পাবনায় শিক্ষার্থীদের মিছিলে গুলি করা সন্ত্রাসীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে

পাবনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ৪ঠা আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলায় দুই শিক্ষার্থীসহ তিনজন নিহত  হন। আহত হন শতাধিক শিক্ষার্থী সহ সাধারণ মানুষ। নিহতরা হলেন- শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম (১৯), মাহাবুব হোসেন নিলয় (১৬) ও রাজ্জাক (৪৫)। সেদিন শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করতে দেখা গেছে পাবনার আওয়ামী লীগের পদধারী নেতাদের। তাদের সবার হাতেই ছিল অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। এ ঘটনায় পাবনা সদর থানায় ১১ ও ৩০শে আগস্ট দু’টি মামলা হয়।

একটি মামলার বাদী নিহত জাহিদের বাবা চর বলরামপুরের দুলাল উদ্দিন মাস্টার এবং অপরটির বাদী পাবনা শহরের যুগিপাড়ার মো. সুজন। প্রথম মামলাতে ১০৩ ও দ্বিতীয়টিতে ১২৪ জনকে আসামি করা হয়। দুই মামলা মিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ঘটনা ঘটার ৪০ দিন পার হলেও মূল আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। তবে পুলিশ বলছে, আমরা তৎপর; যেকোনো সময় ভালো সংবাদ দিতে পারবো। ৫ই আগস্টের পর থেকেই লাপাত্তা পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা এবং ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতারা।

সেদিন কি ঘটেছিল?
৪ঠা আগস্ট বেলা ১১টা থেকে পাবনা সরকারি অ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আব্দুল হামিদ রোডের ট্রাফিক মোড়ে তাদের ঘোষিত কর্মসূচি পালন করছিলেন। সে সময় তাদের কর্মসূচিতে দুই প্রান্ত থেকে হামলা চালানো হয়। এক প্রান্তে তৎকালীন এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক প্রিন্সকে দলবল নিয়ে পিস্তল হাতে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে ভিডিও ভাইরাল হয়। এ নিয়ে জেলা জুড়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা এখনো চলছে। অপর প্রান্তে যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শিবলী সাদিক ও তার লোকজন শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানোর চেষ্টা করে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাদের ধাওয়া দিলে তারা পিছু হটে। শিক্ষার্থীরা যুবলীগের ওই নেতার অফিস ভাঙচুর করে। এ ঘটনার পর দ্বিতীয় দফায় ভাঁড়ারা ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ খান ও তার লোকজন সশস্ত্র অবস্থায় হামলা চালায়। তাদের সেই গুলি চালানোর দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এরপর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক কামিল হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান মিন্টু, আব্দুল আহাদ বাবু, পৌর মেয়র শরীফ উদ্দিন প্রধান, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন, রুহুল আমিনসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পিস্তল ও শটগান দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এ ঘটনায় দু’জন শিক্ষার্থীসহ তিনজনের মৃত্যু হয়।
এদিকে ঘটনার পর থেকে শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের নেতাদের গুলি করার বেশ কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে থাকে। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ‘পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পাবনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পিস্তল নিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে শিক্ষার্থীদের মিছিলে ধাওয়া করছেন। তার পাশে অনেকের হাতে শটগান, লোহার রড, জিআই পাইপ ছিল। এ ছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাবেক পৌর মেয়র কামরুল হাসান মিন্টু, জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শিবলী সাদিক, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র শরীফ উদ্দিন প্রধান, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক কামিল হোসেন,  আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে শটগান ও পিস্তলসহ দেখা গেছে। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল হাসান শাহীন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম পাকন ও সদস্য নজরুল ইসলাম সোহেলের কাছেও অস্ত্র দেখা গেছে।

আন্দোলনে পাবনার সমন্বয়ক মো. শাওন হোসেন বলেন, ঘটনার ৪০ দিন পার হলেও মূল আসামিরা গ্রেপ্তার হচ্ছে না। এটা দুঃখজনক। আমরা এ বিষয়ে পুলিশের সঙ্গে সার্বক্ষণিক গ্রেপ্তারের জন্য যোগাযোগ করে যাচ্ছি। গ্রেপ্তার না হলে খুব তাড়াতাড়ি আমরা নিজেরা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেবো অন্য কিছুর। আরেক সমন্বয়ক ফাহাদ হোসেন বলেন, পাবনায় গত ৪ঠা আগস্ট ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা স্থানীয় এমপি থেকে শুরু করে অনেক নেতারা মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ করেছে। গুলি করে যারা হত্যা করেছে তাদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত ফাঁসি কার্যকরের দাবি জানাই।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিষদের পাবনা জেলা শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার মো. নাসিম বলেন, ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে যারা নির্বিচারে গুলি করে তারা কোনো সময় দেশপ্রেমিক নাগরিক নয়। তাদের সবাইকে সন্ত্রাসী বলতে হবে। তৃণমূলের কর্মীদের মাঠে নামাতে না পেরে নেতারা অবৈধ অস্ত্র দিয়ে গুলি করে হত্যা করা ন্যক্কারজনক কাজ। এটা আওয়ামী লীগের দেউলিয়াত্বের শামিল। এদেরকে ধরে দ্রুত বিচারে ফাঁসি দিতে হবে। পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, আমরা ইতিমধ্যে ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি ভালো সংবাদ দিতে পারবো হয়তো। পাবনার সব থানার কার্যক্রম এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক। এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। সেদিন আমিও সেখানে ডিউটিতে ছিলাম। ভাঁড়ারার সাঈদ চেয়ারম্যান ও তার লোকজন যেভাবে গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.