‘ভারত আমাদের হাত বেঁধে, মুখ ঢেকে বন্দীদের মতো করে নিয়ে যায়—এরপর সমুদ্রে ফেলে দেয়’
মিয়ানমারে এখন একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছে। ২০২১ সালে ক্ষমতা দখল করা জান্তার অনুগত বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষুদ্র–জাতিগোষ্ঠীর মিলিশিয়া ও সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনীর সংঘর্ষ চলছে। এ পরিস্থিতিতে নুরুলের আবার তাঁর পরিবারকে দেখার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোটায়।
‘আমি মানতেই পারি না যে আমার মা–বাবা ও যাঁদের বিতাড়ন করা হয়েছে, তাঁরা কী কষ্টে আছেন’, দিল্লিতে বিবিসিকে বলছিলেন ২৪ বছর বয়সী নুরুল।
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে বিতাড়নের তিন মাস পর, বিবিসি মিয়ানমারে থাকা ওই শরণার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে লড়াইরত ‘বা হ্তু আর্মি (বিএইচএ)’ প্রতিরোধ দলের সঙ্গে থাকছেন।
‘আমরা মিয়ানমারে নিরাপদ বোধ করি না। এখানে পুরো এলাকা যুদ্ধক্ষেত্রের মতো’, ভিডিও কলের মাধ্যমে বলেছেন সৈয়দ নুর। একটি বিএইচএ সদস্যের ফোন থেকে কল করেছেন তিনি। নুর একটি কাঠের তৈরি আশ্রয়শিবিরে ছিলেন। তাঁর চারপাশে ছিলেন আরও ছয়জন শরণার্থী।
বিবিসি এসব শরণার্থীর সাক্ষ্য সংগ্রহ করেছে, দিল্লিতে থাকা তাঁদের আত্মীয়দের কথা শুনেছে এবং তাঁদের অভিযোগ তদন্ত করা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এই প্রতিবেদন সাজিয়েছে।
জানা গেছে, এই ব্যক্তিদের দিল্লি থেকে বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপে উড়োজাহাজে করে নেওয়া হয়, পরে নৌযানে রাখা হয়। এরপর জীবনরক্ষাকারী জ্যাকেট পরিয়ে আন্দামান সাগরে ফেলা হয়। তীরে পৌঁছে এখন মিয়ানমারে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি তাঁরা। নিষ্ঠুর নির্যাতন–নিপীড়নের মুখে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বহু রোহিঙ্গা মুসলিম দেশটি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।
‘তারা (ভারতীয় কর্তৃপক্ষ) আমাদের হাত বেঁধে, মুখ ঢেকে বন্দীদের মতো করে নিয়ে গেছে। তারপর (নৌকায় উঠিয়ে) সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে’, ওই শরণার্থী দলের এক সদস্য জন তাঁর ভাইকে ফোনে বলেছেন।
‘মানুষকে কীভাবে শুধু সমুদ্রে ফেলা যায়?’, প্রশ্ন করেছেন নুরুল আমিন। ‘বিশ্বে মানবিকতা বেঁচে আছে, কিন্তু আমি ভারত সরকারের মধ্যে কোনো মানবিকতা দেখিনি।’
মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার থমাস অ্যান্ড্রু বলেছেন, (ভারতের বিরুদ্ধে) এ অভিযোগের সপক্ষে ‘গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ’ রয়েছে। তিনি এ তথ্য জেনেভায় ভারতের মিশনপ্রধানের কাছে উপস্থাপন করেছেন, কিন্তু এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া পাননি।
বিবিসিও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেছে। তবে এ প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের অবস্থা ভারতে শঙ্কাজনক। ভারত রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না; বরং ‘ফরেনার্স অ্যাক্ট’ অনুযায়ী অবৈধ অভিবাসী হিসেবে গণ্য করে।
ভারতে রোহিঙ্গাদের একটি বড়সংখ্যক জনগোষ্ঠী রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় রয়েছে বাংলাদেশে। সেখানে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করেন। বেশির ভাগই ২০১৭ সালে মিয়ানমারে শুরু হওয়া নিষ্ঠুর সেনা অভিযান থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছেন। মিয়ানমারে বহু প্রজন্ম ধরে বসবাস করা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি নেই।
