ক্ষুদ্র ঋণের প্রেক্ষাপট ও প্রতিহিংসার সুদ বিতর্ক by প্রভাস চন্দ্র দাস

গ্রামীণ ব্যাংক শুধুমাত্র ২০% হারে একক ঋণ বিতরণ কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই (এখানে বলে রাখা ভালো-২০% হিসাবে গড় পদ্ধতিতে ১০ হাজার টাকায় ১ হাজার টাকা সুদ চার্জ হয়), প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য ঋণের সুদ সংক্রান্ত আলোচনাও এর সঙ্গে প্রধান বিবেচ্য বিষয়, যেমন- সদস্যের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতকরণে কোচিং ও শিক্ষাঋণ বাবদ প্রদেয় ঋণের শিক্ষাকালীন সময়ের জন্য (৪/৫ বছর) কোনো সুদ ধার্য করা হয় না, শিক্ষা শেষে ৪/৫ বছরের মধ্যে পরিশোধকালীন সময়ের জন্য মাত্র ৫% হারে সুদ ধার্য করা হয়। সদস্যদের আবাসন সুবিধা নিশ্চিতকরণে প্রদেয় ঋণের সুদহার ৮% এবং ভিক্ষুকদের আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য দেশব্যাপী সুদমুক্ত ঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে ‘সংগ্রামী সদস্য কর্মসূচি’- নামে কার্যক্রম চলমান রয়েছে ...

মহাজনী ঋণের কঠোর ও নির্মম নির্যাতনের শিকার প্রান্তিক দরিদ্র মানুষকে বাঁচানোর অনুভূতি থেকেই ক্ষুদ্র ঋণের এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় বলে ব্যাপক জনশ্রুতি রয়েছে। জামানত সাপেক্ষে ঋণ প্রদানের সনাতনী ব্যাংকিং ব্যবস্থার এক বিপরীত ধারণার মধ্যদিয়েই ১৯৭৬ এ একটি প্রয়োগিক প্রকল্প এবং ১৯৮৩ সালে প্রকল্প থেকে এক স্বাধীন সত্তা নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের আবির্ভাব ঘটে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে অর্থনীতির মারপ্যাঁচে দরিদ্র মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছেন না এমন বাস্তবতার তথ্য খুঁজতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী জোবরা গ্রামকেই গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিলেন। বাঁশ দিয়ে মোড়া তৈরির কারিগর সুফিয়া খাতুন মহাজনের কাছ থেকে ৫ টাকা ঋণ নিয়ে দিনভর শ্রমে তৈরি মোড়া মহাজনের বেঁধে দেয়া মূল্যেই তার নিকট বিক্রি করতে বাধ্য হতেন। বিষয়টির গভীরে গিয়ে দেখতে পেলেন, ওই গ্রামের ৪২ জন এমন দরিদ্র মানুষ মহাজনের কাছ থেকে ৮৫৬ টাকা ঋণ নিয়ে একইভাবে কাজ করতেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ওই টাকা পরিশোধ করে তাদেরকে মহাজনের হাত থেকে মুক্ত করে নিজের গবেষণালব্ধ তত্ত্বের ব্যবহারিক বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেন। এরপরের ধারাবাহিক ঘটনাক্রম দেশ-বিদেশের অনেকেরই অজানা নয়। প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন শেষে ১৯৮৩ এর পরে গ্রামীণ ব্যাংকের দ্রুত সফল সম্প্রসারণে পৃথিবীর দৃষ্টি বাংলাদেশের দিকে নিবদ্ধ হয়। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গেই সামাজিক ব্যবসার এক ইতিবাচক ধারণার কথা ড. ইউনূস এর মুখে প্রায়শই উচ্চারিত হয়ে আসছে। অপার সম্ভাবনার এদেশের সম্পদ ব্যবহার করে গরিবের মালিকানায় দেশের অবকাঠামো ও শিল্প-কলকারখানা প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে বৃহৎ এ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব।

