ভারতের হুমকি: পররাষ্ট্রনীতির নতুন বিন্যাস by ডা. রফিকুর রহমান

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির ধস নেমেছে। দিল্লির ভ্রান্ত ও আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি তার জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী। হিন্দুত্ববাদী নেতৃত্ব এবং সাউথ ব্লকের আধিপত্যবাদী কূটনীতির কারণে ভারত এখন দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।

সর্বশেষ, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্যদিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আধিপত্যবাদী ভূ-রাজনীতির পরিসমাপ্তি ঘটে। ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং পলায়নে শুধু যে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটেছে তা নয় একই সঙ্গে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদেরও পতন ঘটে। যৌক্তিক কারণে বিশ্বাসযোগ্য যে, ভারত বাংলাদেশকে আজ্ঞাবহ করদ রাজ্যে পরিণত করার জন্য শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে বেছে নিয়েছিল। ভারত বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ষোল বছর টিকিয়ে রাখে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি এবং বেসরকারি প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে ফেলা হয়। বিচার বিভাগ এবং পুলিশ বাহিনীকে দলীয়করণ করে গুম খুন এবং হত্যাযজ্ঞের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়। পৃথিবীর বহু দেশ মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই বর্বরতার প্রতিবাদ করলেও মোদি সরকার টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। বরং ঢাকা দিল্লির সম্পর্ককে সর্বকালের সর্বোচ্চ উচ্চতর পর্যায়ে রয়েছে বলে নিজেরাই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নতুন নতুন বয়ান প্রচার করেছে। মোদি সরকার কোনোভাবেই শেখ হাসিনার পতনের বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারছে না। মনে হয় তাদের মাথায় বাজ পড়েছে। দিল্লি এখনো সত্য বিবর্জিত পুরনো পথেই হাঁটছে।

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং গত বৃহস্পতিবার সশস্ত্র বাহিনীর জয়েন্ট কমান্ডারদের সম্মেলনে রাশিয়া-ইউক্রেনে এবং ইসরাইল-হামাসের সংঘাতের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ তুলে ধরেন এবং সামরিক বাহিনীকে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটনা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে নির্দেশনা দেন। শত শত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরাইল-হামাসের সংঘাতের সঙ্গে বাংলাদেশকে এক করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। প্রচ্ছন্ন হুমকিটি যে বাংলাদেশকে উদ্দেশ্য করে দেয়া এটা বোঝার জন্য সামরিক বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।

একটু পিছনে যদি দেখি, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরদিন বাংলাদেশে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর পার্লামেন্টের সর্বদলীয় বৈঠকে বলেছিলেন ‘বাংলাদেশে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষণের নীতি অনুসরণ করবে ভারত। পাশাপাশি দেশটি সেনাবাহিনীকে সতর্ক অবস্থানে রাখবে।’ সেখানেও ছিল প্রচ্ছন্ন হুমকি।

বারবার এ ধরনের হুমকি হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে এবং সেই লক্ষ্যেই নতুন ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণে উদ্যোগী হতে হবে। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির সমীকরণগুলো বিবেচনায় না নিয়ে ভারত নিজের মতো করে শান্তি এবং স্থিতিশীলতার বয়ান তুলে নির্বোধের মতো যুদ্ধের হুমকির প্রদান ভারতের জন্য আত্মঘাতী ছাড়া আর কিছুই হবে না।

কতিপয় ভারতীয় বিশ্লেষকের মতে, বিগত ১৬ বছর ভারত শেখ হাসিনার সরকারের কাছ থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছিল বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকেও ভারত তেমনটি আশা করে। তাদের বুঝতে হবে ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে। ‘দিল্লি আছে আমরা আছি’,‘ভারতকে যা দিয়েছি সারা জীবন মনে রাখবে’ এবং ‘ভারতকে বলে এসেছি শেখ হাসিনাকে যেভাবেই হোক ক্ষমতায় রাখতে হবে’, এইসব বাক্য চয়ন প্রমাণ করে যে শেখ হাসিনা এবং তার সরকার গত পনেরো বছর শুধু দিল্লির দাসত্ব করে গেছে এবং বিনিময়ে দিল্লি হাসিনার ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য গুম, খুন এবং হত্যার মতো জঘন্য অপরাধগুলোকে সমর্থন করেছে। বাংলাদেশের জনগণের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে হাসিনা সরকারকে বৈধতা দেয়ার জন্য অভ্যন্তরীণ আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারত পুরো মাত্রায় সক্রিয় ছিল। ভারতের এই দায় এড়াবার কোনো সুযোগ নেই। গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির চর্চা হাসিনা আমলের মতো নতজানু হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই।

