আল জাজিরাকে গাজাবাসী: জীবন যাবে, গাজা ছাড়বো না

গাজা সিটিতে প্রায় দশ লাখ মানুষ বর্তমানে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের সামনে আরও একবার বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাদের মধ্যে ভয় ও প্রতিরোধের মিশ্র অনুভূতি। কারণ ইসরাইল ঘোষণা করেছে তারা এ অঞ্চলের বৃহত্তম শহরটি সামরিকভাবে দখল করবে। এ খবর দিয়ে অনলাইন আল জাজিরা বলছে, ইসরাইলের নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভা দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা অনুমোদন করার পর শুক্রবার শহরে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। এর অংশ হিসেবে বারবার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক দক্ষিণের তথাকথিত কেন্দ্রীভূত অঞ্চলগুলোতে সরিয়ে নেয়া হবে। পরিবারসহ যুদ্ধ শুরুর পর থেকে কমপক্ষে আটবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন আহমেদ হিজ। তিনি বলেন, আল্লাহর কসম, আমি কমপক্ষে ১০০ বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। তাই আমার কাছে এখানেই মারা যাওয়া ভালো। আমি কখনো এখান থেকে যাব না। আমরা দুঃখ-কষ্ট, অনাহার, নির্যাতন আর দুর্বিষহ পরিস্থিতি সহ্য করেছি। আর আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো এখানেই মারা যাওয়া।

আল জাজিরার সঙ্গে অন্য যারা কথা বলেছেন তাদেরও অনুভূতি একই রকম। তাদের একজন রাজব খাদের বলেন, কুকুর ও অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে রাস্তায় থাকবেন। তবু তিনি দক্ষিণ গাজায় যাবেন না। বলেন, আমরা অবশ্যই গাজা সিটিতে আমাদের পরিবার ও প্রিয়জনদের সঙ্গে থাকব। ইসরাইলিরা আমাদের দেহ ও আত্মা ছাড়া আর কিছুই পাবে না।

উত্তর-পূর্ব বেইত হানুন থেকে বাস্তুচ্যুত মাগজুজা সা’দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সমগ্র গাজা উপত্যকায় কোথাও নিরাপদ নয়, অথচ আবারও স্থানান্তরের জন্য বাধ্য করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, দক্ষিণ দিকটা নিরাপদ নয়। গাজা সিটি নিরাপদ নয়, উত্তরও নিরাপদ নয়। আমরা কোথায় যাব? আমরা কি নিজেদের সমুদ্রে ফেলে দেব?

ওদিকে গাজা সিটি থেকে আল জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ জানিয়েছেন, শুক্রবার ভোর থেকে ইসরাইলের পরিকল্পিত জাতিগত নিধনের আশঙ্কায় বাসিন্দারা ‘আতঙ্কের মধ্যে’ আছেন। তিনি বলেন, কেউ কেউ তাদের অবশিষ্ট সামান্য জিনিসপত্র গুছাতে শুরু করেছেন- কোথায় যাবেন তা জানেন বলে নয়, বরং শেষ মুহূর্তে আটকা পড়া এড়াতে। তারা প্রস্তুত থাকতে চান, যখন ইসরাইলি সেনারা জোর করে বের করে দেবে তার জন্য।

তিনি আরও বলেন, ভয়, উদ্বেগ, হতাশা- সবই বাড়ছে। ইসরাইলি সেনারা যে এলাকা ‘উচ্ছেদ অঞ্চল’ বলে ঘোষণা করে, সেখানেই মানুষ নিহত হয়। প্যালেস্টিনিয়ান এনজিও নেটওয়ার্কের পরিচালক আমজাদ শাওয়া বলেন, বাসিন্দারা বারবার জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হতে হতে ক্লান্ত। এবার স্থানত্যাগ আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ হাসপাতাল, পানি সরবরাহ ও অন্যান্য অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি বলেন, এখন মানুষের জন্য কিছুই দেয়ার নেই, আর এটা ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের এমন প্রবীণদের সরাতে হবে যারা হাঁটতে পারেন না, রোগী ও আহতরা আছেন যারা নড়তে পারেন না। আমরা তাদের ফেলে যেতে পারি না, আর সেবা দেয়াও সম্ভব নয়।

ইসরাইলের বিতর্কিত এ পরিকল্পনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সেনারা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা সূত্র জানায়, ভোর থেকে কমপক্ষে ৩৬ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে কমপক্ষে ২১ জন ত্রাণ সন্ধানকারী। দিনের অন্যান্য হামলার মধ্যে একটি ইসরাইলি ড্রোন দক্ষিণ গাজার বানি সুহেইলার পৌরসভায় (খান ইউনুসের পূর্বে) আঘাত হানে, যাতে দুই ফিলিস্তিনি নিহত হন বলে নাসের হাসপাতালের এক সূত্র আল জাজিরাকে জানায়। উত্তর গাজায় ত্রাণসন্ধানকারী একজনকে ইসরাইলি সেনারা গুলি করে হত্যা করেছে। দু’জন নিহত হয়েছেন একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল সমর্থিত বিতর্কিত জিএইচএফ পরিচালনা করে।

জর্ডানের রাজধানী আম্মান থেকে আল জাজিরার হুদা আবদেল হামিদ জানিয়েছেন, এই কুখ্যাত সংস্থা বর্তমানে চারটি কেন্দ্র চালাচ্ছে। সেখানে খাদ্যের জন্য লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় ১৩০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন মূলত ইসরাইলি বাহিনীর হাতে। আবদেল-হামিদ জানান, ইসরাইল এখনো গাজা সিটি দখলের নির্দিষ্ট সময়সীমা দেয়নি। তবে স্থল অভিযানের প্রস্তুতি চলছে, ইসরাইলের দক্ষিণ সীমান্তে সেনা চলাচল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জোরপূর্বক ৯ লাখ মানুষের উচ্ছেদে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদে সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইসরাইলের পরিকল্পনা যার অধীনে হামাস বা প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটি নয়, বরং বিকল্প প্রশাসনের মাধ্যমে গাজার নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ করা হবে, তা বাস্তবায়নে কয়েক বছর লাগতে পারে।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের তীব্র নিন্দার মাঝেও ইসরাইলের প্রধান সামরিক মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান স্পষ্ট নয়। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এ পরিকল্পনা সম্পর্কে আগাম অবগত হওয়া বা না হওয়া নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান নেননি এবং বলেন, হামাস নিরীহ মানুষের ওপর হামলা করতে পারে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওয়াশিংটনের বিলিয়ন ডলারের সহায়তা ছাড়া গাজা সিটির পূর্ণ সামরিক নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অনেকেরই মনে আছে, প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা- গাজাকে মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরা বানানোর পরিকল্পনা। শুক্রবার হামাস এ পরিকল্পনাকে যুদ্ধাপরাধ আখ্যা দিয়ে বলেছে, এ সিদ্ধান্তই ব্যাখ্যা করছে কেন ইসরাইল হঠাৎ করে শেষ দফা যুদ্ধবিরতি আলোচনায় অংশ নেয়া থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। টেলিগ্রামে দেয়া এক পৃথক বিবৃতিতে তারা জানায়, ফিলিস্তিনিরা যে কোনো দখলদার বা আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করবে। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরাইলের জন্য ঢাল সরবরাহের অভিযোগ তোলে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িত বলে অভিযুক্ত করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ সপ্তাহান্তে ইসরাইলের এ উত্তেজনা বৃদ্ধির বিষয়ে জরুরি বৈঠক করবে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.