ঘরে ফিরে গাজাবাসী দেখছেন চারদিকে শুধুই ধ্বংসস্তূপ

আল–জাজিরা ও রয়টার্সঃ টানা প্রায় দুই বছর ধরে ইসরায়েলি হামলা থেকে প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে বেড়ানো আমির আবু ইয়াদেহর জীবনে আপাত স্বস্তি এনেছে যুদ্ধবিরতি। গতকাল শনিবার গাজার এই তরুণ বলেন, দুঃখ-কষ্ট যতই হোক, অবশেষে নিজের বাড়িতে ফিরতে পেরেছেন। এ জন্য তিনি মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ জানান। আসলে বাড়ি বলতে এখন আছে শুধু ধ্বংসস্তূপ।

ইতিমধ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতির এক দিন পার হয়েছে। গত শুক্রবার দুপুরে উপত্যকাটিতে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এরপর উদ্বাস্তু লাখো ফিলিস্তিনি তাঁদের বিধ্বস্ত বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেন। ইসরায়েলি হামলা বন্ধ হওয়ায় বাড়ির ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও শুক্রবার রাতটি অনেকটা নির্ভয়ে কাটিয়েছেন বলে জানিয়েছেন অনেক ফিলিস্তিনি।

গাজায় সংঘাত বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০ দফা ‘শান্তি পরিকল্পনা’ ঘোষণা করেন। ইসরায়েল ও গাজার স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস এই পরিকল্পনায় রাজি হলে স্থানীয় সময় শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।

দুই বছরে গাজায় প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা দখল করে নেয় ইসরায়েল। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, প্রথম দফায় সেনা সরানোর পর গাজার ৫৩ শতাংশ এলাকা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। গতকাল ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, প্রথম ধাপের সেনা সরানোর কাজটি শেষ করেছে তারা। তবে এ বিষয়ে হামাসের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থা জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পর গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৫ লাখ ফিলিস্তিনি উত্তর গাজায় তাঁদের বাড়িঘরে ফিরেছেন। এ সময়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার হয়েছে দেড় শতাধিক মরদেহ।

যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, আগামীকাল সোমবার দুপুরের মধ্যে হামাসের কাছে থাকা সব জিম্মিকে ছেড়ে দিতে হবে। আর ১ হাজার ৯৫০ ফিলিস্তিনি বন্দী ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন।

হামাসের কাছে থাকা ৪৮ জিম্মির মধ্যে জীবিত আছেন ২০ জন। হামাস নেতাদের বরাতে আল-জাজিরা জানিয়েছে, মুক্তি দিতে এই ২০ জিম্মিকে এক জায়গায় করেছে হামাস। অন্যদিকে ইসরায়েলি কারা কর্তৃপক্ষ গতকাল সন্ধ্যায় জানায়, ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করেছে তারা।

এ পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্য সফরে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, আগামীকাল দুপুরে ইসরায়েলে পৌঁছাবেন তিনি। মিসরে গাজা চুক্তির আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সোমবারই ট্রাম্প দেশটিতে যাবেন। মিসরের পর্যটন শহর শারম আল শেখে এই অনুষ্ঠান হবে।

চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে থাকবেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরাও। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর এ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার বিষয়টি গতকাল নিশ্চিত করেছে ফরাসি প্রেসিডেন্টের কার্যালয় এলিসি প্রাসাদ। বিবিসি জানিয়েছে, ইতালি ও স্পেনের প্রধানমন্ত্রীও এতে অংশ নেবেন।

‘আর যেন পালাতে না হয়’

ইসরায়েলের হামলার মুখে গত প্রায় দুই বছরে গাজার বাসিন্দাদের বহুবার বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে হয়েছে। তেমন একজন আরিজ আবু সাদায়েহ। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই নারী বলেন, ‘ইসরায়েল আমার ছেলেমেয়েকে কেড়ে নিয়েছে। তাদের হারানোর বেদনা খুব গভীর। কিন্তু খুশি যে যুদ্ধ থেমেছে। আমি ঘরে ফিরতে পেরেছি।’

বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, লাখো ফিলিস্তিনি দক্ষিণ থেকে গাজার উত্তর দিকে যাচ্ছেন। বাড়িঘর হারানো এসব মানুষ সঙ্গে যা আছে, তাই কাঁধে করে হাঁটছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তাঁদের অনেকেই ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটে নিজেদের বসতভিটায় ফিরছেন। সেখানে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে তাঁবুতে রাত যাপন করেন অনেক ফিলিস্তিনি।

৩৯ বছর বয়সী মুহাম্মদ মুর্তজার বাড়ি গাজা নগরীতে। আরও অনেকের সঙ্গে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। তাঁর একমাত্র আশা, চূড়ান্তভাবে যেন এ যুদ্ধ শেষ হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু চাই, এই যুদ্ধটা চিরতরে শেষ হোক। আমাদের যেন আর কোনো দিনও পালিয়ে যেতে না হয়।’