শত শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে গড়ে ওঠা যে ম্যান্ডেট নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে অবশ্যই তার প্রতিফলন থাকবে। বাংলাদেশ ভারত বিদ্বেষী নয় এবং বাহিরের কোনো নির্দেশনায় বাংলাদেশ চলবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব অখণ্ডতা এবং স্বার্থকে রক্ষা করে এমনটাই হবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। নতুন বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই ভারতকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির উদ্যোগী হতে হবে। ঢাকা-দিল্লির সুসম্পর্কের ভিত্তি নয়াদিল্লিকেই নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে। প্রচ্ছন্ন সামরিক হুমকি এক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না বরং দু’দেশের সম্পর্ককে আরও দূরে ঠেলে দেবে যেটা ভারতের জন্য সুখকর হবে না।

বাংলাদেশের অবস্থান থেকে ভারতকে কখনো আক্রমণ করার প্রশ্নই ওঠে না। ভারত বড় দেশ, বড় দেশ হওয়ার কারণে ভারতের যেমন অনেক সুবিধা রয়েছে তেমনি অসুবিধারও কমতি নেই। ভারত বহু ভাষা এবং জাতিতে বিভক্ত একটি দেশ। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছে। সামরিক দিক থেকে ভারতের অবস্থান অনেক বড়। তবে সামরিক সক্ষমতা এবং ভারতের অর্থনৈতিক শক্তি এত বিশাল নয় যে বাংলাদেশের মতো জাতিভিত্তিক একটি রাষ্ট্রকে সরাসরি যুদ্ধে পরাজিত করে দখলে নিতে পারবে। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় এটা অসম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশাল সামরিক সক্ষমতার দেশকেও বিভিন্ন রাষ্ট্রে সামরিক অভিযান চালিয়ে সবশেষে পরাজিত হয়ে রাজনৈতিক সমঝোতায় ফিরতে হয়েছে। বাংলাদেশের বড় শক্তি হচ্ছে বাংলাদেশ একটি রেজিমেন্টেড জাতি রাষ্ট্র। সাউথ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান এমন এক জায়গায় যে বাংলাদেশ আঞ্চলিক দুই শক্তি ভারত এবং চীনের মধ্যে ব্যালেন্স অফ পাওয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে। চীনের সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত না থাকলেও চীন এবং বাংলাদেশের প্রাকৃতিক অবস্থান কৌশলগত কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের নিশ্চয়ই বিষয়টি অজানা নয়।

SAARC কে পুনরুজ্জীবিত করে কার্যকরী করার মাধ্যমে সাউথ এশিয়ার দেশগুলোর শান্তি এবং নিরাপত্তা জোরদার করা সকলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বহুপাক্ষিকতাই কেবল শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। একপক্ষীয় শান্তি এবং নিরাপত্তার ধুঁয়া তুলে কোনো একটি দেশের আগ্রাসী তৎপরতা এবং প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরে সরকার ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে হস্তক্ষেপ সাউথ এশিয়ার অন্য কোনো দেশ মেনে নেবে না। আঞ্চলিক শান্তি এবং নিরাপত্তার জন্য চীনেরও যুক্ত হওয়া দরকার।

ভারত যদি সার্কের মাধ্যমে এই অঞ্চলে শান্তি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে ইচ্ছুক না হয় তাহলে বিকল্প ব্যবস্থা সাউথ এশিয়ার দেশগুলোকেই করতে হবে। বাংলাদেশ নেবে উদ্যোগী ভূমিকা। কোনোভাবেই এই অঞ্চলের শান্তিকে বিঘ্নিত করা যাবে না এবং এই অঞ্চলের কোনো দেশ আরেকটি দেশকে যুদ্ধের হুমকি দিতে পারবে না।

