ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক কেন ছাড়লেন ‘বিস্ময় বালক’ কাইরান কাজী? কারণ জানালেন তার মা জুলিয়া কাজী

মাত্র ১৪ বছর বয়সে ইলন মাস্কের কোম্পানি স্পেসএক্সের স্টারলিংক প্রকল্পে যোগ দিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল কাইরান কাজী। দুই বছর পর স্টারলিংক ছাড়ার ঘোষণায় আবার আলোচনায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই কিশোর। তাঁর মা জুলিয়া কাজীর কাছ থেকে এই বিস্ময়কর প্রতিভা সম্পর্কে আরও জানলেন তোফাজ্জল হোসেন

জুলিয়া কাজীর সঙ্গে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ। তাঁর ছেলে কাইরান কাজী স্টারলিংক ছেড়েছে জানার পর পেশাগত পরিচয় দিয়ে মেসেজ দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আলাপ করতে চাই। উত্তরে তিনি মিনিট পাঁচেক সময় দিলেন।

ওয়াল স্ট্রিটের সাবেক ফিন্যান্সিয়াল কর্মকর্তা জুলিয়া কাজী শুরুতেই বিনীত কণ্ঠে ছোট ছোট বাক্যে বললেন, ‘বাংলা বুঝতে পারি, ভালো বলতে পারি না।’ তবে কথা বলতে বলতে বুঝতে পারি, বাংলা তিনি ভালোই বলেন। কুশল বিনিময় করে জানতে চাইলাম, ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান কেন ছাড়ল কাইরান?

জুলিয়া কাজী বললেন পেছনের গল্প। কাইরানের কর্মস্থল ওয়াশিংটনের সিয়াটলে। আর তার কেমিক্যাল প্রকৌশলী বাবা মুজতাহিদ কাজী থাকেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। কাইরান চাকরি পাওয়ার পর নিজের চাকরি ছেড়ে ছেলের সঙ্গেই আছেন জুলিয়া। তবে সিয়াটলে মা-ছেলে ছাড়া তাঁদের নিকটাত্মীয় কেউ নেই। কমিউনিটিও ছোট। এই বিচ্ছিন্নতা মা-ছেলের ভালো লাগছিল না।

জুলিয়া কাজী বলেন, ‘এ ছাড়া কাইরান সপ্তাহে ৮০ থেকে ৯০ ঘণ্টা কাজ করত। স্টারলিংকের দায়িত্ব উপভোগ করলেও দুই বছর পর এসে সে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে চাচ্ছিল।’

বিশ্বের অনেক বড় প্রতিষ্ঠানই কাইরানকে চায়। তবে কাইরানের পছন্দ নিউইয়র্কের থাকা যাবে, এমন কোনো প্রতিষ্ঠান। এই শহরে তার নানি থাকেন। আছেন আরও আত্মীয়স্বজন। এসব বিবেচনায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান সিটাডেল সিকিউরিটিজে কোয়ান্ট ডেভেলপার হিসেবে যোগ দিচ্ছে কাইরান। ম্যানহ্যাটন পার্ক অ্যাভিনিউতে তার অফিস। অভিজাত একটি অ্যাপার্টমেন্ট পেয়েছে সে। অফিস থেকে যার হাঁটার দূরত্ব মিনিট দশেক। জুলিয়া কাজী বললেন, ‘বেতনের পরিমাণও সন্তোষজনক।’

কতটা সন্তোষজনক? পাঠকের আগ্রহের কথা ভেবে শিষ্টাচার ভেঙেই জানতে চাইলাম। জুলিয়া বললেন, প্রতিষ্ঠানের গোপনীয়তার নিয়ম অনুযায়ী এই তথ্য বলা বারণ।

তবে আমরা সিটাডেল সিকিউরিটিজে কাইরানের সমতুল্য পদের বেতনের খোঁজ করে জানতে পেলাম, বছরে এক মিলিয়ন ডলারের বেশি।

