গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনায় দেশে–বিদেশে কাউকে পাশে না পেয়েও কেন অনড় নেতানিয়াহু
প্রস্তাবটি নিয়ে ইসরায়েলের সামরিক নেতৃত্ব ব্যাপক আপত্তি জানিয়েছিল। এ নিয়ে সতর্কও করা হয়েছিল। এরপরও পরিকল্পনাটি অনুমোদন করা হয়েছে। সামরিক নেতৃত্ব বলেছিল, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে গাজায় মানবিক সংকট আরও বাড়বে এবং সেখানে থাকা ৫০ জিম্মির জীবন বিপন্ন হবে।
সামরিক অভিযান বিস্তৃত করার পরিকল্পনাটি এমন সময়ে করা হয়েছে, যখন কিনা বিশ্বে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন কমে গেছে। এমনকি গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ইসরায়েলি জনগণের সমর্থনও কমে গেছে।
তবু নেতানিয়াহু তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে হাঁটছেন। কারণ, এর মধ্য দিয়ে তাঁর অন্ততপক্ষে একটি হলেও রাজনৈতিক ফায়দা হবে। সেটি হলো, এর মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করার সময় পাবেন। তাঁর কট্টর ডানপন্থী জোটের সঙ্গীরাও চান যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হোক।
নেতানিয়াহুর মিত্র আরও দুই উগ্রবাদী ইহুদি নেতা ইতামার বেন গভির এবং বেজালেল স্মোট্রিচ একাধিকবার হুমকি দিয়েছেন যে যুদ্ধ বন্ধ হলে তাঁরা জোট সরকার ভেঙে দেবেন। আর এই হুমকির মধ্য দিয়ে তাঁরা বারবারই যুদ্ধবিরতি আলোচনার অগ্রগতি আটকে দিয়েছেন।
বেন গভির এবং স্মোট্রিচ যা চান, সে তুলনায় নেতানিয়াহুর গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনাটি কমই বলা চলে। কারণ, বেন গভির ও স্মোট্রিচ চান প্রথম ধাপে পুরো গাজা উপত্যকা দখল করে সেখানে নতুন করে ইহুদি বসতি স্থাপন শুরু করতে। আর শেষ পর্যন্ত তাঁরা পুরো ভূখণ্ডটিকে ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত করে নিতে চান। বৈঠকের আগে নেতানিয়াহু নিজেও যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সে তুলনায়ও তাঁর নতুন পরিকল্পনার পরিসর ছোট।
গত বৃহস্পতিবার ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ইসরায়েল পুরো গাজার নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। তিনি এমনভাবে বলছিলেন, যেন অঞ্চলটি পুরোপুরি দখলের সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে নিয়ে ফেলেছেন।
তবে ইসরায়েলের নেতা এখন ধাপে ধাপে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছেন। প্রথম ধাপের লক্ষ্য হলো, শুধু গাজা সিটির দখল নেওয়া। কাছাকাছি থাকা অন্যান্য শিবিরের দখল এখনই নেওয়া হবে না।
ধারণা করা হয়, ওই শিবিরগুলোতে ২০ ইসরায়েলিকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে। নেতানিয়াহু খুব সচেতনভাবে অভিযান শুরুর জন্য দুই মাসের ঢিলেঢালা একটি সময়সীমা দিয়েছেন। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে কূটনৈতিক চেষ্টার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির চুক্তির সুযোগ রাখা হয়েছে। পুরো পরিকল্পনা বাতিল করারও সুযোগ আছে।
তবে নেতানিয়াহুর উগ্র ডানপন্থী জোটের সহযোগীরা এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষুব্ধ। তারা বলছে, এই পরিকল্পনা যথেষ্ট নয়। তারা মনে করে, যুদ্ধের মাত্রা বাড়ানোটাই যথেষ্ট।
স্মোট্রিচের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, ‘নেতানিয়াহুর যে প্রস্তাবটি মন্ত্রিসভার অনুমোন পেয়েছে, সেটির কথা শুনলে ভালো লাগতে পারে। কিন্তু আসলে এটি আগের অবস্থারই পুনরাবৃত্তি। এই সিদ্ধান্ত না নৈতিক, না আদর্শিক, না জায়নবাদী।’