রাষ্ট্রীয় কর্মপরিকল্পনায় যুক্ত হয়েছে ক্ষুদ্র ঋণ
ক্ষুদ্র ঋণ এখন আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে মুখ লুকিয়ে থাকার মতো খাটো কোনো ভূমিকায় নেই। লাখ লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগের বিশাল এ বাজার এখন মোটাদাগে প্রান্তিক অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণের জয়-জয়কার প্রচারে বহির্বিশ্বের গভীর আগ্রহ এবং ভূয়সী প্রশংসার দৃশ্যমান পুরস্কার অর্জনে  প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষগুলোর মনস্তত্ত্বে একটা বড় ঝাঁকুনি লেগেছিল, যার ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক মঞ্চে সস্তা সমর্থন আদায়ে গ্রামীণ ব্যাংক ও এর প্রতিষ্ঠাতাকে নিয়ে চলছিল অহরহ অপপ্রচার। অথচ ২/৩ দশকে ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব দারিদ্র্যবিমোচন ও জাতীয় অর্থনীতিতে বেশ গুরুত্ববহ ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিল বলেই রাষ্ট্রীয় কর্মপরিকল্পনায় ক্ষুদ্রঋণকে যুক্ত করতে হয়েছে।

অনেকটা রাজনৈতিক স্বীকৃতি লাভ করেছিল
এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুভূতিকে পুঁজি করে বিগত সরকার প্রধান কর্তৃক ‘সুদখোর’ হিসেবে ট্যাগ লাগিয়ে নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে খাটো করার প্রবণতা বিশেষ এক গোষ্ঠীর কাছে আনন্দের খোরাক জোগালেও দেশজুড়ে এমন মন্তব্যের সমালোচনায় মানুষ সরব ছিল। বাস্তবে দেশের সকল ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সর্বনিম্ন হারে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণসেবা পরিচালিত হলেও সুদখোরের তকমা লাগানোর প্রবণতা শুধু রাজনৈতিক সুবিধাবাজদের দখলেই ছিল না এটি অনেকটাই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করেছিল। জাতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক বিষয়সংশ্লিষ্ট অনেক সভা-সেমিনারে গ্রামীণ ব্যাংকের সুদ এবং সুদখোর বিষয়ক আলোচনা যেন আলোচ্যসূচিতেই ঠাঁই করে নিয়েছিল। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে খুশি করতে পারলেই নিজের পদ-পদবি উন্নয়নের হীন মানসিকতা চরিতার্থ করার লালসায় জ্ঞানপাপী অনেক বড় বড় আমলাদেরও জিহ্বা আড়ষ্ঠ হতে দেখিনি অমন কুৎসিত শব্দে বিশ্বনন্দিত এ মানুষটিকে কটাক্ষ করতে। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদ সংক্রান্ত এ বিতর্কিত ইস্যুটি রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন মতাবলম্বীদের মুখে এখনো বেশ সাড়ম্বরে উচ্চারিত হয়, যা নতুন প্রজন্ম সঠিক হিসেবেই মনে করে আসছে। গ্রামীণ ব্যাংক একটি রাষ্ট্রীয় বিধিবদ্ধ ব্যাংক হলেও অনেক শিক্ষিত মানুষ এবং আমলাগণ আলোচনার টেবিলে এনজিও আখ্যায়িত করে বেশ তৃপ্তবোধ করতেন, এটি জেনে বললে অন্যায় এবং না জেনে বললে ওই পদ-পদবির অযোগ্য বলেই আমার সাধারণ ধারণা। এ সংক্রান্ত সঠিক বিষয়টি সকলের কাছে খোলাসা করার জন্যই মূলত এ লেখার আগ্রহ।