এসব আলাপে মিনিট পাঁচেকের সময় দ্রুতই ফুরিয়ে যায়। আরও কিছুটা সময় চাই বলে আবদার করলে জুলিয়া কাজী হাসিমুখে সায় দেন।

কাইরানের ছেলেবেলা

কাইরানের বাবা মুজতাহিদ কাজীর আদি নিবাস মানিকগঞ্জে হলেও তাঁর জন্ম ঢাকায়। বেড়ে ওঠা আর পড়াশোনা ব্রুনেই ও মালয়েশিয়ায়। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি ইউনিভার্সিটিতে আসেন পড়াশোনা করতে। জুলিয়া কাজীদের বাড়ি মৌলভীবাজারে। তিন বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান।

জুলিয়া ও মুজতাহিদের বিয়ে হয় ২০০০ সালে। কাইরানের জন্ম ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি। তার মা-বাবা তখন ক্যালিফোর্নিয়ার বে-এরিয়ায় থাকতেন। বড় হতে থাকলে দেখা গেল, কাইরানের আচরণ সমবয়সীদের চেয়ে আলাদা, স্মরণশক্তিও তীক্ষ্ণ। তার সামনে যে কথাই বলা হয়, টেলিভিশনে সে যা দেখে, সব মনে রাখতে পারে এবং বলতে পারে।

দুই বছর বয়স থেকেই মা-বাবার সঙ্গে বিজ্ঞান, রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মতো কথা বলত কাইরান। তিন বছর বয়সে কাইরানকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যান জুলিয়া। চিকিৎসক সব জেনে বললেন, ‘আপনাদের ছেলে অতিমানবীয় মেধাবী। এমন ‘‘রোগী’’ আমি আমার ক্যারিয়ারে আগে দেখিনি!’

জুলিয়া বলেন, ‘তারপর তো আপনারা জানেন। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ৯ বছর বয়সে বিশেষ প্রক্রিয়ায় কাইরান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করে। তারপর ১১ বছর বয়সে গণিতশাস্ত্রে অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি নেয়। ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা ক্লারা ইউনিভার্সিটি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করে ১৪ বছর বয়সে।’

১৭৪ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত সান্তা ক্লারা ইউনিভার্সিটির সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যাজুয়েট কাইরান। স্নাতক পড়ার সময়ই বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ইন্টেলে ইন্টার্নশিপ করে সে। পরে ব্ল্যাকবার্ড নামের একটি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানেও ইন্টার্নশিপ করেছে। আর দুই বছর আগে ১৪ বছর বয়সে স্টারলিংকে চাকরি পেয়ে তো বড় বড় গণমাধ্যমের শিরোনামই হয়েছে।

জুলিয়া কাজী বলছিলেন, কাইরান অত্যন্ত কৌতূহলী ছেলে। ছোটবেলায় যদি তাকে শেখার সুযোগ না দেওয়া হতো বা দিন-রাত আলোচনা করতে না দেওয়া হতো, তবে সে বিরক্ত হয়ে যেত। এখনো তার ইচ্ছেমতো পরিবেশ–পরিস্থিতি না হলে বিরক্ত হয়।

কাইরান কাজীকে সামাল দিতে গিয়ে তাঁর মা-বাবা আর দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করতে পারেননি। সে জন্য অবশ্য জুলিয়ার মনে কষ্ট নেই। এত বিরল মেধাবী সন্তানের মা হিসেবে যে সম্মান পান, তা–ইবা কজনের ভাগ্যে জোটে!

https://media.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2025-08-30%2Fu21afqkb%2F518224832101717358735855761680864372928337399n.jpg?rect=52%2C0%2C794%2C529&w=622&auto=format%2Ccompress&fmt=avif
১৪ বছর বয়সে স্টারলিংক প্রকল্পে যোগ দিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল কাইরান কাজী। ছবি: জুলিয়া কাজীর সৌজন্যে

No comments

Powered by Blogger.