নিয়ন্ত্রণহীন সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান: অবৈধ দোকান ও মাদকের ছড়াছড়ি by মো. বোরহান উদ্দিন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই ঐতিহাসিক সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান। স্বাধীনতা সংগ্রামসহ জাতীয় জীবনের নানা ইতিহাস- ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে সুপরিসর এ নগর উদ্যানকে ঘিরে। শরীরচর্চা ও অবসর সময় কাটানোর সুন্দরতম স্থান। ঐতিহাসিক উদ্যানটিতে এখন গড়ে উঠেছে শতশত অবৈধ দোকান আর মাদকের রমরমা ব্যবসা। বিকাল গড়িয়ে রাত হতেই জমজমাট হয়ে ওঠে মাদকসেবীদের মিলনমেলা। পুরো উদ্যান যেন একদিকে বাজার, অন্যদিকে গাঁজার হাট। আর মাদকের মূল কেন্দ্র মুক্তমঞ্চ। আবার টিএসসি সংলগ্ন এলাকায় অবৈধ শত শত খাবারের দোকান গড়ে ওঠায় ক্যাম্পাসে বেড়েছে বহিরাগতদের আড্ডা। একটা সময় উদ্যানের টিএসসি সংলগ্ন গেইটে ২০-৩০টি দোকান ছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে উদ্যান এলাকায় দোকান বেড়েছে কয়েকগুণ। সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ ২৬২টি দোকানের তালিকা করেছেন।

একটা সময় ছাত্রলীগের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকা এ এলাকা এখন নিয়ন্ত্রণ করে নতুন চাঁদাবাজ চক্র। চাঁদার বিনিময়ে অবৈধ এসব দোকান বসানো থেকে শুরু করে নিরাপত্তা দেয়ার কাজ করে নতুন চক্রটি। চক্রের সদস্যরা উদ্যানেই দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছেন। বহিরাগত কেউ দোকান বসানোর সাহস করে না। তারা নতুন দোকানের জন্য জায়গা দখল করে রাখেন। চাঁদার বিনিময়ে নির্ভয়ে দোকান খোলার আশ্বাস দেন। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিরাপত্তার দায়িত্ব নেন এবং প্রশাসনিক অভিযানের সময় ওপরমহলের মাধ্যমে পার পাওয়ার ব্যবস্থা করেন। চক্রটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে অদৃশ্য ওপরমহল। চক্রের দু’জন হলেন- বাবু ও হৃদয়। যারা দীর্ঘদিন ধরেই ভাসমান হিসেবে উদ্যানের ক্যান্টিনে বসবাস করছেন। বাবুর নিজের তিনটি দোকান রয়েছে, অন্যদিকে হৃদয়ের ৫টি। আগে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের নিয়ন্ত্রণে ছিল এসব।

একইসঙ্গে উদ্যান এলাকায় মাদক ব্যবসা করছে ৫০ থেকে ৬০ জনের একটি চক্র। এদের মধ্যে অন্যতম পারুলী, রেখা, ফিরোজ, নাসু। চক্রটির অনেকে দিনে ফুল বিক্রি করলেও আড়ালে বিক্রি করেন গাঁজা। ফুল বিক্রিকে একটি সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করেন। দোকান থেকে চাঁদা আদায়কারী বাবু এবং হৃদয়ও জড়িত আছেন মাদক ব্যবসায়। উদ্যানের নির্মাণাধীন ৭টি ‘ফুড কিওস্ক’- ক্যান্টিনে তাদের বসবাস, এখান থেকেই পরিচালিত হয় তাদের ব্যবসা। গাঁজা থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি সকল ধরনের মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়। চক্রের সদস্য বাবু বলেন, মাদক ব্যবসার মূল শক্তি হলো প্রশাসন। প্রশাসনই তো আমাদেরকে শেল্টার দেয়। গাঁজা যত কেজি ইচ্ছা নিতে পারবেন। মদ নিতে হলে টাকা দিয়ে অর্ডার দিবেন সময়মতো পেয়ে যাবেন।

