সিলেটের হাজারো ক্রাশার মিল নিয়ে বেলা’র যে আপত্তি by ওয়েছ খছরু

আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ ১০ বছর সিলেটে পাথর উত্তোলন বন্ধ ছিল। পাথর উত্তোলনে কেউ কোনো নিয়মই মানছিলেন না। এ কারণে ১৬ বছরে পাথর তুলতে গিয়ে মাটিচাপায় মারা গিয়েছিল ১০৬ জন শ্রমিক। কোম্পানীগঞ্জের শারপিন টিলা পুরোটাই ধ্বংস করা হয়। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল সেটিও গত দুই মাসে ধ্বংস করা হয়েছে। প্রশাসনের তথ্য মতে, ৫ই আগস্টের পর জাফলং ও সাদাপাথর থেকে অন্তত দুশ’ কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে।এই লুটের ঘটনার পর টনক নড়েছে প্রশাসনের। ইতিমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জাফলংয়ে ১০৬ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। দু’টি মামলার ঘটনায় জাফলংয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি’র (বেলা) সিলেটের নেতারা বসে নেই। তাদের মতে, পাথর লুট বন্ধ করা গেলেও ক্রাশার মিল বন্ধ করা যায়নি। কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ, সালুটিক, সিলেট সদরের ধোপাগুল, জাফলংয়ের সোনাটিলা, বাংলাবাজার, কানাইঘাটের নদী তীরবর্তী এলাকায় রয়েছে কয়েক হাজার ক্রাশার মিল। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এসব ক্রাশার মিলে দেশীয়ভাবে উত্তোলিত পাথরই শুধু ভাঙা হয়নি, ভারত থেকে আমদানি করা পাথরও ভাঙা হয়। ফলে ক্রাশার মিল উচ্ছেদ হলে সিলেটের পাথর বাণিজ্যে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটবে। পাথরকেন্দ্রিক ব্যবসা বন্ধ হলে সিলেটের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। গতকাল সিলেটের জেলা প্রশাসকের কাছে দেয়া স্মারকলিপিতে বেলার বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আক্তার জানিয়েছেন, পাথর উত্তোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পাথর ভাঙার মেশিন পরিচালনার ব্যবসা। কোনো নিয়মনীতি না মেনে চলছে পাথর ভাঙার মেশিন। এতে জনস্বাস্থ্য ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিরাট নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সিলেটের সদর, দক্ষিণ সুরমা, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় বিপুলসংখ্যক স্টোন ক্রাশার মেশিন আছে। এসব স্থানে সহস্রাধিক মেশিন চলছে। নদীর তীর, সড়ক সংলগ্ন, কৃষি জমিতে এমনকি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সীমানা প্রাচীরসহ সংলগ্নস্থানে চলছে অবৈধ এসব পাথর ভাঙার কল। এক্ষেত্রে স্টোন ক্রাশার মেশিন স্থাপন নীতিমালা-২০০৬ এবং অবৈধভাবে স্থাপিত ও পরিচালিত স্টোন ক্রাশার মেশিনের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের রায় অমান্য করে চলছে এসব মেশিন। ওই স্মারকলিপিতে তিনি জানান- ২০০৫ সাল থেকে যান্ত্রিকভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে সিলেটের পিয়াইন, ডাউকী, ধলাই, রাংপানি নদী ও লোভাছড়া সৌন্দর্য্য হারিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটন শিল্প। বিধ্বংসী পাথর উত্তোলনের ফলে নদীগুলোর বিভিন্ন স্থানে পানি ঘোলা হয়ে যায়। পিয়াইন ও ডাউকী নদীর বুকে বালুর স্তূপ ও ট্রাকের মিছিল নিয়মিত হয়ে পড়ে। অনিয়মতান্ত্রিক পাথর উত্তোলনের ফলে ভূমিধস, নদীতীরে ভাঙন, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া, কৃষিজমি বিলুপ্ত হওয়াসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। স্মারকলিপিতে জানানো হয়, উচ্চ  আদালতের রায় ও সরকারের  সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো ২০২০ সালের ৮ই জুন এক পত্রের মাধ্যমে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত ৮টি পাথর কোয়ারির ইজারা স্থগিত করে। পাশাপাশি পাথর উত্তোলন বন্ধ করে। ফলে সিলেটের পিয়াইন ও ডাউকী নদীসহ পাথর মহাল হিসেবে পূর্বে ঘোষিত নদী, ছড়া ও প্রকৃতিতে প্রাণ ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু গত ৫ই আগস্ট থেকে পাথর উত্তোলনকারীরা নিষেধাজ্ঞার ন্যূনতম তোয়াক্কা না করে পাথর উত্তোলন শুরু করেন যা এখন পর্যন্ত চলমান। এডভোকেট শাহ সাহেদা জানান, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় এমনকি অযান্ত্রিক পদ্ধতিতেও খনিজসম্পদ আহরণ আইনত অনুমোদিত নয়। সাম্প্রতিক সময়ে জাফলং-এ পর্যটন ফিরে আসার প্রেক্ষিতে সরকার নিশ্চিতভাবেই পিয়াইন ও ডাউকী নদীসহ  রাংপানি নদী, ধলাই নদী, বিছানাকান্দি, উৎমাছড়া, লোভাছড়া, শ্রীপুর ও ভোলাগঞ্জে পর্যটন শিল্পের বিকাশে একটি রূপরেখা ও মাস্টারপ্লান প্রণয়ন করতে পারেন। উল্লেখিত জায়গাগুলো থেকে পাথর কোয়ারিসমূহকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে প্রাকৃতিক সম্পদ এবং সৌন্দর্য যেমন রক্ষা করতে পারেন তেমনি পরিবেশ বিধ্বংসী পাথর উত্তোলন থেকে এলাকাগুলোকে রক্ষা করতে পারেন।

কোয়ারি সচলে জাফলংয়ে মানববন্ধন: জাফলংয়ে পরিবেশসম্মত ও সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের অনুমতিতে মানববন্ধনে পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়ের করা দুইটি মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করেছেন ৩৬টি সংগঠনের নেতারা। বুধবার জাফলংয়ের মামার বাজার পয়েন্টে এ মানববন্ধন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধন চলাকালে সমাবেশে পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়ের করা দুইটি মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান তারা। মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা শাহ আলম স্বপন, পদবঞ্চিত বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম শাহপরাণ, পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, গোয়াইনঘাট উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল ইসলাম, পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি আমজাদ বক্স, সাধারণ সম্পাদক মাসুদুল আলম রানা, জাফলং ট্রাকচালক সমিতির সভাপতি সমেদ মিয়া, জাফলং বল্লাঘাট পাথর শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি সিরাজ মিয়াসহ জাফলংয়ের ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.