কে এই অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে!

শ্রীলঙ্কার এ যাবৎকালের ইতিহাস পাল্টে ফেললেন চীনপন্থি অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। তিনি ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাত্র শতকরা ৩ ভাগ ভোট পেয়েছিলেন। সেই দিশানায়েকেই এবার দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। বিষয়টি বাইরের দেশগুলোর লোকজনকে চমকে দিলেও শ্রীলঙ্কানরা বিস্মিত হননি। কারণ, দিশানায়েকে ঋণের ফাঁদে জর্জরিত দেশটিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। গরিববান্ধব নীতি গ্রহণ করেছেন। ফলে ভোটারদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি। ২০২২ সালে দেশটির অর্থনীতি বিধ্বস্ত হয়। ওই সময়ের সরকার প্রধান পালিয়ে যান। তারপর শনিবারই প্রথম সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। এতে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাজিথ প্রেমাদাসাকে পরাজিত করে বিজয়ী হন ৫৫ বছর বয়সী অনূঢ়া কুমারা প্রেমাদাসা। অন্তর্বর্তী সময়ের প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে চলে যান তিন নম্বরে। ২০১৯ সালের তুলনায় বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন দিশানায়েকে। তাকে এখন এমন একটি সরকারের ক্ষমতা উত্তরাধিকারী হিসেবে হাতে নিতে হবে, যা সংকটের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার লড়াই করছে।

অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকের জন্ম ১৯৬৮ সালে গালেওয়েলাতে ২৪শে নভেম্বর। মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হন। সরকারি স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। পদার্থবিজ্ঞানে আছে তার ডিগ্রি। ১৯৮৭ সালে যখন ইন্দো-শ্রীলঙ্কা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় প্রায় সে সময়ে তিনি ছাত্র হিসেবে প্রথম রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত জনতা বিমুক্ত পেরামুনা (জেভিপি) মার্কসবাদী রাজনৈতিক দলটি শ্রীলঙ্কা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করে। এই দলের সঙ্গে পরে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে দিশানায়েকের। গ্রামীণ নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির তরুণদের মধ্যে অসন্তোষ থেকে এই বিদ্রোহের প্রচারণা শুরু হয়। এর ফলে রাজনৈতিক বিরোধী এবং নাগরিক উভয়ের বিরুদ্ধে তল্লাশি, হত্যা ও হামলা শুরু হয়। এতে হাজারো মানুষ প্রাণ হারান। ১৯৯৭ সালে জেভিপি’র কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হন দিশানায়েকে। ২০০৮ সালে এ দলের নেতা নির্বাচিত হন তিনি। তখন থেকেই তিনি তার দলের কথিত ‘সন্ত্রাসের সময়ের’ বিষয়ে ক্ষমা চাইতে থাকেন। ২০১৪ সালে বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ওই সশস্ত্র লড়াইয়ে ব্যাপক ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটা উচিত ছিল না। আমাদের হাতে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার জন্য এখনো আমরা হতাশ। হতাশা প্রকাশ করি। এর জন্য আমরা সবসময় গভীর বেদনা ও শোক প্রকাশ করি। উল্লেখ্য, দিশানায়েকে বর্তমানে এনপিপি জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এতে তার দল জেভিপি’র আছে মাত্র তিনটি আসন।  এবার নির্বাচনী প্রচারণার সময় দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক ইতিহাসের আরেকটি সহিংসতাকে সামনে আনেন। তাহলো ২০১৯ সালের ইস্টার সানডে বোমা হামলা। ওই বছর ২১শে এপ্রিল রাজধানী কলম্বোতে কতোগুলো চার্চে এবং আন্তর্জাতিক হোটেলে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে কমপক্ষে ২৯০ জন নিহত হন। আহত হন কয়েক শত মানুষ। এটা শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা ছিল। কীভাবে এই হামলা হয়েছিল এবং নিরাপত্তার ব্যর্থতা নিয়ে তদন্তের জবাব ৫ বছর পরেও মেলেনি। তদন্তে বাধা দেয়ার জন্য অনেকে সাবেক প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসের সরকারকে দায়ী করেছেন। সম্প্রতি বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে দিশানায়েকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, নির্বাচিত হলে এই তদন্ত তিনি করাবেন। কর্তৃপক্ষ এটা করানো এড়িয়ে গেছে। কারণ, এতে তাদের নিজেদের দায় প্রকাশিত হয়ে পড়ার ভীতি ছিল তাদের মধ্যে। তিনি আরও বলেন, শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অভিজাতদের কাছ থেকে এটা ছিল অন্যতম অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি। তিনি আরও বলেন, রাজনীতিকরা দুর্নীতি বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজেরাই দুর্নীতিতে যুক্ত হয়েছেন। শ্রীলঙ্কাকে ঋণের ফাঁদ থেকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও ঋণের বোঝা আরও বেড়ে পরিাস্থিতির অবনতি হয়েছে। যারা আইনকে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তারাই আইন ভেঙেছেন। এ জন্যই এ দেশের মানুষ ভিন্ন নেতৃত্ব প্রত্যাশা করে। আমরাই সেই দল, যারা এসব সেবা দিতে পারবো।
শনিবার শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। এর আগেই শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে উঠে আসেন দিশানায়েকে। দেশ জুড়ে তীব্র অসন্তোষ থাকার ভেতর দিয়ে তিনি নিজেকে পরিবর্তনের জন্য একজন প্রার্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়ার কারণে ২০২২ সালের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন সাবেক প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসে ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপাকসে সহ তার সরকারের কর্মকর্তারা। এর আগে বছরের পর বছর ট্যাক্সনীতি, দুর্বল রপ্তানি, পলিসিগত বড় ভুলের সঙ্গে কোভিড-১৯ মহামারি মিলিত হয়ে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শুকিয়ে ফেলে। সরকারি ঋণের পরিমাণ কমপক্ষে ৮৩০০ কোটি ডলারের বেশি হয়। মুদ্রাস্ফীতি শতকরা ৭০ ভাগের উপরে উঠে যায়। এর জন্য রাজাপাকসে ও তার সরকারকে দায়ী করা হয়। যদিও তার উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে অর্থনৈতিক সংস্কার চালু করেন, মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনেন। শক্তিশালী করেন শ্রীলঙ্কান রুপি। ২০২২ সালের ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট ও তার প্রেক্ষিতে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাতে দেশে ভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বের দাবি উঠতে থাকে। সেই দাবি পূরণে এগিয়ে আসেন দিশানায়েকে। তিনি বার বার বলেন, ক্ষমতায় এসে পার্লামেন্ট ভেঙে দেবেন। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, নির্বাচিত হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে তিনি এটা করতে চান। দিশানায়েকে যেসব নীতি গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, বৃহত্তর কল্যাণমূলক স্কিম এবং ট্যাক্স কমানো।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.