৫ই আগস্টের পর থেকে প্রকাশ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে মাদক সেবন ও ব্যবসা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই পুরো উদ্যান জুড়েই চলতে থাকে মাদক সেবন যা রাত ১-২টা পর্যন্ত চলে। সন্ধ্যার পর থেকে মুক্তমঞ্চ, ছবির হাট লেক পাড়, টিএসসি সংলগ্ন গেট, কালীমন্দির গেট, মন্দিরের পাশের গেট, ভিআইপি গেট এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের পিছনে এলাকগুলোতে প্রকাশ্যে মাদকদ্রব্য বিক্রি হতে দেখা যায়। চক্রাকারে ঘুরতে থাকেন ক্রেতারা। গাঁজা ‘পট’ হিসেবে বিক্রি হয়, প্রতি পটের দাম একশ’ টাকা। ১০ গ্রাম থেকে কয়েক কেজি পর্যন্ত নেয়া যায়। মাদকসেবীদের মধ্যে ছাত্র, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার লোকজন রয়েছেন। কয়েকশ’ মাদক সেবনকারীর জটলায় মুক্তমঞ্চ যেন রূপ নেয় গাঁজার আসরে।

জানা গেছে, উদ্যানে ঘুরতে আসা মানুষের ক্লান্তির অবসান, নাস্তা ও টয়লেট সুবিধার লক্ষ্যে নির্মাণ করা হয় ‘ফুড কিওস্ক’ ক্যান্টিন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রজেক্টির কাজ করছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। প্রজেক্টের কাজ আগামী বছরের জুন মাসে শেষ হলে ফুড কিওস্কগুলো লিজ দেয়া হবে। নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের দিকে হলেও পরিত্যক্ত হয়ে আছে ক্যান্টিগুলো, ফলে উদ্যানের ছিন্নমূল লোকেরা ক্যান্টিনগুলোতে বসবাস করছে। অন্যদিকে মুক্তমঞ্চটি তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের উন্মুক্ত কার্যক্রমের জন্য। তবে কোন কর্তৃপক্ষ তা রক্ষণাবেক্ষণ করবেন তাও স্পষ্ট নয়। যদিও উন্নয়নকাজ করেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। কিন্তু কখনো সরকারি এ দপ্তরের লোকজনকে তদারকি বা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতে দেখা যায় না।

উদ্যানের কেয়ারটেকার খোকন বলেন, আমরা যতবার উচ্ছেদ করি ততবার তারা দখল করে ফেলে। এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল। কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি যতক্ষণ পর্যন্ত ফুড কিওস্কগুলোকে লিজ দেয়া না হবে, এগুলো সুরক্ষিত থাকবে না। আমরা টাইল্স লাগিয়ে এলে পরেরদিনই আগুন ধরায় রান্না করার জন্য। অভিযান চালালে উদ্যানের পরিচিত মুখ ও ক্যাম্পাসের অনেকে বাধা দেয়।

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার মুহাম্মদ আতিক বলেন, সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানে প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য হুমকি। গাঁজার গন্ধের জন্য উদ্যানে যাওয়া যায় না। ঢাকা শহরের মতো ব্যস্ততম জায়গায় উদ্যান খোলামেলা জায়গা হওয়ায় শিক্ষার্থীরা সময় কাটাতে যায়। ফলে অনেক শিক্ষার্থী কৌতূহলবশত বা বাধ্য হয়ে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। অনেক শিক্ষার্থী ছিনতাই ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. সাইফুদ্দীন আহমদ মানবজমিনকে বলেন, উদ্যানের বিষয়টি আমাদের স্মরণে আছে আমরা এটি নিয়ে মিটিং করছি। আমরা পুলিশ কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি দু’টি বিষয়ে। প্রথমত, তারা যেন উদ্যানের গেটটি বন্ধ করে দেন এবং উদ্যানের ভিতরে চলা অসামাজিক এবং বেআইনি কাজকর্ম বন্ধ করার জন্য যেন অভিযান চালায়। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই ফোর্স পাঠিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হবে। এছাড়াও আমরা শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে ভলান্টিয়ার নেবো যারা উদ্যানের গেটে থাকবে।
সম্প্রতি সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানে মাদক উদ্ধার অভিযান শুরু করেছে প্রশাসন। কয়েকজনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। শাহবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ খালিদ মনসুর মানবজমিনকে বলেন, আমরা প্রতিনিয়তই মাদক উদ্ধার করে মামলা দিচ্ছি। শাহবাগে লাগাতার আন্দোলন ও রাজনৈতিক মামলাগুলোর ফলে উদ্যানের দিকে মনোযোগ দিতে পারিনি। আমরা অতিদ্রুত বড় আকারে অভিযান পরিচালনা করবো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মিটিংয়ের জন্য কল করেছে, শিগগিরই আমরা মিটিংয়ে বসবো। কমিশনার স্যার একটা টিম গঠন করে দেবেন, এরপরেই আমরা বিশেষ অভিযান পরিচালনা করবো।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.