প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে কমালার চমক

এক অগ্নিঝরা প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ক। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ৫ই নভেম্বর প্রেসিডেন্ট পদের দুই প্রার্থী- কমালা হ্যারিস ও ডনাল্ড ট্রাম্প। প্রথমজন ডেমোক্রেট। দ্বিতীয়জন রিপাবলিকান। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় রাতে ফিলাডেলফিয়ায় তাদের মধ্যে বিতর্ক ছিল রীতিমতো উত্তেজনায় ভরা। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে প্রতিটি পর্বই ছিল প্রাণবন্ত। বিতর্ককে অভিহিত করা হচ্ছে ফায়ারিং ডিবেট হিসেবে। বিতর্কে উঠে আসে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, গর্ভপাত, অভিবাসন, ইসরাইল-ফিলিস্তিন, ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গার মতো বিষয়। বিতর্কে উভয় নেতা একে অন্যকে মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করেন। হলঘর দর্শকশূন্য ছিল এ সময়। ফলে কোনো হর্ষধ্বনি বা দুয়োধনি- কিছুই শোনা যায়নি। তবে টেলিভিশনের পর্দায় লাখ লাখ মার্কিনি এই বিতর্ক উপভোগ করেছেন। বরাবরের মতো এই বিতর্কে কে বিজয়ী হয়েছেন তা নিয়েও ব্যাপক আগ্রহ সবার। এমন অবস্থায় ডনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক মিডিয়া ফক্স নিউজ বলছে, বিতর্কে বিজয়ী হয়েছেন কমালা হ্যারিস। ফক্স নিউজের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্রিট হিউম বলেছেন, মঙ্গলবার রাতের বিতর্কে কমালা জিতেছেন। তার ভাষায়- বিতর্ক শুনে মনে হয়েছে কমালা খুব ভালোভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন। তিনি সেভাবেই প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। কি বলছেন, সে বিষয়ে ছিলেন সচেতন। এ বিতর্কে কমালা ছিলেন একেবারে ভিন্ন এক ব্যক্তি। একই রকম কথা বলেছে ওয়াশিংটন পোস্ট। বিতর্কের পর পরই জরিপ চালায় সিএনএন। তাতেও কমালা জয়ী হয়েছেন বলা হয়েছে।

বিশ্ব জুড়ে সচেতন মানুষের চোখ ছিল কমালা হ্যারিস ও ডনাল্ড ট্রাম্পের দিকে। অনলাইন ডয়চে ভেলে জানাচ্ছে- বিতর্কে কমালা হ্যারিস মার্কিনিদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনাদের জন্য ট্রাম্পের কোনো পরিকল্পনা নেই। ট্রাম্প শুধু ধনীদের জন্য কর ছাড় দেয়া নিয়ে চিন্তিত। তিনি সুবিধাবাদী অর্থনীতির পক্ষে। এতে ট্রাম্প জবাব দিয়েছেন। বলেছেন- কমালা হলেন খালি কলসি, যার ঢক্কানিনাদ বেশি। তার কোনো পরিকল্পনা নেই। তিনি বাইডেনের পরিকল্পনাই পরিবেশন করছেন। বিপরীতে কমালা অভিযোগ করেন, ট্রাম্প চীন ও অন্য দেশ থেকে আসা জিনিসের ওপর মাশুল বাড়াতে চান। এটা আসলে আমেরিকানদের ওপর কর বসানো। ফলে জিনিসের দাম বেড়ে যাবে। প্রতি মাসে সাধারণ মানুষের উপর কতোটা বোঝা চাপবে সেটাও জানিয়েছেন তিনি। ট্রাম্প বলেন, মাশুলের অর্থ দিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের কর কমাবেন। তার দাবি, মাশুলের ফলে জিনিসের দাম বাড়বে না। বরং এই মাশুল না থাকলে বেশি দামে জিনিস কিনতে হবে। এসময় হ্যারিস দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের জন্য তিনি নিজস্ব একটা আর্থিক নীতি নিয়ে চলছেন। ট্রাম্পের পাল্টা অভিযোগ, কমালা পুলিশের জন্য অর্থ কমাতে চান, সকলের কাছ থেকে বন্দুক কেড়ে নিতে চান। কমালা বলেন, তার কাছে ও তার রানিংমেট টম ওয়ালজের কাছে অনুমোদিত বন্দুক আছে। নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য তিনি বন্দুক রেখেছেন।

ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতেও ভিন্ন অবস্থান তুলে ধরেছেন মার্কিন দুই নেতা। ট্রাম্প ও কমালা দু’জনের কাছ থেকেই জানতে চাওয়া হয়, তারা কী করে ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ থামাবেন? জবাবে কমালা তার আগের অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। বলেন, ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। গতবছর ৭ই অক্টোবর হামাস ইসরাইলে ঢুকে এক হাজার দুইশ’ মানুষকে হত্যা করে। তিনি আরও বলেন, এখন যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। গাজায় সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন। সেই সঙ্গে যাদের জিম্মি করে রাখা হয়েছে, তাদের মুক্তি দিতে হবে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, আমাদের দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথেই যেতে হবে। এর ফলে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। ট্রাম্পের দাবি, তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলে এই লড়াই হতোই না। তার অভিযোগ, হ্যারিস ইসরাইলকে ঘৃণা করেন। তিনি প্রেসিডেন্ট হলে দুই বছরের মধ্যে ইসরাইল বলে কোনো দেশ থাকবে না। ট্রাম্পের অভিযোগ, হ্যারিস আরবদেরও ঘৃণা করেন। প্রেসিডেন্ট হলে দ্রুত এর সমাধান করার কথা জানান ট্রাম্প। হ্যারিস বারবার শপথ করে বলেন, তিনি এই সব অভিযোগ অস্বীকার করছেন। তিনি ইসরাইলের নিরাপত্তার অধিকার সমর্থন করেন। তার পাল্টা দাবি, বিশ্বনেতারা ট্রাম্পের কথায় হাসছেন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে ট্রাম্প দাবি করেন, আমি এই যুদ্ধ বন্ধ করতে চাই। আমি মানুষের জীবন বাঁচাতে চাই। বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন হতে দিয়েছে। এসময় সঞ্চালক ট্রাম্পকে প্রশ্ন করেন, আপনি কি চান- ইউক্রেন যুদ্ধে জিতুক? ট্রাম্প এই প্রশ্ন কৌশলে এড়িয়ে যান। কমালা হ্যারিস অভিযোগ করেন, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে তিনি পুতিনকে ইউক্রেন দখল করে নিতে দেবেন। হ্যারিস বলেন, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে পুতিন এতক্ষণে কিয়েভে বসে থাকতেন। তার নজর থাকতো বাকি ইউরোপের দিকে। হ্যারিস বলেন, ইউরোপীয় নেতারাও চান না, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হোন।
ক্যাপিটল হিলের হামলা নিয়ে ট্রাম্প বলেন, ক্যাপিটলের ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমাকে ওরা একটা ভাষণ দিতে বলেছিল, এটুকুই। তার সমর্থকরা ক্যাপিটলে প্রবেশের আগে ট্রাম্প ভাষণ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ফাইট লাইক হেল। তিনি সে সময় তার সমর্থকদের শান্তিপূর্ণভাবে ক্যাপিটলে যেতে বলেছিলেন। ট্রাম্প এই কথা বলতে অস্বীকার করেন যে, তিনি অনুতপ্ত। হ্যারিস বলেন, পাতা উল্টে দেখুন। ওইদিন কী বিশৃঙ্খলা হয়েছিল সেটা দেখুন।

গর্ভপাত নিয়ে ট্রাম্পের কাছে তার মতামত জানতে চাওয়া হয়। ট্রাম্প বলেন, ডেমোক্রেটরা চায় গর্ভধারণের নয় মাস পরেও গর্ভপাত করার অধিকার দিতে। তিনি চান, গর্ভপাতের বিষয়টি রাজ্যগুলো ঠিক করুক। তারা আইন করুক। ধর্ষণ বা কিছু ক্ষেত্রে তিনি গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষে। ট্রাম্পের অভিযোগ, কিছু রাজ্যে শিশু জন্মানোর পরেও তাদের প্রাণনাশের ব্যবস্থা আছে। বিতর্ক যারা পরিচালনা করছিলেন, তারা বলেন, কোনো রাজ্যেই এই ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। হ্যারিস বলেন, ট্রাম্পের আমলে যে তিনজন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করা হয়, তারাই দুই বছর আগে গর্ভপাত নিয়ে কেন্দ্রীয় স্তরে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার বাতিল করেছেন। তিনি আবেগতাড়িত হয়ে বলেন, ট্রাম্পের গর্ভপাত নিয়ে নিষেধাজ্ঞায় ধর্ষিতাদের ক্ষেত্রেও কোনো ছাড় দেয়া হয়নি।