ভারতে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ২৩ হাজার ৮০০। তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করছে, প্রকৃত সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশি।
গত ৬ মে দিল্লির বিভিন্ন অংশে বসবাসকারী ও ইউএনএইচসিআরের শরণার্থী কার্ডধারী ৪০ জন রোহিঙ্গাকে স্থানীয় থানা থেকে বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের ছবি তোলা ও আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। কয়েক ঘণ্টা পর একটি আটক শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। বিবিসিকে তাঁরা এ তথ্য জানান।
নুরুল বলেন, তাঁর ভাই তখন তাঁকে ফোন করে জানায়, তাঁকে মিয়ানমারে নেওয়া হচ্ছে এবং তাঁকে (নুরুল) আইনজীবী নিযুক্ত করতে ও ইউএনএইচসিআরকে জানাতে বলে।
৭ মে শরণার্থীদের দিল্লির পূর্বে হিন্দন বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে তাঁরা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের জন্য উড়োজাহাজে ওঠেন।
‘উড়োজাহাজ থেকে নামার পর আমরা দেখেছি, দুটি বাস আমাদের নেওয়ার জন্য এসেছে’, ভিডিও কলের মাধ্যমে বললেন সৈয়দ নুর। তিনি আরও বলেন, বাসের পাশে লেখা ছিল ‘ভারতীয় নৌসেনা’। এটি ভারতীয় নৌবাহিনীকে বোঝায়।
‘যত দ্রুত সম্ভব আমরা বাসে উঠলাম, আমাদের হাত প্লাস্টিক দিয়ে বাঁধা হলো এবং মুখ কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হলো’, বলেন নুর।
বাসে থাকা লোকজনের পরিচয় জানা যায়নি, তবে সামরিক পোশাক পরিহিত এই ব্যক্তিরা হিন্দি ভাষায় কথা বলছিলেন।
সংক্ষিপ্ত বাসভ্রমণের পর শরণার্থী দলকে বঙ্গোপসাগরে একটি নৌযানে ওঠানো হয়; সেখানে হাত খোলা ও মুখের কাপড় সরানোর পর বিষয়টি বুঝতে পারেন তাঁরা। শরণার্থীরা নৌযানটিকে একটি বড় যুদ্ধজাহাজ হিসেবে বর্ণনা করেন—দুই তলা, দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫০ মিটার (৪৯০ ফুট)।
‘অনেকেই টি-শার্ট, কালো প্যান্ট ও কালো সেনা বুট পড়ে ছিলেন’, ভিডিও কলে বলেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ। ‘সবাই একই রকম পোশাক পরেননি—কেউ কালো, কেউ বাদামী।’ সাজ্জাদ ভিডিও কলে নুরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সৈয়দ নুর বলেন, নৌকায় তাঁরা ১৪ ঘণ্টা ছিলেন। খাবার দেওয়া হয়েছিল চাল, ডাল, পনির।
কিছু পুরুষ শরণার্থী জানিয়েছেন, নৌকায় তাঁদের ওপর নির্যাতন ও অপমান করা হয়েছে।
‘আমাদের সঙ্গে খুব খারাপভাবে আচরণ করা হয়েছিল’, বলেন নুর। ‘কিছু মানুষকে মারধর করা হয়েছে, একাধিকবার থাপ্পড় মেরেছে।’
ভিডিও কলের সময় ফয়েজ উল্লাহ নামের আরেকজন তাঁর ডান কনুইয়ে ক্ষত দেখান। বলেন, তাঁকে বারবার পেটানো, থাপ্পড় মারা ও বাঁশের লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। তাঁরা জিজ্ঞাসা করছিলেন, তিনি অবৈধভাবে কেন ভারতে আছেন।
রোহিঙ্গারা প্রধানত মুসলিম। কিন্তু মে মাসে ভারত থেকে বিতাড়ন করা এই ৪০ জনের মধ্যে ১৫ জন খ্রিষ্টান ছিলেন।
‘দিল্লি থেকে যাওয়ার সময় শরণার্থীদের আটক করা ব্যক্তিরা বলতেন, “তুমি হিন্দু হওনি কেন? খ্রিষ্টান হওয়ার কারণ কী?”’, বলেন নুর। বলেন, ‘খৎনা হয়েছে কি না দেখার জন্য আমাদের বিবস্ত্র হতে বাধ্য করা হয়েছে।’
অন্য এক শরণার্থী ইমান হোসেন বলেন, সেনাসদস্যরা তাঁকে কাশ্মীরের পেহেলগাম হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। গত ২২ এপ্রিলের এ হামলার ঘটনায় প্রধানত হিন্দু পর্যটকসহ ২৬ জন নিহত হন।
ভারত সরকার বারবার পাকিস্তানি নাগরিকদের এ হামলার জন্য দায়ী করেছে; যা ইসলামাবাদ অস্বীকার করেছে। এ হত্যাকাণ্ডে রোহিঙ্গাদের সংশ্লিষ্ট থাকার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
