গুলিতে স্বামীর মৃত্যু: তিন সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তায় আকলিমা by ফাহিমা আক্তার সুমি

আমার সন্তানরা তাদের বাবাকে খুঁজছে। তার জিনিসপত্র ধরে কান্নাকাটি করে। কী বলে সান্ত্বনা দিবো সন্তানদের? কীভাবে কাটাবো সন্তানদের নিয়ে বাকি জীবন। এত অল্প বয়সে আমার বাচ্চাদের বাবা-হারা হতে হলো। কীভাবে বেঁচে থাকবো আমার তিন সন্তানকে নিয়ে। কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিতে মারা যাওয়া সৈয়দ মোস্তফা কামাল রাজুর স্ত্রী আকলিমা আক্তার। গত ২০শে জুলাই দুপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জে আন্দোলন চলাকালীন সময়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন রাজু। ২২শে জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। তাদের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ। সিদ্ধিরগঞ্জে একটি গাড়ির গ্যারেজ ছিল রাজুর। পাশেই স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ভাড়া থাকতেন। রাজু ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।

নিহত রাজুর সিদ্ধিরগঞ্জের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, স্ত্রী-সন্তানদের চোখে-মুখে এখনো কাটেনি শোকের ছায়া। নীরব হয়ে রয়েছে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা সন্তানরা। বাবার রেখে যাওয়া জিনিস ও মোবাইলে থাকা ছবিগুলো বারবার ছুঁয়ে দেখছে। তাদের মা নিজের কষ্ট লুকিয়ে সন্তানদের বাবার কষ্ট ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন অনবরত। রাজুর স্ত্রী আকলিমা মানবজমিনকে বলেন, আমার স্বামী সব সময় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। এমন ঘটনা আমার সঙ্গে ঘটবে কখনো বুঝতে পারিনি। দেশে থেকে সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছিলো সেজন্য বিদেশে যাওয়ার চিন্তা করেছিল। গত ২৪শে জুলাই তার সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আর যেতে পারলো না। আমার সুখের সংসারটি শেষ হয়ে গেল। বড় মেয়ে আয়েশার ১৩ বছর বয়স। মেজ ছেলে সৈয়দ রাইয়ান এবং ছোট ছেলেটার বয়স ৫ বছর- তার নাম সৈয়দ আবু বক্কর। বড় দুই সন্তান মাদ্রাসায় পড়ে।
ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আকলিমা বলেন, রাজুকে রাজনীতি নিয়ে কখনো সময় দিতে দেখিনি। কিন্তু এইবার কেন জানি তাকে বেশি বিপ্লবী বিপ্লবী মনে হয়েছিল। তাকে টার্গেট করে গুলি করা হয়। বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে সে গুলি খায়। যে স্থানে বসে গুলিটি খেয়েছে সেটি আমার বাসার জানালা দিয়ে দেখা যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় বাসার দিকে হেঁটে আসে। এসময় তার মাথা-মুখ থেকে রক্ত ঝরছিল। পরে কয়েকজন লোক বাসার নিচে এসে আমাকে ডাকাডাকি করে। আমি বাসা থেকে নিচে দৌড়ে গেলে আমাকে কাছে যেতে দেয়নি। সেখানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছিল। আমাকে বলে আঘাত খেয়েছে আমি গেলে সমস্যা হবে। আসলে কিন্তু বিষয়টা এটি ছিল না। আমাকে বাসার মধ্যে যেতে বলে সামনের গেট আটকে দেয়। এসময় আমি চিৎকার দিয়ে বলি তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে সময় শুধু সবার পায়ে ধরা বাকি ছিল। তখন কেউই আমার কথা শুনেনি, গেট খুলেনি। আমার স্বামীর এক বন্ধু ও কয়েকজন তাকে প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেয়। সেখান থেকে