গাজা নগরীর আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘আজ রাতের আকাশে বোমা নেই, ড্রোন নেই, নেই কমলারঙা আকাশ। চারপাশে সুনসান নীরবতা, যা বহুদিন এখানে দেখা যায়নি।’

ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৫৫ মরদেহ উদ্ধার

যুদ্ধবিরতি শুরুর পর গাজার জরুরি সেবা বিভাগের কর্মীরা ধসে পড়া ভবনগুলোতে জীবিত অথবা মৃত মানুষের খোঁজে অভিযান চালাচ্ছেন। গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পর ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে থাকা অন্তত ১৫৫টি মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। সংস্থাটির মুখপাত্র মাহমুদ বাশাল সিএনএনকে বলেন, এখনো ১০ হাজার মরদেহ ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে রয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় টানা নৃশংসতা চালায় ইসরায়েল। এর মধ্যে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ মাত্র দুই মাস সময় গাজায় যুদ্ধবিরতি ছিল। বাকি সময় উপত্যকাটিতে নির্বিচার হামলা চালিয়ে ৬৭ হাজার ৬৮২ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৭০ হাজার। এটাকে জাতিগত নিধন বলে গত মাসে জাতিসংঘের একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

পর্যাপ্ত ত্রাণ ঢোকেনি গাজায়

নির্বিচার হামলার পাশাপাশি গাজা অবরোধ করে রাখে ইসরায়েলি বাহিনী। খুবই সামান্য পরিমাণ ত্রাণ গাজায় প্রবেশ করতে দেয় তারা। এতে ২৩ লাখ বাসিন্দার এ উপত্যকায় তীব্র খাদ্যসংকট চলছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গাজার কিছু অংশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।

প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, গাজায় প্রতিদিন ত্রাণবাহী ৬০০টি ট্রাক ঢুকতে দেওয়ার কথা। কিন্তু যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী শুক্রবার সেই সংখ্যায় ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় ঢুকতে শুরু করেছে কি না, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ গতকাল জানিয়েছে, গাজায় পাঠানোর জন্য ত্রাণবাহী শত শত ট্রাক তারা প্রস্তুত করে রেখেছে। আজ রোববার থেকে ত্রাণবাহী গাড়ি গাজায় নিয়ে যাওয়ার আশা করছে তারা। তবে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সিএনএনকে জানানো হয়েছে, শনিবার গাজায় ত্রাণের ট্রাক প্রবেশ শুরু হয়েছে।

ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের জন্য আগামী মঙ্গলবার থেকে রাফা ক্রসিং খুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ইতালির প্রতিরক্ষামন্ত্রী গুইদো ক্রসেত্তো। গতকাল তিনি বলেন, মিসর সীমান্ত লাগোয় রাফা ক্রসিং যত দ্রুত সম্ভব চালু করার জন্য ইসরায়েল কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে অনিশ্চয়তা

ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও দ্বিতীয় ধাপের শর্তগুলো নিয়ে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সমঝোতা হয়নি। বিশেষ করে হামাসের অস্ত্রসমর্পণ ও গাজা শাসনে কারা যুক্ত হবে, তা নিয়ে দুই পক্ষের অবস্থান ভিন্ন। এতে দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

হামাস এবং গাজার অপর দুই প্রতিরোধ সংগঠন ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ ও পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন (পিএফএলপি) গতকাল যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে সংগঠন তিনটি বলেছে, গাজার ভবিষ্যৎ শাসনে বিদেশিদের মেনে নেওয়া হবে না।

এদিকে ইসরায়েল বারবার বলে এসেছে, হামাস অস্ত্রসমর্পণ না করা পর্যন্ত এই যুদ্ধের সমাপ্তি টানবে না তারা। যেভাবেই হোক হামাসকে নির্মূল করবে। এ ছাড়া যুদ্ধপরবর্তী গাজা শাসনে হামাসের কোনো সংশ্লিষ্টতা মেনে নেবে না বলেও জানিয়েছে ইসরায়েল।

তবে প্রথম ধাপের পরও যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প। স্থানীয় সময় শুক্রবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকেরা এ নিয়ে প্রশ্ন করেন ট্রাম্পকে। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘এটা (যুদ্ধবিরতি) কার্যকর থাকবে। লড়াই করতে করতে তারা সবাই (ইসরায়েল ও হামাস) ক্লান্ত।’

ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির পর গাজায় প্রবেশ করেছে ত্রাণবাহী ট্রাক। ফিলিস্তিনিরা সংগ্রহ করছেন জরুরি ত্রাণসহায়তা। গতকাল দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির পর গাজায় প্রবেশ করেছে ত্রাণবাহী ট্রাক। ফিলিস্তিনিরা সংগ্রহ করছেন জরুরি ত্রাণসহায়তা। গতকাল দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে। ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.