা নগণ্য। এরপরও কারাকাসের প্রতি ওয়াশিংটনের এমন কঠোর অবস্থানের কারণ হলো ট্রাম্পের ‘মাগা’ (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) আন্দোলনের সমর্থক গোষ্ঠী ও লাতিন আমেরিকান পৃষ্ঠপোষকেরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকার মাদুরোর মতো বামপন্থী নেতাদের প্রতি খুব নরম আচরণ করছে। ২০১৩ সালে হুগো চাভেজের মৃত্যুর পর থেকে মাদুরো ক্ষমতায় আছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে।

এসব কারণেই ভেনেজুয়ালার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। এ চাপের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মাদুরোর ঘনিষ্ঠ মহলকে এটি মানতে বাধ্য করা যে এই শক্তিশালী নেতার প্রতি আনুগত্য বজায় রাখার মূল্য অনেক বেশি। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সংঘাত এড়াতে তাঁকে ভেতর থেকেই সরিয়ে দেওয়া উচিত। এ কৌশল যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে ট্রাম্প প্রশাসন সরাসরি মাদুরোকেই লক্ষ্যবস্তু করতে পারে।

ভেনেজুয়েলার নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতর থেকে মাদুরোর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে তখন যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার মধ্যে আলোচনার পথ খুলে যেতে পারে। সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে আসা কোনো নতুন প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা করতে পারেন।

সেনাবাহিনীর ভেতরে বিরোধী দলের প্রতি গভীর অবিশ্বাস রয়েছে, সে কারণে কম সম্ভাবনাময় আরেকটি দৃশ্যপটের কথাও চিন্তা করা যেতে। সেনাবাহিনীর কিছু অংশ বিরোধী নেতা মারিয়া মাচাদো ও এদমুন্দো গোনসালেসের পাশে দাঁড়াতে পারে অথবা নতুন নির্বাচনের দাবিতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

কিন্তু মাদুরোর লোকদের সঙ্গে আপসরফা করাটাই যুদ্ধ এড়ানোর একমাত্র উপায়। শাসক দল ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টি অব ভেনেজুয়েলা দেশটির সব শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে। মাদুরোকে আলাদা করতে চাইলে নিরাপত্তা বাহিনী এমন নিশ্চয়তা দাবি করবে, যাতে তাদের নিরাপত্তা, দেশের ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ ও সম্পদে প্রবেশগম্যতার অধিকার সুরক্ষিত থাকে।

ভেনেজুয়েলার পদস্থ সামরিক নেতৃত্ব জানেন, মাদুরো কিউবার গোয়েন্দাব্যবস্থাকে তাঁর নিজ দেশের জেনারেলদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তিতে ব্যবহার করেন। ফলে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে যেকোনো পদেক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টার মানেই মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকি। ফলে তাঁদের রাজি করাতে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি মাদুরো সরকারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের সরাসরি লক্ষ্যবস্তু করতে পারে, যাতে অন্যদের ওপর চাপ তৈরি করা যায়।

ট্রাম্প জানেন, মাদুরোকে সরাতে ব্যর্থ হলে সেটি তাঁর জন্য লজ্জার কারণ হবে। আর যদি মাদুরোকে সরাসরি মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপে সরানো হয়, ভেনেজুয়েলার ভেতরের পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এতে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে, যা তিনি সহজে নিতে চাইবেন না।

এটি ধরে নেওয়া হচ্ছে যে মার্কিন সেনাদের ঝুঁকিতে ফেলে ভেনেজুয়েলায় শৃঙ্খলা ফেরানোর ব্যাপারে হোয়াইট হাউসের গভীর অনাস্থা আছে। ভেনেজুয়েলায় গৃহযুদ্ধ হলে তাতে যে রক্তগঙ্গা বইবে, তার জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করা হবে। সিনেটে যেহেতু ট্রাম্পের যুদ্ধের ক্ষমতা সীমিত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মার্কিন প্রেসিডেন্টকেই নিতে হবে। এখন পর্যন্ত তিনি এমন কৌশল বেছে নিতে পারেননি, যা তাঁকে তাঁর কাঙ্ক্ষিত ফল এনে দেবে।

* ইয়ান ব্রেমার, টাইম–এর পররাষ্ট্রবিষয়ক কলাম লেখক
- টাইম থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো। রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.