জুয়া: আইন কী বলে? by রাশিম মোল্লা

প্রকাশ্য জুয়া আইন। ১৮৬৭ সালে ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের শাসনাধীন এলাকায় প্রকাশ্য জুয়া খেলার অপরাধে শাস্তি এবং সাধারণ ক্রীড়াভবনের ব্যবস্থা করার জন্য আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ আইন থাকা স্বত্বেও গত এক সপ্তাহ ধরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্লাবে অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকটি ক্যাসিনো সিলগালা ও বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কারো বিরুদ্ধেই ‘জুয়া  খেলার’ অপরাধে মামলা হয়নি। সব মামলা হয়েছে মাদক, মানি লন্ডারিং ও অস্ত্র আইনে।

আইনজ্ঞরা বলছেন, ভিন্ন আইনে মামলার মূল কারণ জুয়া খেলা বন্ধে প্রচলিত আইনটি  দেড়শ বছরেরও অধিক পুরনো। ওই আইনে ‘ক্যাসিনো’ বলে কোনো শব্দই নেই। এ কারণে আইনটির কোনো কার্যকারিতাও নেই। তবে, ৭২’-এর সংবিধানে জুয়া নিষিদ্ধের ব্যাপারে বলা আছে। তাই জুয়া ঠেকাতে প্রয়োজন কার্যকরী ও কঠোর আইন। এ ব্যাপারে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ক্যাসিনো জুয়া ব্যাপকতা লাভ করেছে। তাই জুয়া খেলা বন্ধে বিদ্যমান আইনটি দ্রুত সংশোধন করে একটি কঠোর আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে থাকবে যাবজ্জীবন কারদন্ডের বিধান। ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনোর লাইসেন্স দেয়ার যুক্তিকতা প্রসঙ্গে এই আইনজীবী বলেন, যুব সমাজ ধ্বংসকারী ক্যাসিনোর লাইসেন্স দেয়া কোনো মতেই সঠিক হবে না। লাইসেন্স দেয়া হলে এটি হবে সংবিধান বিরোধী। জুয়া বন্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রুলটি নিষ্পতি করতে এটর্নী জেনারেল অফিসের উদ্যোগী ভূমিকা পালন করা দরকার ছিল বলে তিনি মনে করেন। রুলটি নিষ্পত্তি হলে হয়তো আদালতের পক্ষ থেকে একটি নির্দেশনা আসত। এটা হলে ক্যাসিনোর মতো জুয়া হয়তো এতটা ব্যাপকতা লাভ করতো না। একই কথা বলেন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এএম আমিন উদ্দিন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জুয়া শাস্তি যোগ্য অপরাধ। যেহেতু জুয়া খেলার ধরন পাল্টাচ্ছে, সেহেতু আইনটিকে যুগোপযোগী করতে হবে।  ক্যাসিনো জুয়ার লাইসেন্স দিতে হলে অবশ্যই সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কেননা, সংবিধানে জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে বলা হয়েছে।    

২০১৩ সালে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ জুয়াখেলার অনুমতি চেয়ে করা একটি রিট খারিজ করে রায় দেয়। কিন্তু ওই রায়ের কারণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জুয়া খেলা দন্ডনীয় অপরাধ। ফলে গ্রামের দরিদ্র শ্রেণির মানুষ জুয়া খেলতে পারছেন না। তবে শহরের ধনীরা আইনের ফাকফোকরকে কাজে লাগিয়ে এখনো চলছে জুয়া। চলছে জুয়ার আপডেড ভার্সন ক্যাসিনো খেলা।

কী আছে বঙ্গীয় প্রকাশ্য জুয়া আইনে? এই আইনের ১ ধারায় সংজ্ঞায় বলা হয়েছে,  এই আইন প্রকাশ্য জুয়া আইন, ১৮৬৭ নামে অভিহিত হবে এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশে প্রযোজ্য হবে। ‘জুয়া’ খেলা শব্দ দ্বারা জুয়া বা বাজি ধরা বোঝাবে (কেবল ঘোড়দৌড়ের জন্য ধরা বা জুয়া খেলা ব্যতীত)। খেলার কাজে ব্যবহৃত যে কোনো হাতিয়ার বা সামগ্রী ‘ক্রীড়াসামগ্রী’ শব্দের অন্তর্গত। ৩ ধারায় বলা আছে, এ ধরনের জুয়া খেলা দন্ডনীয় অপরাধ। যে কোনো ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদন্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন। এ রকম কোনো ঘরে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যে কোনো সরঞ্জামসহ কোনো ব্যক্তিকে জুয়ারত বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদন্ড বা ১০০ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন।