প্রো-অ্যাকটিভ হাসপাতালে নিয়ে গেলে অবস্থা খারাপ হলে ঢাকা মেডিকেলে পাঠায়। পরের দিন ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে দেখি আমার স্বামী লাইফ সাপোর্টে রয়েছে। ওইদিনই চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, ২০শে জুলাই শনিবার বিকাল চারটায় বাসায় দুপুরের খাবার খেতে আসে। একসঙ্গে খাবার খেয়ে বসে গল্প করছিলাম আমরা, তখন চিটাগাং রোডে আন্দোলন শুরু হয়। আমাদের বাসার জানালা দিয়ে সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তাকে বলি জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সব- তুমি কোথাও যেও না। কিন্তু সে কথা না শুনে আন্দোলনে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যায়। ছাদে গিয়ে দু’-এক মিনিট থেকে বাসায় এসে আমাকে না বলে চলে যায়। আমি রুমে ঢুকে দেখি সে নাই। বাসার দোতলায় গিয়ে একজনকে বলি তাকে একটু কল দেয়ার জন্য। তখন দেশে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় কল যায়নি। ছাদে গিয়ে চারদিকে এত গোলাগুলির আওয়াজ- মনে হয়েছিল এই বুঝি গায়ে এসে লাগবে। মাথার উপর দিয়ে একটার পর একটা হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছে। রাজুকে আরেকটি নাম্বার দিয়ে কল দিলে কোনোমতে রিসিভ করে বলে, ‘আমি রাস্তায় আছি চিন্তা করো না- কিছুক্ষণ পরে বাসায় চলে আসবো।’ এটাই ছিল তার সঙ্গে আমার শেষ কথা। তখন বিকাল সাড়ে চারটা বাজে। ছাদে গিয়ে ওর বাবাকে দেখি পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিল ট্রাকের পাশে।
আকলিমা বলেন, রাস্তার পাশে একটি ভবনে আগুন জ্বলতে থাকে সেখানে পুলিশের সদস্যরা আটকা ছিল। হেলিকপ্টার চারদিকে ঘুরে অবস্থান দেখে। আগুন দেয়া ওই ভবন থেকে আটকে পড়াদের উদ্ধার করার চেষ্টা করে। পরে হেলিকপ্টার ও ডাচ্‌- বাংলা ব্যাংকের ভবন থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। এসময় তাদের সঙ্গে ছাত্রলীগেরও নেতাকর্মীরা ছিল। এরমধ্যেই অনেকে আহত আবার মারাও গিয়েছে। এমন ভয়ঙ্কর অবস্থা শুরু হয়েছিল এবার আর ছাদে থাকারও পরিস্থিতি ছিল না। আমরা এক একজন করে নেমে আসি ছাদ থেকে। সবাই আমার বাসায় এসে জানালা দিয়ে এই দৃশ্য দেখার চেষ্টা করে। এখানে থেকেও দেখার কোনো পরিস্থিতি ছিল না। কারণ যেকোনো মুহূর্তে জানালা দিয়ে গুলি লাগতে পারতো। এই এলাকায় অনেকে বাসার জানালা দিয়ে গুলি লেগে আহত-নিহত হয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই খবর আসে রাজু গুলি খেয়েছে। নিচে যে অবস্থা দেখি তখনই মনে হয়েছে সে আর বাঁচবে না।
তিনি বলেন, এই বাসাটি আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম কিন্তু জামায়াতের সদস্যরা আমাকে আশা দিয়েছেন। তারা আমাকেসহ এই এলাকায় অনেক শহীদ পরিবারকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। এখন তো ফ্ল্যাট বাসা নিয়ে থাকা সম্ভব না- সন্তানদের পড়াশোনার জন্য কোনোমতে সাবলেট নিয়ে থাকতে হবে। আমার সন্তানদের নিয়ে কীভাবে চলবো, কোন্‌দিকে যাবো এটি এখনো জানা নেই। নারায়ণগঞ্জে সমন্বয়করা আসলে আমি তাদের কাছে আবেদন করেছি আমাকে যেন একটা চাকরির সুযোগ করে দেয়। অবুঝ সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে সবার কাছে আমার এই একটাই চাওয়া। চাঁদপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। আমি কাজ করে আমার সন্তানদের মানুষ করতে চাই। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.