পরের দিন ৮ মে, সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ শরণার্থীদের নৌযানের পাশে থাকা একটি সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে বলা হয়। নিচে চারটি ছোট নৌকা দেখতে পান, কালো রাবারের।
শরণার্থীদের দুটি নৌকায় স্থানান্তর করা হয়। প্রতিটিতে ২০ জন। বড় নৌযানে যাঁরা তাঁদের সঙ্গে ছিলেন, সেই কর্মীরাও সঙ্গে ওঠেন। বাকি দুটি নৌকা নেতৃত্ব দিচ্ছিল। সেখানে আরও এক ডজনের বেশি মানুষ ছিলেন। সাত ঘণ্টার বেশি হাতবাঁধা অবস্থায় ভ্রমণ করতে হয়।
‘একটি নৌকা সৈন্যদের নিয়ে তীরে পৌঁছে এবং একটি লম্বা দড়ি গাছের সঙ্গে বেঁধে দেয়। তারপর সেই দড়ির অপর মাথা আমাদের নৌকায় আনা হয়’, বলেন নুর।
এরপর জীবন রক্ষাকারী জ্যাকেট দেওয়া হয় এবং হাতের বাঁধন খুলে পানিতে ঝাঁপ দিতে বলা হয়। ‘আমরা দড়ি ধরে ১০০ মিটারের বেশি সাঁতার কেটে তীরে পৌঁছেছি’, বলেন নুর। তিনি আরও বলেন, এ সময় তাঁদের বলা হয়, তাঁরা ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছেছেন। তারপর তাঁদের এভাবে নিয়ে আসা ব্যক্তিরা চলে যান।
বিবিসি এ অভিযোগ ভারত সরকার ও নৌবাহিনীর কাছে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
৯ মে ভোরে, স্থানীয় জেলেরা শরণার্থী দলটিকে খুঁজে পান এবং জানান, তাঁরা মিয়ানমারে আছেন। জেলেরা শরণার্থীদের ফোন ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন; যেন তাঁরা ভারতে অবস্থানরত স্বজনদের ফোন করতে পারেন।
তিন মাস ধরে বিএইচএ মিয়ানমারের তানিনথারি অঞ্চলে খাবার ও আশ্রয় দিয়ে বিতাড়িত এই শরণার্থীদের সহায়তা করছে। কিন্তু ভারতে থাকা পরিবার তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় পাচ্ছে।
জাতিসংঘ বলেছে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যখন এই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আন্দামান সাগরে পাঠায়, তখনই তাঁদের জীবন চূড়ান্ত ঝুঁকিতে ফেলে।
১৭ মে নুরুল আমিন ও অন্যান্য পরিবারের সদস্যরা ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন দায়ের করেছেন। সেখানে তাঁদের বিতাড়ন করা স্বজনদের দিল্লিতে ফিরিয়ে আনা, অনুরূপ বিতাড়ন বন্ধ করা এবং ৪০ জনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছে।
‘এটি রোহিঙ্গা বিতাড়নের ভয়াবহতার কথা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে’, বলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কলিন গঞ্জালেস।
‘যুদ্ধক্ষেত্রে জীবনরক্ষাকারী জ্যাকেট পড়িয়ে কেউ মানুষকে সমুদ্রে ফেলে দিতে পারে, তা স্বাভাবিকভাবে বিশ্বাস করা কঠিন’, বলেন এই আইনজীবী।
তবে পিটিশনের জবাবে দুই-সদস্যের বেঞ্চের এক বিচারক এ অভিযোগকে ‘কাল্পনিক ধারণা’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, ‘প্রসিকিউশন তাদের দাবির পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ দেখায়নি।’
শরণার্থীদের নিয়ে এমন আচরণ ভারতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের আতঙ্কিত করে তুলেছে। গত বছরজুড়ে তাঁরা দাবি করে আসছিলেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের রোহিঙ্গা বিতাড়ন বেড়েছে। যদিও এ বিষয়ে কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই।
ভারতে থাকা রোহিঙ্গাদের কিছু এখন লুকিয়ে আছেন। যেমন নুরুলের মতো কেউ বাড়িতে আর ঘুমান না। তিনি স্ত্রী ও তিন সন্তানকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন।
‘আমার মনে শুধু এই ভয় যে ভারত সরকার আমাদেরও নিয়ে যাবে ও সমুদ্রে ফেলে দেবে। এখন আমরা বাড়ি থেকে বের হতে ভয় পাই’, বলেন নুরুল আমিন।
![]() |
| থাইল্যান্ডের নৌসীমার কাছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বহনকারী একটি নৌকার পাশে ভিড়েছে থাইল্যান্ডের নৌবাহিনীর একটি নৌযান। ফাইল ছবি: রয়টার্স |

No comments