আইনের এসব ধারা ও যুক্তি তুলে ধরে ২০১৬ সালে জুয়াখেলা বন্ধের দাবিতে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ সামিউল হক ও রোকন উদ্দিন মো. ফারুক দুই আইনজীবী একটি রিট মামলা দায়ের করেন। ওই রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা ক্লাব, উত্তরা ক্লাবসহ দেশের ১৩টি নামিদামি ক্লাবে সব ধরনের জুয়াখেলার ওপর নিষেধাজ্ঞার আদেশ জারি করে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ক্লাবগুলোয় এ ধরনের জুয়াখেলা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং জুয়াখেলার আয়োজনকারীদের বিরুদ্ধে কেন যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে ১-১২ নং বিবাদীদের ওপর রুল জারি করেন। বিবাদীরা হলো- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, চট্রগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, র‌্যাবের মহাপরিচালক, ঢাকা ডেপুটি কমিশনার, চট্রগ্রাম ডেপুটি কমিশনার, খুলনা ডেপুটি কমিশনার, সিলেট ডেপুটি কমিশনার, নারায়নগঞ্জ ডেপুটি কমিশনার।   কিন্তু ঢাকা ক্লাবের এক আবেদনে হাইকোর্টের ওই আদেশ স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। যদিও আপিল বিভাগ জুয়া খেলা বন্ধে হাইকোর্টের জারি করা রুল ৮ সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে সকল পক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৪১ সপ্তাহ পার হলেও রুলটি নিষ্পত্তি হয়নি।

এরফলে, আপিল বিভাগের নিষেধাজ্ঞা নিয়েই অভিজাত ওই ক্লাবগুলোতে চালানো হচ্ছে জুয়া খেলা। ক্লাবগুলো হচ্ছে- ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, বনানী ক্লাব, ধানমন্ডি ক্লাব, অফিসার্স ক্লাব ঢাকা, ঢাকা লেডিস ক্লাব, ক্যাডেট কলেজ ক্লাব, চিটাগাং ক্লাব, চিটাগাং সিনিয়রস ক্লাব, নারায়ণগঞ্জ ক্লাব, খুলনা ক্লাব ও সিলেট ক্লাব। রিটের পক্ষের আইনজীবী রেদোয়ান আহমেদ বলেন, ওই সময় বিবাদীদের রুলের জবাব দেয়ার জন্য নোটিশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিবাদীরা এখনো রুলের জবাব দেননি। হাইকোর্টের দেয়া রুলটি নিষ্পত্তি হলে এবং জুয়া বন্ধে রায় আসলে ১৩ ক্লাবসহ কোনো ক্লাবে ক্যাসিনোর মতো জুয়া চালানো সম্ভব হতো না। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ক্লাবগুলোতে জুয়া খেলা চলছে। অবকাশের পর এ রিটের চূড়ান্ত শুনানির উদ্যোগ নেব। অপরদিকে, ঢাকা ক্লাব ও উত্তরা ক্লাবের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল জানান, আপিল বিভাগের আদেশের পরে হাইকোর্ট বেঞ্চটি ভেঙে যায়। এ কারণে রুলটি নিষ্পত্তি হয়নি। আর ওই রুল নিষ্পত্তি না হওয়ায় আপিল বিভাগের স্থগিতাদেশ এখনো বহাল রয়েছে। দীর্ঘদিনেও বিষয়টি শুনানির উদ্যোগ কেন নেওয়া হয়নি সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, সরকার জুয়া খেলাকে বৈধতা দিয়েছে। কেননা সরকার জুয়া বন্ধ করতে চাইলে দ্রুত রুলটি নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতো। ৩৩ মাসেও শেষে হলো না কেন? রুলটি নিষ্পত্তি হলে ১৩ ক্লাবসহ অন্যরাও জুয়া খেলা চালিয়ে যেতে পারত না। সরকার ক্লাবগুলোতে ক্যাাসিনো খেলা বন্ধে এখন অভিযান পরিচালনা করছে।  ওই সময় যদি জুয়া খেলা বন্ধের রুলটি নিষ্পত্তি করতে পারতো তাহলে আজ ক্লাব গুলোতে ক্যাসিনো খেলার আয়োজন করতে পারতো না।

No comments

Powered by Blogger.