নেতানিয়াহুর সর্বশেষ পরিকল্পনাটি তাঁর জোটসঙ্গী বা ইসরায়েলের সামরিক নেতৃত্ব কারোরই পছন্দ হয়নি। দীর্ঘ ১০ ঘণ্টা ধরে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার বৈঠকটি হয়েছিল। ইসরায়েলের সামরিক প্রধান ইয়াল জামির সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সরকারের পরিকল্পনার কঠোর বিরোধিতা করেন।
ইসরায়েলের শীর্ষ এই জেনারেল সতর্ক করেন, নতুন কোনো সামরিক অভিযান চালানো হলো, তা গাজায় থেকে যাওয়া ইসরায়েলি জিম্মিদের জন্য বিপজ্জনক হবে। এই পরিকল্পনা ইসরায়েলি সেনাদেরও ঝুঁকিতে ফেলবে বলে সতর্ক করেন তিনি।
ইয়াল জামির আরও বলেন, গাজা এমন একটি ফাঁদে পরিণত হবে, যা প্রায় দুই বছর অবিরাম লড়াইয়ে ক্লান্ত ইসরায়েলি বাহিনীর শক্তি আরও কমিয়ে দেবে এবং ফিলিস্তিনের মানবিক সংকটকে আরও গভীর করে তুলবে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী যে উদ্বেগগুলো প্রকাশ করেছে, সেগুলো ইসরায়েলের সাধারণ মানুষেরও কথা। অনেক জরিপে দেখা গেছে, ইসরায়েলের বেশির ভাগ মানুষ চায়, যুদ্ধ বন্ধ হোক এবং জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা হোক। তবে নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্তটি সেনা বা সাধারণ মানুষের মতের সঙ্গে মিলছে না। বিশ্লেষকেরা বলছেন, নিজের রাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রাখাটাই এখন নেতানিয়াহুর মূল চিন্তা।
গাজা দখলের পরিকল্পনা নেতানিয়াহু এবং ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক মহলে এক অবিশ্বাস্য একাকিত্বের মধ্যে নিয়ে গেছে। গাজার যুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও উপত্যকাটিতে ক্রমবর্ধমান খাদ্যসংকট ও অনাহার বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের যুদ্ধের গ্রহণযোগ্যতাকে কমিয়ে দিয়েছে।
পরিকল্পনাটি ঘোষণার পর জার্মানি বলেছে, তারা ইসরায়েলের জন্য কিছু সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি স্থগিত করছে। এর মধ্য দিয়ে অন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর জন্যও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আরও কমিয়ে আনার পথ তৈরি হয়েছে। জার্মানি হলো যুক্তরাষ্ট্রের পর ইসরায়েলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র।
নেতানিয়াহু এমন একটি পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিচ্ছেন, যা কারোরই মন জোগাতে পারছে না। একদিকে যেমন বিদেশে ইসরায়েলের মিত্র, দেশের সামরিক নেতৃত্ব, যুদ্ধ থামাতে চাওয়া সাধারণ মানুষ—কারোরই সমর্থন পাচ্ছে না এটি। অপর দিকে নেতানিয়াহুর জোটের কট্টরপন্থী নেতারাও এই পরিকল্পনা নিয়ে অখুশি। তাঁরা মনে করছেন, পরিকল্পনাটি যথেষ্ট নয়।
এই পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে আসলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন নেতানিয়াহু নিজেই। তাঁকে আরও কিছু সময় দিচ্ছে সেই অবশ্যম্ভাবী সিদ্ধান্ত এড়িয়ে যেতে, যেখানে তাঁকে হয় একটি সত্যিকারের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে হবে (যা বন্দীদের প্রাণ বাঁচাতে পারে), নয়তো পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযানে নামতে হবে (যা তাঁর জোটসঙ্গীদের সন্তুষ্ট করবে)।
এটিকে কৌশলগত পদক্ষেপ বললে কম বলা হয়ে যায়। এটি আরও বেশি কিছু। বলা চলে যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে এটি নেতানিয়াহুর একটি পুরোনো পদ্ধতি। আর তা হলো—নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গাজাবাসী ও ইসরায়েলি বন্দীদের দুর্ভোগে ফেলা এবং তাদের ক্ষতি করা।
![]() |
| ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। রয়টার্স, ফাইল ছবি |

No comments