‘রাক্ষুসী’ যমুনার পেটে শত শত ঘরবাড়ি-ফসলি জমি

সিরাজগঞ্জে চলতি বছরের জুলাই মাসের বন্যায় দীর্ঘদিন পানি থাকার পর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও দেখা দেয় যমুনা নদীতে ভাঙন। দিনের পর দিন নদীভাঙনে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সিরাজগঞ্জের চার উপজেলা।

রোববার সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, চলতি বন্যায় সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নের সয়াশিখা, বর্ণি, কৈগাড়ী দোড়তা, কাজিপুরের খাসরাজবাড়ি ইউনিয়নের শানবান্ধা ঘাট থেকে বিশুরিগাছা ঘাট ও শাহজাদপুরের জালালপুর ইউনিয়নের পাঁচিল, হাটপাঁচিল, জালালপুর, সৈয়দপুর ও চৌহালী উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের চরসলিমাবাদ দক্ষিণপাড়ায় যমুনা নদীতে তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড জিওব্যাগ ফেললেও বর্ষা মৌসুমে সেটা কোনো কাজেই আসেনি। যমুনার ভাঙনে জেলার চারটি উপজেলায় আট শতাধিক বসতবাড়ি ও প্রচুর পরিমাণে ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে। এর মধ্যে দুই তলা একটি বিল্ডিং, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা এবং ৭০ বছরের পুরাতন কবরস্থানও রয়েছে।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নের কৈগাড়ী দোরতা গ্রামের ওক চান বলেন, ‘আমার ৮ শতক জায়গার ওপরে দুইটি ঘর ও একটি গরুর গোয়াল ছিল। নদীতে সব বিলীন হয়েছে। আমার প্রায় ২ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে পরিবার নিয়ে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে আছি।’
কাওয়াকোল ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান (জিয়া মুন্সি) বলেন, ‘নদীভাঙনে জেলার মানচিত্র থেকে মুছে যেতে চলেছে এই ইউনিয়ন। ভাঙনরোধে পাউবো কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কাওয়াকোলা ইউনিয়নের হাট বয়ড়া, দৌগাছী, বড় কয়রা, ছোট কয়রা, কৈগাড়ী দড়তা, চণ্ডল বয়ড়া ও বেড়াবাড়ি গ্রামে নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে। এরই মধ্যে অনেক গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৩ শতাধিক ঘরবাড়ি নদীতে চলে গেছে।
শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের হাঁটপাচিল গ্রামে নিজের দোতলা বিল্ডিং চোখের সামনে নদীতে বিলীন হতে দেখেছেন কোবাদ মাস্টার। তিনি বলেন, ‘নদীতে পানি বৃদ্ধি ও নামার সময় তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। আমার একটি দোতলা বাড়ি এবং পাশেই বিশাল গরুর খামার নদীগর্ভে চলে গেছে।’
কৈজুড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন খোকন বলেন, ‘এবারের বন্যায় হাটপাচিলে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙন কবলিত এলাকার ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন ইউএনও।’
শাহজাদপুরের জালালপুর ইউনিয়নের পাকড়তলা গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কালাম শেখ বলেন, ‘সিরাজগঞ্জ পাউবোর ১৪ জন ঠিকাদার সমন্বিতভাবে যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণকাজ শেষ করতেন, তাহলে বর্ষায় আমাদের ৫ শতাধিক ঘর নদীতে বিলীন হতো না।
ভাঙনে ভিটামাটি হারানো কুলসুম বেগম বলেন, ‘নদীভাঙন অব্যাহত রয়েছে। নদী সবকিছু কেড়ে নিয়ে আমাদের সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। গৃহহারা হয়েছে অনেক পরিবার। খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমে জীবন পার করছি। কেউ সাহায্য করতে এলো না। আমরা মরে গেলে কী কারও কিছু হবে?’
জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে এ অঞ্চলে ভাঙন চলে আসছে। এক মাসে এ এলাকার প্রায় ২০০ বসতভিটা ও ৩০০ একর ফসলি জমি বিলীন হয়েছে। যমুনায় ভাঙনের তীব্রতা আরও বেড়েছে। ভাঙন শুরু হয়েছে পার্শ্ববর্তী কৈজুরী ইউনিয়নের হাটপাচিল গ্রামেও। মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। ভাঙনরোধে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প দিলেও তিন বছরেও তা শেষ হয়নি। শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘জালালপুর ও কৈজুরী  ইউনিয়নের হাটপাচিল এলাকায় ভাঙন দেখা দিলে সেখানে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দুটি এলাকায় চলতি বন্যায় অন্তত ৪৫ থেকে ৫০টি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙন কবলিতদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের সহযোগিতা করা হবে।’
চৌহালী উপজেলা ইউএনও মাহবুব হাসান বলেন, ‘পানি বৃদ্ধির সময় ভাঙন দেখা দিয়েছিল। আমরা জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। কবরস্থানের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। কিছু মরদেহ নদীতে পড়েছে। পরে স্বজনেরা মরদেহ উদ্ধার করে অন্যত্র কবর দিয়েছেন।’ সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশরী রঞ্জিত কুমার সরকার বলেন, ‘২০২১ সালে যমুনার ভাঙনরোধে শাহজাদপুরের এনায়েতপুর থেকে কৈজুরী পর্যন্ত সাড়ে ৬ কিলোমিটার নদীতীর রক্ষাবাঁধ নির্মাণকাজ শুরু হয়। ৬৫০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও মাত্র অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।’

mzamin

No comments

Powered by Blogger.