একটি প্রস্তাবনা হতে পারে সাউথ এশিয়ার রিমের সীমান্তে অবস্থিত দেশগুলোকে একসঙ্গে করে নিজেদের স্বার্থ এবং নিরাপত্তা সুরক্ষিত করার জন্য নতুন একটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সম্পর্কিত বেল্ট বা এসোসিয়েশন তৈরি করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া।

সাউথ এশিয়ার কেন্দ্রে মোটামুটিভাবে বিরাট অংশ নিয়ে ভারতের অবস্থান। দক্ষিণের সীমান্ত পানি বেষ্টিত, যেমন রয়েছে আরব সাগর, ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগর। রিমের অপর অংশে ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের স্থল সীমান্ত রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার। এই দীর্ঘ সীমান্তে সর্বমোট ৭টি দেশের সঙ্গে ভারতের স্থল সীমান্ত রয়েছে। দেশগুলো হচ্ছে পাকিস্তান, চীন, ভুটান, নেপাল এবং বাংলাদেশ। আফগানিস্তানের সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত নেই এবং মিয়ানমার সাউথ এশিয়ার রিম এর বাইরে অবস্থিত। সর্বদক্ষিণে দু’টি দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপের সঙ্গে ভারতের রয়েছে জল সীমান্ত। নিচের ম্যাপ থেকে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

সাউথ এশিয়ার এই রিমে অবস্থানরত দেশগুলো নিয়েই গঠিত হবে নতুন একটি অর্থনৈতিক রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা বলয়। যার নামকরণ হতে পারে Association of Countries of South Asian Rim for Co-operation বা অনুরূপ কোনো সংঘ।

বাংলাদেশ ভারতের চারপাশে অবরুদ্ধ নয় প্রকৃতপক্ষে ভারত অবরুদ্ধ তার প্রতিবেশী দেশগুলো দ্বারা যাদের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক নেই, রয়েছে ক্রমাগত দ্বন্দ্ব এবং অবিশ্বাস। প্রতিবেশী দু’টি দেশের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে ভারতের সম্পর্ক খারাপ এবং তারা যুদ্ধেও জড়িয়েছে যেমন পাকিস্তান এবং চীন। অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারত নতুনভাবে আগ্রাসী নীতি চাপিয়ে দিয়ে বিবাদে জড়িয়েছে। যেমন আফগানিস্তান, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশ। এই দেশগুলোর মধ্যে ভারত দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ। ভারতের হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি চাপিয়ে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধ্বংস করা মেগা প্রকল্প প্রণয়নে বাধা প্রদান করা, অভিন্ন নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে ভাটির দেশকে কখনো বন্যা কখনো খরায় পরিণত করা এবং ক্রমাগত সীমান্ত হত্যর মাধ্যমে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। ভারতের পুতুল শেখ হাসিনা সরকার গণআন্দোলনকে নস্যাৎ করতে শত শত ছাত্র-জনতাকে হত্যা করেছে এবং হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আহত হয়ে পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছেন। এর দায়-দায়িত্ব ভারত সরকারের ওপর অবশ্যই বর্তায় কেননা ভারতই অগণতান্ত্রিত ভোটারবিহীন পৈশাচিক হাসিনা সরকারকে বছরের পর বছর ধরে টিকিয়ে রেখেছিল।

কৌশলগত স্বার্থ সর্বদা পরিবর্তনশীল এবং এই পরিবর্তন অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির সামান্য পরিবর্তনের উপরও নির্ভর করে। উইন উইন নীতির উপর ভিত্তি করে কৌশলগত স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়।

দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে সঠিক বৈদেশিক নীতি এবং তার প্রয়োগের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের এই চ্যালেঞ্জে মোকাবিলার অনেকগুণ সক্ষমতা রয়েছে। কৌশল হবে দেশের স্বার্থে যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষিত করবে।

ভারত এই অঞ্চলের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং শান্তি নিশ্চিতে আগ্রাসী তৎপরতার পরিবর্তে যদি উইন উইন নীতির ভিত্তিতে এগিয়ে না আসে তাহলে বৃহৎ পরিসরে কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে। বাংলাদেশের এই সক্ষমতা রয়েছে।

লেখক: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষক।
mdr.rafiqur@gmail.com

mzamin

No comments

Powered by Blogger.