সুদ বিতর্কের অবসান হোক
বিনিয়োগকৃত প্রাপ্ত পুঁজির খরচের সঙ্গে ১০% সুদ যোগ করলে নির্ধারিত সুদকে সবুজ, ১৫% যোগ করলে হলুদ এবং এর উপরে উঠলে তাকে লাল সুদ বলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংক যে ঋণ প্রদান করে আসছে তার সুদ সবুজ, সর্বনিম্ন এবং যৌক্তিক পর্যায়, উপরন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের লাভ-লোকসানের মালিক ঋণগ্রহীতা সদস্যগণ নিজেরাই। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের একজন বেতনভুক কর্মকর্তা মাত্র। অথচ তাকে একদিকে প্রতিষ্ঠানের এমডি অপরদিকে সুদখোর বলে অনেক বড় কর্তাই নিজেদের জ্ঞান-গরিমাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
গ্রামীণ ব্যাংক শুধুমাত্র ২০% হারে একক ঋণ বিতরণ কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই (এখানে বলে রাখা ভালো-২০% হিসাবে গড় পদ্ধতিতে ১০ হাজার টাকায় ১ হাজার টাকা সুদ চার্জ হয়), প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য ঋণের সুদ সংক্রান্ত আলোচনাও এর সঙ্গে প্রধান বিবেচ্য বিষয়, যেমন- সদস্যের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতকরণে কোচিং ও শিক্ষাঋণ বাবদ প্রদেয় ঋণের শিক্ষাকালীন সময়ের জন্য (৪/৫ বছর) কোনো সুদ ধার্য করা হয় না, শিক্ষা শেষে ৪/৫ বছরের মধ্যে পরিশোধকালীন সময়ের জন্য মাত্র ৫% হারে সুদ ধার্য করা হয়। সদস্যদের আবাসন সুবিধা নিশ্চিতকরণে প্রদেয় ঋণের সুদহার ৮% এবং ভিক্ষুকদের আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য দেশব্যাপী সুদমুক্ত ঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে ‘সংগ্রামী সদস্য কর্মসূচি’ নামে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এখন সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ ব্যাংক গড়ে সর্বোচ্চ ১০% হারে সুদ গ্রহণ করছে। এক্ষেত্রে সুদের ব্যবসা, সুদখোর বা রক্তচোষা হিসেবে প্রচারণার মূলে যে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা এটি বোধকরি আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।

সুষ্ঠু ও সৎ ব্যবস্থাপনাই সাফল্যের মূল ভিত্তি
মার্কস এঙ্গেলসের স্লোগান ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ আর আমাদের আজকের স্লোগান ‘পৃথিবীর ভালো মানুষ এক হও’। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেখান থেকেই শুরু করেছিলেন, যেখানে বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান শেষ করেছিলেন, তিনি রক্ষণশীল আর ড. ইউনূস উদারমনা। ফ্রিডম্যান রাষ্ট্র ও বাজার ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতেন আর ড. ইউনূস এগিয়েছেন উদ্যোগ আর সংগঠনকে কেন্দ্র করে, ইফেকটিভ প্রয়োজনের যে চলমান মতবাদ তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মাইক্রোক্রেডিটের জনক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক বৈপ্লবিক মনোভাব নিয়ে এগিয়েছেন এবং প্রমাণ করেছেন সুষ্ঠু ও সৎ ব্যবস্থাপনাই গ্রামীণ ব্যাংকের বিশ্বব্যাপী সাফল্যের মূল ভিত্তি।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা দুর্নীতি
ইতিপূর্বে রাষ্ট্র ও রাজনীতির সৃষ্ট দারিদ্র্য ও বৈষম্য পাশাপাশি একই সমান্তরালে প্রবাহিত হলেও আজকের সে বৈষম্য যোজন দূরত্ব তৈরি করেছে। গ্রামীণ ব্যাংক এই অসাধ্য কাজটি করলেও অর্থনীতিতে কৃষক-শ্রমিকের শ্রমের সৃষ্ট সম্পদ লুণ্ঠনের হাত থেকে রক্ষা করা না গেলে দারিদ্র্যবিমোচনের এ কর্মপ্রবাহ নিবৃত হবে না। সরকারি ব্যয়নীতি, দুর্নীতি আর পাহাড়সম খেলাপি ঋণসহ নিরন্তর লুটপাট হওয়ায় লাখ লাখ কোটিপতিতে দেশ ভরে গেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালে তার কল্পিত সংস্কার কতোখানি বাস্তবায়ন করে যেতে পারবেন তা সময় বলে দেবে, তার চিন্তা-চেতনা মুক্তি দিশারী হলেও এক বা দু’চারজন মহৎপ্রাণ মানুষ মিলে অনিয়মের যে মজবুত প্রাচীর গড়ে উঠেছে তা ভেঙে চুরমার করে নতুনের গোড়াপত্তন মোটেই সহজ কাজ নয়, তবুও এ গভীর সংকট মোকাবিলা করে একটি সুন্দর সকাল জাতির কাছে অর্পণ করতে না পারলে সমগ্র বিষয়টি সেই পুরনো দেয়ালেই চুনকাম করার মতো হাস্যকর হয়ে উঠবে। এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী আর আমলাদের যোগসাজশে লুণ্ঠন হওয়া দেশের গণতন্ত্র আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সকলকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে, তাহলেই হয়তো নতুন প্রজন্মের হাতে আমরা তাদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ তুলে দিতে পারবো।

লেখক:  উন্নয়ন কর্মী

 mzamin

No comments

Powered by Blogger.