কমালা হ্যারিস বিতর্ক শেষ করেন এইভাবে, আমরা আর পেছনে ফিরে যেতে চাই না। আমরা সামনের দিকে তাকাতে চাই। আমরা নতুন পথে হাঁটতে চাই। ট্রাম্প বলেন, হ্যারিস ছিলেন বাইডেন প্রশাসনের অঙ্গ। তিনি মানুষকে চাকরি দিতে পারেননি, যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। তার উচিত, এখনই সরে দাঁড়ানো।

এ বিতর্কের পর কমালার নির্বাচনী প্রচার শিবিরের মুখপাত্র জেন ও’ম্যালি ডিলন বলেন, বিতর্কে ডনাল্ড ট্রাম্প পুরোপুরি অসংলগ্ন ছিলেন। তিনি ছিলেন রাগান্বিত ও বিশৃঙ্খল। অন্যদিকে ট্রাম্পের নির্বাচনী শিবির থেকে দাবি করা হয়, তাদের প্রার্থী নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে বিতর্ক করেছেন। ও’ম্যালি ডিলন বলেন, বিতর্ক জুড়ে বিভিন্ন বিষয়ে ট্রাম্পকে লক্ষ্যচ্যুত করতে সক্ষম হয়েছেন কমালা। ব্রিট হিউম আরও বলেন, ‘মঙ্গলবার ট্রাম্পের জন্য খারাপ একটি রাত।’ আরেকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হ্যারল্ড ফোর্ড জুনিয়র সরাসরি বলেন, ‘আজ রাতে, কমলা জিতেছেন।’

কে ভালো করেছেন?- ওয়াশিংটন পোস্টের পক্ষ থেকে কয়েকজন ভোটারের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয়। তারা সবাই সুইং স্টেট বা দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যের ভোটার। কোনো নির্বাচনের আগে পরিচালিত বিভিন্ন জরিপে যদি দেখা যায়, কোনো অঙ্গরাজ্যে দুই দলের কেউই সুস্পষ্টভাবে এগিয়ে নেই, তখন সেই অঙ্গরাজ্যকে সুইং স্টেট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ভোটারদের মতামতের ভিত্তিতে ওয়াশিংটন পোস্ট বলেছে, মঙ্গলবার রাতের বিতর্কে এগিয়ে রয়েছেন কমালা।

মার্কিন ভোটার শ্যারির বয়স চল্লিশের কোঠায়। ওয়াশিংটন পোস্টকে তিনি বলেন, ট্রাম্পের বিপরীতে বিতর্কের জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন কমালা। তিনি ভালোভাবে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তিনি যে একজন যোগ্য প্রার্থী, সেটা প্রমাণের সুযোগ কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছেন। তবে ট্রাম্পের পক্ষ নিয়ে কোনি নামের আরেকজন ভোটার বলেন, আমার মনে হয় না কমালা কোনো প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর দিতে পেরেছেন। 

mzamin
মঙ্গলবার রাতে বিতর্কের পর বুধবার সকালে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে একই সঙ্গে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন প্রেসিডেন্ট পদের দুই প্রার্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস। মঙ্গলবার ফিলাডেলফিয়ায় বিতর্কের আগে তাদের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু বিতর্কে প্রথম হাত মেলানোর পর ম্যানহাটানে একই সময়ে গিয়ে দ্বিতীয়বার আবার তারা হাস্যোজ্বল হাত মেলালেন। কুশল বিনিময় করলেন। এ সময় তাদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ট্রাম্পের পাশে এ সময় উপস্থিত ছিলেন নির্বাচনে তার রানিংমেট ওহাইওর সিনেটর জেডি ভ্যান্স।

No comments

Powered by Blogger.